আমাদের আজকের আলোচনা ঈমানের মূল বিষয় কয়টি কি কি এ বিষয় নিয়ে। ইসলামের পাঁচটি মৌলিক স্তম্ভের মধ্যে সর্বপ্রথম, সর্ব প্রধান এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হচ্ছে ঈমান। ঈমান ছাড়া কেউ মুসলিম হতে পারে না। ঈমানের কয়েকটি মৌলিক বিষয় রয়েছে। এসকল বিষয়ের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস ব্যতীত মানুষ কাফের বা মুশরিক থাকে। আমরা একজন মুমিন হতে এবং আল্লাহর প্রিয় বান্দা হতে দৃঢ়ভাবে ঈমান আনা এবং ঈমানের মূল বিষয়গুলোর প্রতি বিশ্বাস করা আবশ্যক। তাই ঈমানের মূল বিষয় কয়টি ও কি কি, এবং সেগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিন এই লেখা থেকে।
ঈমানের মূল বিষয় কয়টি
ঈমানের মৌলিক বিষয়বস্তু সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) একটি পরিচয়বাচক বাক্য বর্ণনা করেছেন। এটি ‘ঈমানে মুফাস্সাল’ হিসেবে পরিচিত।
আরবি: امَنْتُ بِاللهِ وَمَلئِكَتِه وَكُتُبِه وَرَسُوْلِه وَالْيَوْمِ الْاخِرِ وَالْقَدْرِ خَيْرِه وَشَرِّه مِنَ اللهِ تَعَالى وَالْبَعْثِ بَعْدَالْمَوْتِ
বাংলা অর্থ: আমি ঈমান আনলাম আল্লাহর উপর তার ফিরিশতাদের উপর, তার আসমানী কিতাবসমূহ, তার রাসূলগণ এবং শেষ দিবসের উপর আর এর উপর যে, অদৃষ্টের ভাল-মন্দ আল্লাহ তা’আলার তরফ হতে এবং মৃত্যুর পর পুনরুত্থানের উপর।’’
উপরোক্ত ৭টি বিষয়ের মধ্যে পবিত্র কুরআনে ৬টি রুকন বা স্তম্ভের কথা আল্লাহর বাণী দ্বারা প্রমাণিত এবং কুরআন ও হাদীসে বারংবার উল্লেখিত হয়েছে। এখানে আখিরাতের বিশ্বাসকে পৃথক দুটি বাক্যাংশে প্রকাশ করা হয়েছে। যথা: “ইয়াওমিল আখির” বা শেষ দিবস এবং “বা’সি বা’দাল মাউত” বা মৃত্যুর পরে উত্থান। মূলত এই বিষয়গুলো একই মর্মে বিবেচনা করা যায়।
এ বিষয়ে জিবরাঈলের হাদীস নামে একটি গুরুত্বপূর্ণ হাদিস রয়েছে। যথা:
হযরত ওমর (রাঃ) -থেকে বর্ণিত, “একদিন আমরা রাসূলুল্লাহ (সাঃ) -এর নিকট বসেছিলাম। এমন সময় হঠাৎ এক ব্যক্তি আমাদের নিকট উপস্থিত হল, এরপর বলল, “আমাকে ঈমান সম্পর্কে বলুন”। তিনি বললেন, “
জিবরাঈলের হাদীস নামে গুরুত্বপূর্ণ একটি হাদিসে রয়েছে, উমার বলেন, তা হচ্ছে এই- আল্লাহ্, তাঁর ফেরেশতাগণ, তাঁর কিতাবসমূহ, তাঁর রাসূলগণ ও আখেরাতের উপর ঈমান আনা এবং তাকদীরের ভাল-মন্দের উপর ঈমান আনা।” (সহীহ মুসলিম)
ঈমানের মূল বিষয় কয়টি ও কি কি ব্যাখ্যা কর
উপরে আমরা ঈমানের ষাটটি মূল বিষয় সম্পর্কে জেনেছি। এবার এগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জেনে নেওয়া যাক:
(১) মহান আল্লাহ তায়ালার প্রতি বিশ্বাস
