লাইলাতুল কদরের নামাজের নিয়ম: মানবজাতির উপর রহমত বর্ষণের জন্য আল্লাহর বিশেষ নেয়ামত গুলোর মধ্যে বরকতময়, ফজিলতপূর্ণ ও সম্মানিত একটি রাত হলো লাইলাতুল কদর বা শবে কদর। হাজার মাসের চেয়ে অধিক উত্তম এই শবে কদর মুসলিম জাতির জন্য একটি নেয়ামত। মহান আল্লাহ তায়াল এই রাতেই পবিত্র আল কোরআন নাজিল করেছেন। তিনি এই রাতকে হাজার মাসের চেয়েও বেশি মহিমান্বিত করেছেন। এই রাতে প্রত্যেক কাজের জন্য ফেরেশতারা মহান আল্লাহর আদেশত্রুমে অবতীর্ণ হয়। ফজর হওয়া পর্যন্ত, এই রাতে শান্তি, বরকত ও রহমত বর্ষিত হয়।
শবে কদরের রাতে সালাত আদায়, দোয়া, অন্যান্য নেক আমলের ও জিকির-আযকারের মাধ্যমে অতিবাহিত করা সকল মুসলমানদের জন্যই অতি গুরুত্বপূর্ণ। তাই শবে কদরের দোয়া, শবে কদরের নামাজ কত রাকাত, শবে কদরের দোয়া, কদরের নামাজের নিয়ম, শবে কদরের নামাজের নিয়ত, সুরা কদর, শবে কদরের ফজিলত, লাইলাতুল কদর, শবে কদর, লাইলাতুল কদরের দোয়া, লাইলাতুল কদরের নামাজের নিয়ম, নিয়ত, দোয়া ও ফজিলত সম্পর্কে জেনে নিন এই লেখা থেকে।
শবে কদর/ লাইলাতুল কদর
আমাদের নিকট পরিচিত এই শবে কদর শব্দটি ফারসি শব্দ। এর আরবি শব্দ হলো লাইলাতুল কদর। মানবজাতির জন্য রহমত ও বরকতে ভরপুর এই ভাগ্য নির্ধারণী রাত কে আল্লাহ তাআলা রমজানের শেষ দশ দিনের বেজোড় রাতে লুকিয়ে রেখেছেন। মহান আল্লাহ তা’আলা এবং রাসূলুল্লাহ (সাঃ) লাইলাতুল কদরের রাতটি নির্দিষ্ট করে দেননি।
যখন কোন বান্দা রমজান মাসের ২১, ২৩, ২৫, ২৭ ও ২৯ রমজানের রাতে এই শবে কদরকে খুজে নিয়ে আল্লাহর ইবাদতে রজনী কাটিয়ে দেয়, আল্লাহ তা’আলা তার উপর বিশেষ রহমত বর্ষণ করেন। এই একটি রাত ১০০০ মাসের চেয়েও উত্তম। এই রাতেই পৃথিবীবাসীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়বস্তুগুলো নির্ধারণ করা হয়। তাই আল্লাহর পছন্দসই ও প্রিয় বান্দারা রমজানের শেষ দশ দিন মসজিদে ইতেকাফ করে লাইলাতুল কদর বা শবে কদর পাওয়ার জন্য কাটিয়ে দেয়। ইতেকাফ ছাড়াও আল্লাহর ইবাদতের মাধ্যমে এই রাত অন্বেষণ করে এর বরকত পাওয়া যায়।
লাইলাতুল কদরের দোয়া
শবে কদরের রাতে বিভিন্ন দোয়ার মাধ্যমে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা যায়। এই রাতে যত বেশি দোয়া করা যায় ততই উত্তম। আকাশের অসংখ্য ফেরেশতারা এই রাতে পৃথিবীতে অবস্থান করে এবং বান্দাদের চাওয়াগুলো মহান আল্লাহর সমীপে পেশ করে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) -এই রাতের জন্য বিশেষ ফজিলতপূর্ন দোয়ার কথা ব্যক্ত করেছেন। যথাঃ
আরবি দোয়া: اللَّهُمَّ إِنَّكَ عُفُوٌّ تُحِبُّ الْعَفْوَ فَاعْفُ عَنِّي
