আইন কি প্রশ্নটির উত্তর জেনে নেওয়া খুবই অত্যবশ্যক। শুধু আইন এ সম্পর্কে জানলেই হবে না বরং আইন কি, আইন কত প্রকার, আইনের বৈশিষ্ট্য কি কি, জাতীয় আইন কি, বাংলাদেশের আইন ও বাংলাদেশের সকল আইন সম্পর্কে আপনাকে অবহিত হতে হবে। তাহলে আসুন আইন কি সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিন:
আইন কি?
যদি সহজভাবে বলা হয়, আইন হলো সামাজিক নিয়ম ও রীতিনীতির একটি নির্দিষ্ট ও সুসংগঠিত ব্যবস্থা যা রাষ্ট্র কর্তৃক প্রণয়ন ও প্রয়োগ করা হয়। আইনের প্রধান উদ্দেশ্য হলো সমাজে শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখা, নাগরিকদের অধিকার ও স্বাধীনতা রক্ষা করা এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা।
আবার,আইন হলো একটি নিয়ম ব্যবস্থা যা একটি সমাজে আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে। এটি সমাজের স্বাধীনতা, নিরাপত্তা এবং সমৃদ্ধি বজায় রাখতে সাহায্য করে।
তবে বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা আইন সম্পর্কে তাদের মূল্যবান বক্তব্য প্রদান করেছেন।
আইন কত প্রকার
আইন কি এ সম্পর্কে তো জেনেছেন তবে এবার আসুন জেনেনি আইন কত প্রকার এ সম্পর্কে..
সাধারণত প্রাথমিকভাবে আইন দুই প্রকার। যথা:
(১) রাষ্ট্রীয় আইন বা দেশীয় আইন
(২) আন্তর্জাতিক আইন
রাষ্ট্রীয় আইন
রাষ্ট্রীয় আইন বলতে রাষ্ট্রের কর্তৃপক্ষ দ্বারা প্রণীত ও প্রয়োগকৃত আইনকে বোঝায়। এটি একটি দেশের ভূখণ্ডের মধ্যে প্রযোজ্য আইন। রাষ্ট্রীয় আইনের উদ্দেশ্য হলো সমাজের স্বাধীনতা, নিরাপত্তা এবং সমৃদ্ধি বজায় রাখা। রাষ্ট্রীয় আইনরতন রাষ্ট্রের পার্লামেন্ট বা আইনসভা থেকে প্রণীত হয়ে থাকে। আবার এই রাষ্ট্রীয় আইন বা দেশীয় আইনকে দুই ভাগে বিভক্ত যেমন: সর্বজনীন আইন ও ব্যক্তিগত বা পারিবারিক আইন।
আন্তর্জাতিক আইন
আন্তর্জাতিক আইন মূলত বিভিন্ন দেশের সমন্বয়ে তৈরি একটি আইন। এই আইনেরনিয়ম ও নীতির সার্বভৌম রাষ্ট্রগুলির মধ্যে সম্পর্ক নিয়ন্ত্রণ করে।সাধারণত দুই বা ততধিক রাষ্ট্রের স্বার্থে আন্তর্জাতিক আইন তৈরি করা হয়। তবে আন্তর্জাতিক আইনের উৎস মূলত দুই ধরনের হয়ে থাকে। আর এই দুই ধরনের আইনের উৎস হচ্ছে বস্তুগতও অবস্তুগত। আশা করি আমরা আপনাকে আইন কি ও আইন কত প্রকার এ সম্পর্কে অবহিত করতে পেরেছি। তবে এবার আমাদের জেনে নিতে হবে আইনের বৈশিষ্ট্য গুলো কি কি…
আইনের বৈশিষ্ট্য গুলো কি কি
আইন তার বৈশিষ্ট্যের জন্য রাষ্ট্রে কিংবা পৃথিবীতে সর্বোচ্চ স্থান সম্মানিত হয়ে আছে। নিম্নে আইনের বৈশিষ্ট্যসমূহ উপস্থাপন করা হলো:
সার্বভৌমতা: আইন সকলের জন্য সমান অধিকার প্রদান করে থাকে। তেমনি সার্বভৌমত্ব আইনের ক্ষমতার দ্বারা প্রনীত।
সর্বজনীন: আইন মূলত সর্বজনীন। আইন রাষ্ট্রে বসবাসকারী সকল মানুষের জন্য যেমন ধনী-গরিব,শিশু-বৃদ্ধ সকলের জন্য সমান। আইনের চোখে কোন ভেদাভেদ নেই।
বিধিবদ্ধ নিয়মাবলি: আইন কতগুলো রীতিনীতি,নিয়ম-কানুন ও প্রথার সমষ্টিতে তৈরি।
রাষ্ট্রীয় অনুমোদন ও স্বীকৃতি: রাষ্ট্র যে সকল নিয়মসমূহ বা নিয়মকানুন স্বীকৃতি প্রদান করে তখন নিয়মসমূহ আইনের রূপান্তরিত হয়। এক কথায় বলা যায় আইন তৈরির পিছনে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ অবদান বা রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব রয়েছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে অনুমোদন ও স্বীকৃতি ছাড়া কোন নিয়ম-কানুন, রীতিনীতি কখনোই আইনে রূপান্তরিত হতে পারে না।
বাহ্যিক আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে: আইন মানুষের বাহ্যিক আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে। এর ফলে মানুষ আইন বিরোধী কোন কাজ করতে ভয় পায় ও সদা আইনের পথে অবস্থান করে।