একজন মুমিনের ঈমান আনার সর্বপ্রথম এবং সর্বপ্রধান বিষয় হলো মহান আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা। বস্তুত আল্লাহ তায়ালার প্রতি বিশ্বাস করাই ঈমানের মূল বিষয়। আমাদেরকে আল্লাহ তায়ালার তাওহীদ বা একত্ববাদে বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে। মহান আল্লাহ তায়ালা এক ও অদ্বিতীয়। তিনি আমাদের একমাত্র মাবুদ, সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তা।
আল্লাহ তা’আলা তার সত্তা ও গুণাবলীতে একক ও অতুলনীয়। আল্লাহ তা’আলার সমকক্ষ বা সমতুল্য কেউ নেই। মহান আল্লাহর সুন্দর সুন্দর নাম ও গুণ রয়েছে। তিনি ব্যতীত অন্য কেউই ইবাদতের যোগ্য নয়। এমন বিষয়গুলির প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করাই আল্লাহর প্রতি ঈমান আনা।
(২) ফেরেশতাগণের প্রতি বিশ্বাস
প্রতিটি মুসলিম ব্যক্তিই জানে, ফেরেশতাগণ মহান আল্লাহর এক বিশেষ সৃষ্টি। আল্লাহ তা’আলা অসংখ্য ফেরেশতা সৃষ্টি করেছেন। ফেরেশতারা নূরের তৈরি। তারা সর্বদাই আল্লাহ তা’আলার জিকির ও তাসবীহ পাঠে নিয়োজিত থাকে। বস্তুত আল্লাহর নির্দেশ পালনই তাদের একমাত্র কাজ এবং আল্লাহ তায়ালার হুকুম পালন ব্যতীত তারা আর কোন কাজই করে না।
অসংখ্য ফেরেশতাদের মধ্যে চারজন ফেরেশতা নেতৃস্থানীয় হয়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন। তারা হলেন:
(১) হযরত জিব্রাইল (আঃ) – তিনি আল্লাহর বাণী নবী রাসূলগণের নিকট পৌঁছে দিতেন।
(২) হযরত মিকাইল (আঃ) – তিনি আল্লাহর হুকুমে মানুষ ও জীবজন্তুর জীবিকা বন্টনের কাজে নিয়োজিত রয়েছেন।
(৩) হযরত আজরাইল (আঃ) – তিনি আল্লাহর হুকুমে মানুষ ও জীনদের মৃত্যু ঘটানো বা রূহ কবজ করার দায়িত্ব পালনে নিয়োজিত আছেন।
(৪) হযরত ইসরাফিল (আঃ) – তিনি সিঙ্গা নিয়ে আল্লাহর নির্দেশের জন্য প্রস্তুত আছেন। যখন আল্লাহ তা’আলা আদেশ করবেন তখন সাথে সাথেই সিঙ্গা ফুৎকার দেবেন। এতে করে দুনিয়া ও এসব কিছু ধ্বংস হয়ে যাবে। দ্বিতীয়বার ফুৎকারে আবার সবাই জীবন ফিরে পেয়ে আখিরাতের ময়দানে বিচারের জন্য আল্লাহর সামনে উপস্থিত হবে।
এছাড়া অন্যান্য ফেরেশতাগণ আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী নিজ নিজ দায়িত্ব পালনে নিয়োজিত আছেন। ফেরেশতাগণ সম্পর্কে সম্পূর্ণরূপে এমন বিশ্বাস স্থাপন করা ঈমানের মৌলিক বিষয়গুলোর একটি।
(৩) আসমানী কিতাবসমূহের প্রতি বিশ্বাস
হযরত আদম (আঃ) -কে পৃথিবীতে প্রেরনের পর থেকে মহান আল্লাহ তা’আলা বহু আসমানি কিতাব নাযিল করেছেন। সকল আসমানী কিতাবে আল্লাহ কালাম বা বাণী। মানবজাতির হেদায়েতের জন্য তিনি নবী রাসুলগণের মাধ্যমে এই কিতাবগুলো মানুষের নিকট পৌঁছিয়েছেন। পৃথিবীতে সর্বশেষ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ আসমানী কিতাব হলো আল-কোরআন। এছাড়াও সর্বমোট ১০৪ খানা আসমানী কিতাব আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ হয়েছে এরূপ বিশ্বাস স্থাপন করাও ঈমানের মূল বিষয়।
(৪) নবী-রাসুলগণের প্রতি বিশ্বাস