বাংলা উচ্চারন: “আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুয়্যুন; তুহিব্বুল আফওয়া; ফা’ফু আন্নি।”
বাংলা অর্থ: “হে আল্লাহ! আপনি ক্ষমাশীল, ক্ষমা করতে ভালোবাসেন; অতএব আমাকে ক্ষমা করে দিন। (তিরমিজি, মিশকাত শরীফ, মুসনাদে আহমাদ, ইবনে মাজাহ)
এছাড়াও সহিহ ইবনে খুজাইমায় বর্ণিত ১৮৮৭ নম্বর হাদিস অনুযায়ী, রমজান মাসে ৪টি দোয়ার সমন্বয়ে গঠিত একটি দোয়ার বিশেষ ফজিলত রয়েছে। এই ৪টি দোয়া হলো:
- أشهد أن لا إله إلا الله (আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ)। অর্থ: “আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া ইবাদতের উপযুক্ত আর কেউ নেই।”
- أستغفر الله (আস্তাগফিরুল্লাহ)। অর্থ: “আমি আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি।”
- أسألك الجنة (আসআলুকাল জান্নাহ)। অর্থ: “আমি আল্লাহর কাছে জান্নাত প্রার্থনা করছি।”
- أعوذ بك من النار (আউজু বিকা মিনান নার)। অর্থ: “আমি তোমার কাছে জাহান্নাম থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি।”
এগুলো একসাথে নিম্নোক্তভাবে পাঠ করা যায়:
আরবি: أشهد أن لا إله إلا الله استغفر الله نسألك الجنة ونعوذ بك من النار
বাংলা উচ্চারন: “আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আসতাগফিরুল্লাহা নাসআলুকাল জান্নাতা ওয়া নাউজুবিকা মিনান্নার।”
বাংলা অর্থ: “আমি স্বাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া ইবাদতের উপযুক্ত আর কেউ নেই। আমি আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইছি। আল্লাহ আমাদের সকলকে জান্নাত দান করুন এবং জাহান্নাম থেকে মুক্ত রাখুন। আমিন।”
এছাড়াও অন্যান্য বিভিন্ন প্রকার ফজিলতপূর্ন দোয়া এবং অন্যান্য ইবাদতের মাধ্যমেই এই রাতটি অতিবাহিত করা মুমিনদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
লাইলাতুল কদর নামাজের নিয়ত
অন্যান্য যেকোনো নামাজের নিয়তের মতোই শবে কদরের নামাজের নিয়তও অন্তরের সাথে সম্পৃক্ত৷ মনে মনে আল্লাহর সামনে দাঁড়িয়ে নামাজের ভাবনা স্থাপন করলেই নিয়ত হয়ে যায়। তবে আরবিতে শবে কদরের নামাজের নিয়ত করতে চাইলে নিম্নোক্তভাবে করা যায়:
আরবী নিয়ত: نَوَايْتُ اَنْ اُصَلِّىَ لِلَّّهِ تَعَالَى رَكْعَتَىْ صَلَوةِ لَيْلَةِ الْقَدْرِِ النَّفْلِ مُتَوَجِّهًا اِلَى جِهَةِ الْكَعْبَةِ الشَّرِيْفَةِ اَللَّهُ اَكْبَرُ
আরবী নিয়তের বাংলা উচ্চারণ: “নাওয়াইতু-আন উছাল্লিয়া লিল্লাহি তা’আলা রাক-আতাই সালাতিল লাইলাতিল ক্বাদরি নফলে মুতাওয়াজ্জিহান ইলা জিহাতিল কা’বাতিশ শারীফাতি, আল্লাহু আকবর।”