ব্যক্তিস্বাধীনতার রক্ষক: আইনকে অবশ্যই ব্যক্তি স্বাধীনতার রক্ষক হতে হবে। যাতে কোন ব্যক্তির স্বাধীনতা ক্ষূর্ণ না হয়। আর আইনকে ব্যক্তির স্বাধীনতার ভিওি হিসেবে অবহিত করা হয়।
পরিবর্তনশীল: আইনকে অবশ্যই পরিবর্তনশীল হতে হবে। কারণ সময়ের সাথে মানুষের চাহিদা, রীতিনীতি পরিবর্তন হয়ে থাকে। সে ক্ষেত্রে আইনকে অবশ্যই সময়,দেশ, কাল ভেদে পরিবর্তনশীল হতে হবে।
সুস্পষ্ট: আইন অবশ্যই সুস্পষ্ট হতে হবে। কারণ অসুস্পষ্ট আইন দেশের ও অসাধারণ জনগণের কল্যান সাধন করতে পারেনা।
সম্পূর্ণতা: আইন অবশ্যই সম্পূর্ণতা প্রাপ্ত হতে হবে। কারণ অসম্পূর্ণ আইন সমাজ ও রাষ্ট্রে নানারকম বিশৃঙ্খলা তার সৃষ্টি করতে পারে।
সঙ্গতি: আইন অবশ্যই সঙ্গতিপূর্ণ হওয়া উচিত। আইনের মধ্যে কোন দ্বন্দ্ব বা বিরোধ থাকা উচিত নয়।
জাতীয় আইন কি
আইন হল এমন আইন যা কোনও নির্দিষ্ট দেশের সার্বভৌম সরকারের দ্বারা প্রণয়ন ও প্রয়োগ করা হয়। এটি একটি দেশের নাগরিকদের আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং সমাজের ন্যায় ও শৃঙ্খলা বজায় রাখতে সহায়তা করে।
জাতীয় আইনের বিভিন্ন উৎস রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে:
সংবিধান: সংবিধান হল একটি দেশের সর্বোচ্চ আইন। এটি একটি দেশের সরকারের কাঠামো, ক্ষমতা এবং অধিকারগুলি নির্ধারণ করে।
আইনসভা আইন: আইনসভা আইন হল সংসদ বা অন্যান্য আইনসভা কর্তৃক প্রণীত আইন। এগুলি সাধারণত রাষ্ট্রের নাগরিকদের অধিকার ও স্বাধীনতা, অর্থনীতি, বাণিজ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবেশ ইত্যাদি বিষয়গুলি নিয়ন্ত্রণ করে।
প্রশাসনিক আইন: প্রশাসনিক আইন হল সরকারের নির্বাহী শাখা দ্বারা প্রণীত আইন। এগুলি সাধারণত সরকারের কর্মচারীদের কর্তব্য ও ক্ষমতা, এবং সরকারি পরিষেবাগুলির প্রদান নিয়ন্ত্রণ করে।
আদালতের সিদ্ধান্ত: আদালতের সিদ্ধান্তগুলিও জাতীয় আইনের উৎস হিসাবে বিবেচিত হয়। আদালতগুলি আইনের ব্যাখ্যা এবং প্রয়োগের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নেয়, যা পরবর্তী ক্ষেত্রে অন্যান্য আদালত দ্বারা অনুসরণ করা হয়।
জাতীয় আইনের উদ্দেশ্য
জাতীয় আইনের উদ্দেশ্যগুলির মধ্যে রয়েছে:
সমাজের ন্যায় ও শৃঙ্খলা বজায় রাখা: জাতীয় আইন অপরাধ এবং বিশৃঙ্খলা প্রতিরোধে সহায়তা করে। এটি সকল ব্যক্তির অধিকার ও স্বাধীনতা রক্ষা করে।
সামাজিক স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধি অর্জন: জাতীয় আইন একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং সামাজিক স্থিতিশীলতা অর্জনে সহায়তা করে।
সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা: জাতীয় আইন একটি দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সহায়তা করে। এটি দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলিতে রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। জাতীয় আইন একটি দেশের সমাজের জন্য অপরিহার্য। এটি সমাজের শৃঙ্খলা এবং ন্যায়বিচার বজায় রাখতে সহায়তা করে।
সাধারণ আইন
সাধারণ আইন হলো একটি আইন ব্যবস্থা যা মূলত পূর্ববর্তী আদালতের সিদ্ধান্তের উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়ে থাকে। সাধারণ আইন লিখিত আইনের উপর নির্ভর করে না, বরং আদালতের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে বিবর্তিত হয়। সাধারণ আইন ব্যবস্থায়, আদালতগুলি পূর্ববর্তী সিদ্ধান্তগুলিকে অনুসরণ করার বাধ্যতায় আবদ্ধ থাকে, যাতে আইনের ঐক্য এবং স্থিতিশীলতা বজায় থাকে। সাধারণ আইন ব্যবস্থার উৎপত্তি ইংল্যান্ডে হয়েছিল।