মানবজাতির হেদায়েতের জন্য মহান আল্লাহ তা’আলা যুগে যুগে অসংখ্য নবী-রাসুল প্রেরণ করেছেন। তারা মানুষকে সত্য উন্নয়নের পথে ডেকেছেন এবং আল্লাহ তাআলার পরিচয় দিয়েছেন। মূলত তারা আল্লাহর পক্ষ থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েই তাওহীদের বাণী প্রচার করতেন। নবী-রাসুলগণের প্রতি বিশ্বাস করাও ঈমানের মূল বিষয়গুলোর একটি।
(৫) আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস
মৃত্যুর পরবর্তী জীবনকে পরকাল বা আখিরাত বলা হয়। আমাদের মৃত্যুর পর থেকেই আখিরাতের জীবন শুরু হবে। সেখানে মানুষ ভালো কাজের জন্য জান্নাত এবং মন্দ কাজের জন্য জাহান্নাম পাবে। আখেরাতের প্রতি তীব্র বিশ্বাস করা ঈমানের অন্যতম মৌলিক বিষয়।
(৬) তকদিরের প্রতি বিশ্বাস
তকদির অর্থ ভাগ্য বা নিয়তি। তকদির আল্লাহর হাতে এবং তিনিই এর নিয়ন্ত্রক। আমাদের তকদিরে ভালো-মন্দ যাই ঘটুক না কেন সবকিছু আল্লাহর ইচ্ছায় ঘটে। তাই তকদির আল্লাহ তা’আলা নিয়ন্ত্রণ করেন এই মর্মে দৃঢ় বিশ্বাস রাখতে হবে।
আরও পড়ুন: ঈমানের শাখা কয়টি ও কি কি?
(৭) পুনরুত্থানের প্রতি বিশ্বাস
প্রত্যেক মানুষ এবং সকল জীবিত প্রাণীকেই মৃত্যুবরণ করতে হবে। কিন্তু কেয়ামতের সময় মহান আল্লাহ তা’আলা পৃথিবী, এর মানুষজন এবং যাবতীয় সবকিছু ধ্বংস করে দেবেন। তখন আল্লাহ ছাড়া আর কেউ থাকবে না। পরবর্তীতে আল্লাহ তায়ালার হুকুমে পৃথিবীর সকল মানব এবং জিন জাতি পুনরায় জীবিত হয়ে হাশরের ময়দানে একত্রিত হবে। এ সময় তাদের কৃতকর্মের হিসাব নেওয়া হবে। মানুষের মৃত্যুর পরের পুনরুত্থানের প্রতি এরূপ বিশ্বাস স্থাপন করা ঈমানের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক বিষয়।
ঈমানের স্তম্ভ কয়টি ও কি কি | ঈমানের মূল বিষয় কয়টি
ঈমানের মূল বিষয়গুলোকে ঈমানের স্তম্ভ বলা হয়। ঈমানের বা বিশ্বাসের উপর স্বীকৃতির ছয়টি বা মতান্তরে সাতটি স্তম্ভ এসেছে কুরআন ও সুন্নাহ থেকে। পবিত্র আল-কোরআনের সূরা-বাকারা এর ২-৪ নং আয়াতে ঈমান সম্পর্কে উপরোক্ত ৭টি বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। ঈমানের এই সকল বিষয়গুলো হলো:
- একক ইলাহ বা উপাস্য হিসেবে আল্লাহকে বিশ্বাস করা।
- আল্লাহর ফেরেস্তাগণকে বিশ্বাস করা।
- আল্লাহ কর্তৃক প্রেরিত কিতাবসমূহে বিশ্বাস করা।
- আল্লাহ কর্তৃক প্রেরিত সকল নবী-রাসূলগণকে বিশ্বাস করা।
- পরকালে বিশ্বাস করা।
- তাকদীরের উপর আল্লাহর পূর্ণ ক্ষমতা রয়েছে বলে বিশ্বাস করা। এবং
- পুনরুথান হওয়ার প্রতি বিশ্বাস করা।
শেষকথা
উপরোক্ত আলোচনা থেকে ঈমানের মূল বিষয় কয়টি ও কি কি, সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানলেন। মহান আল্লাহ তা’আলা আমাদের অন্তরে এসকল বিষয়ের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস লালন করা এবং একজন মুমিন হিসেবে জীবন পরিচালনা করার তৌফিক দান করুক, আমিন।