আলী আমজদের ঘড়ি – যা এখন সিলেটের ঐতিহ্য

সিলেটে একটি স্থানীয় প্রবাদ চালু আছে: চাঁদনী ঘাটের সিড়ি, আলী আমজদের ঘড়ি, জিতু মিয়ার বাড়ী, বঙ্কু বাবুর দাড়ি।

আলী আমজদের ঘড়ি (Ali Amjader Ghari) সিলেট শহরে অবস্থিত ঊনবিংশ শতকের একটি স্থাপনা, যা ঘড়িঘর নামে একটি ঘরের চূড়ায় স্থাপিত বিরাটাকায় ঘড়ি। সিলেট শহরের প্রবেশদ্বারে সুরমা নদীর তীর ঘেঁষে ক্রীন ব্রিজের পার্শ্বে সিলেট সদর উপজেলায় অবস্থিত এই ঘড়িটির ডায়ামিটার আড়াই ফুট এবং ঘড়ির কাঁটা দুই ফুট লম্বা। স্বাধীনতার পূর্বে যখন ঘড়ির অবাধ প্রচলন ছিল না,

অর্থাৎ ১৮৭৪ খ্রিষ্টাব্দে সিলেট মহানগরীর প্রবেশদ্বারে এই ঐতিহাসিক ঘড়ি ঘরটি নির্মাণ করেন সিলেটের কুলাউড়ার পৃথিমপাশা জমিদার বাড়ীর নবাব আলী আহমদ খান, তার ছেলে নবাব আলী আমজদের নামে ঘড়ি ঘরটির নামকরণ করেন। লোহার খুঁটির উপর মজবুত ঢেউটিন দিয়ে সুউচ্চ গম্বুজ আকৃতির স্থাপত্যশৈলীর ঘড়িঘরটি তখন থেকেই আলী আমজদের ঘড়িঘর নামে দেশে-বিদেশে পরিচিতি লাভ করে।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময় পাক হানাদার বাহিনীর গোলার আঘাতে এই প্রাচীন ঘড়িঘরটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দেশ স্বাধীনের পর সিলেট পৌরসভা কর্তৃপক্ষ ঘরসহ ঘড়িটি মেরামতের মাধ্যমে সচল করলেও অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ঘড়ির কাঁটা বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৮৭ খ্রিষ্টাব্দে পূনরায় ঘড়িটি মেরামত করে আবার চালু করা হয়। ঘড়িটি চালু করার পর ঢাকার একটি কোম্পানীর কারিগররা ঘড়িটি চালু রাখার জন্য রিমোট কন্ট্রোলের ব্যবস্থা করে দেয়।

পৌরসভা চেয়ারম্যানের অফিস কক্ষ থেকে রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমে ঘড়ির কাঁটা ঘুরতো। কিন্তু ২/৪ বছর যেতে না যেতেই ঘড়ির কাঁটা আবারও বন্ধ হয়ে যায়। এরপর সিজান কোম্পানী দ্বারা বৈদুত্যিক পদ্ধতিতে ঘড়িটি পূনরায় চালু করা হয়। কিন্তু এক বছরের মধ্যে ঘড়িটির কাঁটা আবারও বন্ধ হয়ে যায়। সর্বশেষ ২০১১ সনে সিলেট সিটি কর্পোরেশন এই ঘড়িটিকে পূণরায় মেরামত করলে তা এখনও সচল রয়েছে।

আলী আমজদের ঘড়ি
আলী আমজদের ঘড়ি

ঘড়ি ঘরের বর্ণনা

অবস্থান সিলেট সদর, বাংলাদেশ
নকশাকারক নবাব আলী আহমদ খান
ধরন  টাওয়ার
উপাদান  টিন ও লোহা
প্রস্থ ৫.১ মি (১৬.৭ ফু)
উচ্চতা  ৭.৪ মি (২৪.৩ ফু)
স্থাপনের তারিখ  ১৮৭৪; ১৪৮ বছর আগে

সিলেট কিভাবে যাবেন

বাংলাদেশের যেকোন স্থান থেকে সড়ক, রেল এবং আকাশপথে যেতে পারবেন ঘড়িঘর ভ্রমণ করতে। ঢাকা থেকে সিলেটের দূরত্ব প্রায় ২৪০ কিলোমিটার‌। সেখানে যেতে সময় লাগে প্রায় ৬-৮ ঘণ্টা পর্যন্ত।