নিয়তের বাংলা অর্থ: আমি কিবলামুখী হয়ে আল্লাহর (সন্তুষ্টির) জন্য লাইলাতুল কদরের দুই রাকাত নফল নামাজ পড়ার নিয়ত করলাম, আল্লাহু আকবর।
এখান থেকে বাংলা নিয়তটি করাই অধিক উপযুক্ত। কারন আরবিতে নিয়ত করতে উচ্চারন ভূলের মাধ্যমে নিয়তে অর্থ বিকৃত হতে পারে।
লাইলাতুল কদরের নামাজের নিয়ম
শবে কদরের নামাজের নিয়ম অন্যান্য নামাজের মতই। পবিত্রতা অর্জন করে অন্যান্য নফল নামাজের মতোই এই নামাজ আদায় করা যায়। মূলত লাইলাতুল কদরের রাত্র শুরু হয় মাগরিব নামাজের পর থেকেই। রাতে এশার সালাত আদায় করে রমজান মাসের তারাবীর সালাত আদায় করে বিতর সালাত সামনে রেখে এই নামাজ আদায় করে অধিকাংশ মুমিনরা। এক্ষেত্রে নিম্নোক্ত নিয়মে এই সালাত আদায় করতে পারবেন।
- সর্বপ্রথম, তাকবীরে তাহরীমা ‘আল্লাহু আকবার’ বলে নামাজের নিয়ত করে হাত বাঁধুন।
- এবার, ছানা, আউজুবিল্লাহ ও বিসমিল্লাহ সম্পূর্ণ তিলাওয়াত করুন।
- তারপর সূরা ফাতেহা পড়ুন এবং সাথে সূরা বা কেরাত পড়ুন। সম্ভব হলে বড় কোন সূরা তেলাওয়াত করুন।
- অন্যান্য নামাজের মত রুকু ও সিজদা করুন। এই নফল নামাজে রুকু সিজদা দীর্ঘ হওয়া উত্তম।
- দ্বিতীয় রাকাতও অনুরূপভাবে আদায় করুন।
- বৈঠকে বসে তাশাহহুদ, দরুদ শরীফ ও দোয়া মাছুরা পাঠ করুন।
- সালাম ফিরানোর মাধ্যমে নামাজ সম্পন্ন করুন।
এভাবে দুই দুই রাকাত করে ৪ রাকাত নামাজ আদায় হয়ে গেলে বিভিন্ন দোয়া পড়ে মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে দোয়া করুন। এভাবে যত রাকাত সম্ভব হয় পড়তে পারবেন।
শবে কদরের নামাজ কত রাকাত
লাইলাতুল কদরের নামাজের রাকাত সংখ্যা নির্দিষ্ট নয়। তাই নামাজের নিয়ম-নীতি ঠিক রেখে যত বেশি আদায় করা যায়, ততই উত্তম। এই নফল সালাতটি অন্যান্য নফল সালাতের মতোই ২ আদায় করতে করে আদায় করতে হবে। তবে খেয়াল রাখতে হবে, নামাজের সৌন্দর্য যেন ঠিক থাকে।
সূরা কদর
إِنَّآ أَنزَلْنَٰهُ فِى لَيْلَةِ ٱلْقَدْر
ইন্না আনঝালনাহু ফী লাইলাতিল কাদর।
وَمَآ أَدْرَىٰكَ مَا لَيْلَةُ ٱلْقَدْرِ
ওয়ামা আদরা কামা লাইলাতুল কাদর।
لَيْلَةُ ٱلْقَدْرِ خَيْرٌ مِّنْ أَلْفِ شَهْرٍ
লাইলাতুল কাদরি খাইরুম মিন আলফি শাহর।
تَنَزَّلُ ٱلْمَلَٰٓئِكَةُ وَٱلرُّوحُ فِيهَا بِإِذْنِ رَبِّهِم مِّن كُلِّ أَمْرٍ
তানাঝঝালুল মালাইকাতু ওয়াররুহু ফীহা-বিইযনি রাব্বিহিম মিন কুল্লি আমর।
سَلَٰمٌ هِىَ حَتَّىٰ مَطْلَعِ ٱلْفَجْرِ
ছালা-মুন হিয়া হাত্তা-মাতলাইল ফাজর।
সূরা কদরের অর্থ
- নিঃসন্দেহ আমি এটি (কুরআন) অবতারণ করেছি মহিমান্বিত রজনীতে।
- লাইলাতুল কদর (মহিমান্বিত রাত) সমন্ধে আপনি কি জানেন?