মধ্যযুগীয় ইংল্যান্ডে, রাজা এবং তার কর্মকর্তারা আইন প্রণয়ন এবং প্রয়োগের একমাত্র দায়িত্ব পালন করতেন। সাধারণ আইন ব্যবস্থা আজ বিশ্বের অনেক দেশে পরিচালিত হয় ও ব্যবহৃত হয়। এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ভারত, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের মতো দেশগুলির আইন ব্যবস্থার ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
সাধারণ আইনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো:
- এটি একটি ঐতিহ্যবাহী আইন ব্যবস্থা, যা পূর্ববর্তী আদালতের সিদ্ধান্তের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে।
- এটি লিখিত আইনের উপর নির্ভর করে না, বরং আদালতের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে বিবর্তিত হয়।
- সাধারণ আইন ব্যবস্থায়, আদালতগুলি পূর্ববর্তী সিদ্ধান্তগুলিকে অনুসরণ করার বাধ্যতায় আবদ্ধ থাকে।
আইনের সাধারণ কিছু সুবিধা হলো:
- সাধারণ আইন স্থিতিশীল এবং পূর্বাভাসযোগ্য আইন ব্যবস্থা।
- সাধারণ আইন বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে।
- সাধারণ আইনের ঐক্য এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে।
আরও পড়ুন: প্রযুক্তি কি? বিভিন্ন প্রকার প্রযুক্তির সংজ্ঞা
সাধারণ আইনের কিছু অসুবিধা হলো:
- সাধারণ আইন জটিল এবং ধীরগতির আইন ব্যবস্থা।
- সাধারণ আইন পরিবর্তনের সাথে দ্রুত খাপ খাইয়ে নিতে পারে না।
- সাধারণ আইন প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে পারে না।
বাংলাদেশের সকল আইন
বাংলাদেশ সাধারণ আইনে পরিচালিত একটি দেশ। তবে বাংলাদেশের এ সাধারণ আইন দু-একদিনে তৈরি হয়নি বরং সময়ের সাথে বাংলাদেশের আইন সমূহ তৈরি হয়েছে। পরবর্তীতে এই সকল আইন সমূহ বাংলাদেশের সংবিধানে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।
বাংলাদেশের সকল আইন সমূহ নিম্মে সংক্ষিপ্ত আকারে উপস্থাপন করা হলো:
- মৌলিক অধিকার আইন: বাংলাদেশের সংবিধানের তৃতীয় অংশে মৌলিক অধিকারের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ২৬ নং ধারা থেকে ধারা নং ৪৭ এর ক পর্যন্ত মৌলিক অধিকার আইনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
- মামলা আইন: মামলা আইন বাংলাদেশের সংবিধানের ১১১ অনুচ্ছেদের অন্তর্ভুক্ত আইন।
- কোডিফিকেশন এবং ভাষা
- তথ্য আইন
- ধর্মীয় আইন
- শ্রমিক আইন
- ফৌজদারি আইন
- কোম্পানি আইন
- চুক্তি আইন
- কর প্রদান আইন
- সম্পত্তি আইন
- মেধাসত্ত্ব আইন
- বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা
- আইনি পেশা
- বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি
- বিচার বিভা
এ ছাড়া বাংলাদেশের আরো আইন রয়েছে যা আপনি সংবিধানে দেখতে পাবেন।
গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রশ্নের উত্তর
আইন কত প্রকার কি কি?
আইন প্রধানত দুই প্রকার, যথা দেশীয় বা জাতীয় আইন এবং আন্তর্জাতিক আইন।
আইন এর জনক কে?
আধুনিক আন্তর্জাতিক আইনের “জনক” হুগো গ্রোশিয়াস (১০ এপ্রিল ১৫৮৩ – ২৮ আগস্ট ১৬৪৫)। তিনি ছিলেন ওলন্দাজ প্রজাতন্ত্রের একজন আইন বিশেষজ্ঞ।
আইনের তিনটি উৎস কি কি?
আইনের তিনটি উৎস হলো- ১। প্রথা, ২. ধর্ম, ৩. আইনবিদদের গ্রন্থ।
আইন বিভাগের প্রধান কাজ কি?
আইন বিভাগের প্রধান কাজ হলো-
ক) রাষ্ট্র পরিচালনা করা
খ) শাসন করা
গ) আইন প্রণয়ন করা
ঘ) আইন প্রয়োগ করা
শেষ কথা
আশা করি আমরা আপনাকে, আইন কি ও আইন সম্পর্কে বিস্তারিত জানাতে পেরেছি। প্রতিটি নাগরিকের আইন সম্পর্কে বিশদ জ্ঞান রাখা আবশ্যক।