- লাইলাতুল কদর হল ০১ (এক) হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ।
- এতে প্রত্যেক কাজের জন্যে ফেরেশতাগণ ও রূহ অবতীর্ণ হয় তাদের পালনকর্তার নির্দেশক্রমে।
- এটা নিরাপত্তা, যা ফজরের উদয় পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।
লাইলাতুল কদর সম্পর্কে হাদিস
পবিত্র লাইলাতুল কদরের রাত্র সম্পর্কে মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে বর্ননা করেছেন এবং রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বহু হাদিস বর্ননা করেছেন। এই রাত্রি সম্পর্কে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। নিচে কিছু উল্লেখযোগ্য হাদিস তুলে ধরা হলো:
(১) হজরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “লাইলাতুল কদরে যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও সওয়াব লাভের খাঁটি নিয়তে লাইলাতুল কদর কিয়ামুল্লাইল বা তাহাজ্জুদে অতিবাহিত করে তবে তার পূর্ববর্তী সকল গোনাহ ক্ষমা করা হবে।” (সহিহ মুসলিম: ৭৬০, সহিহ বুখারি: ৬৭২)
আর পড়ুন: দোয়া কুনুত – আরবি উচ্চারণ ও বাংলা অর্থসহ
(২) হজরত আনাস ইবনে মালেক (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সাহাবিদের উদ্দেশ্যে বলেছেন- “তোমাদের নিকট এই মাস সমাগত হয়েছে, তাতে এমন একটি রাত আছে, যা এক হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। যে ব্যক্তি এ রাতের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হল, প্রকৃতপক্ষে সে যাবতীয় কল্যাণ থেকেই বঞ্চিত। শুধুমাত্র দুর্ভাগারাই এ রাতের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হয়।” (সুনানে ইবনে মাজাহ: ১৬৪৪)
(৩) রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, “রমজানের শেষ ১০ দিনে তোমরা কদরের রাতের সন্ধান কর।” (সহীহ মুসলিম: ১১৬৯)।
(৫) হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) থেকে বর্নিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন- “নিশ্চয় লাইলাতুল কদর হচ্ছে রমজানের শেষ সাতের মাঝখানে, সেদিন সকালে শুভ্রতা নিয়ে সূর্য উদিত হবে, তাতে কোনো কিরণ থাকবে না।”
অতঃপর হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেন, “আমি সূর্যের দিকে তাকিয়ে সেরূপ দেখেছি, যেরূপ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন।” (মুসনাদে আহমদ)
লাইলাতুল কদরের ফজিলত/ শবে কদরের ফজিলত
শবে কদরকে মহান আল্লাহ তায়াল মহিমান্বিত করেছেন। পবিত্র আল-কোরআন ও হাদিসে এই রাতের বিশেষ ফজিলতের কথা উল্লেখিত রয়েছে। এই রাতে মহান আল্লাহ তা‘আলা সম্পূর্ণ কুরআনুল কারীমকে ‘লাউহে মাহফুয’ থেকে প্রথম আসমানে নাযিল করেছেন। অন্য আরেকটি মতানুযায়ী, এই রাতেই কুরআন নাযিল শুরু হয়। এই রাতের ফজিলত বর্ণনা করে এ রাতেই সূরা কদর পূর্ণাঙ্গরূপে নাযিল হয়। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, যে মুসলমান শেষ দশ দিনে ইতেকাফ করবে। সে দুই টি ওমরা ও এক টি কবুল হজ্বের সওয়াব পাবে।
কোরআন নাজিল হওয়ার বদৌলতে এই রাতে মর্যাদা আরও বহুগুনে বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই এই এক রাতের ইবাদত হাজার মাসের ইবাদতের চেয়েও উত্তম। এটা শান্তি বর্ষণের রাত। এই রাতে পৃথিবীতে অসংখ্য ফেরেশতা নেমে আসে এবং তারা দুনিয়ায় কল্যাণ, বরকত ও রহমাত বর্ষণ করতে থাকে। এই রাতে নফল সালাত আদায় করলে মুমিনদের অতীতের সগীরা গুনাহগুলো মাফ করে দেয়া হয় এবং ইবাদতে লিপ্ত বান্দাদেরকে ফেরেশতারা জাহান্নামের আযাব থেকে মুক্তির বাণী শুনায়।
শেষকথা
মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য লাইলাতুল কদর বা শবে কদর একটি বিশেষ উপযুক্ত রাত। আমাদের সকলেরই রমজানের শেষ দশ দিনে বিজোড় রাত গুলোতে লাইলাতুল কদর বা শবে কদর সন্ধান করতে সচেষ্ট থাকা উচিত। লাইলাতুল কদরের নামাজের নিয়ম জেনে আমল করা একান্ত বর্তব্য।