ঢাকা থেকে বাসে সিলেট

ঢাকার ফকিরাপুল, গাবতলী, সায়েদাবাদ এবং মহাখালী বাস স্ট্যান্ড থেকে বাস ছেড়ে যায় সিলেটের উদ্দেশ্যে। বাসগুলো সাধারনত সকাল থেকে রাত ১২.৪৫ মিনিট পর্যন্ত তাদের ম্যানুয়ালি নির্দিষ্ট সময় পরপর তাদের যাত্রা শুরু করে।

গ্রীন লাইন পরিবহন, সৌদিয়া এস আলম পরিবহন, এনা ট্রান্সপোর্ট, শ্যামলি পরিবহনের, এসি বাসগুলোতে যেতে পারেন। এই বাসগুলোর ভাড়া হয়ে থাকে ৮০০-১২০০ টাকা পর্যন্ত। তবে নন এসি বাসে ক্ষেত্রে হানিফ এন্টারপ্রাইজ, শ্যামলী পরিবহন, ইউনিক সার্ভিস, এনা পরিবহনেও সিলেট যেতে পারেন। সেক্ষেত্রে ভাড়া হবে ৪০০-৫০০ টাকার মধ্যে। বাসে যেতে সময় লাগে প্রায় ৬-৮ ঘন্টা।

ট্রেনে ঢাকা থেকে সিলেট

ঢাকা থেকে সিলেট ট্রেনে গেলে সময় লাগে ৭-৮ ঘন্টা। ঢাকার কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে ছেড়ে যায় আন্তঃনগর ট্রেন পারাবত এক্সপ্রেস। মঙ্গলবার ছাড়া সপ্তাহের প্রতিদিন সকাল ৬:৪০ মিনিটে এই ট্রেনটি যাত্রা শুরু করে। সপ্তাহের প্রতিদিন জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস যাত্রা করে দুপুর ২ টায়। বুধবার ছাড়া সপ্তাহের প্রতিদিন রাত ৯.৫০ মিনিটে যাত্রা করে উপবন এক্সপ্রেস।শুক্রবার ছাড়া প্রতিদিন বিকাল ৪.০০ টায় ছাড়ে কালনী এক্সপ্রেস। সাধারণত ভাড়া হয়ে থাকে ৩২০ টাকা থেকে ১০৯৯ টাকা পর্যন্ত। ট্রেনে ভ্রমণের ক্ষেত্রে রাতে উপবন এক্সপ্রেসে গমন করাই ভালো। সকাল হতে হতে পৌঁছে যাওয়া যায় সিলেট। তাই রাত ৯.৫০ মিনিটে উপবন এক্সপ্রেস আপনার যাত্রা শুরু করে সারারাত ট্রেনে ঘুমিয়ে সকাল থেকেই আপনি সিলেটে আলী আমজদের ঘড়িঘর ভ্রমণ শুরু করতে পারবেন।

চট্রগ্রাম থেকে সিলেট

চট্রগ্রাম থেকে প্রতিদিন আন্তনগর পাহাড়িকা এক্সপ্রেস ও উদয়ন এক্সপ্রেস যাতায়াত করে আপনি চাইলে চট্রগ্রাম থেকে ট্রেনে সিলেট আসতে পারেন।

সিলেটের আলী আমজদের ঘড়ি
Ali Amjader Ghari

বিমানে সিলেট

আলী আমজদের ঘড়ি ঘর ভ্রমণের জন্য ঢাকা থেকে সবচেয়ে দ্রুত সিলেট যেতে পারবেন আকাশ পথে। ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ইউএস বাংলা, রিজেন্ট এয়ার,নভোএয়ার, ইউনাইটেড এয়ার, বিমান বাংলাদেশে করে সিলেটে যেতে পারবেন স্বল্প সময়ে। এক্ষেত্রে প্রতি সিটের জন্য বিমানের আসন অনুযায়ী টিকেটের মূল্য হতে পারে ৩,৫০০ থেকে ১০,০০০ টাকা পর্যন্ত।

কোথায় থাকবেন

সিলেটের বেশিরভাগ ভালো মানের হোটেল শাহজালাল (র.) এর মাজারকে ঘিরে অবস্থিত। সেখানে দরগাগেট, তালতলা, লামাবাগান, কদমতলী, তালতলা, আম্বরখানা ইত্যাদি স্থানে ভালো মানের আবাসিক হোটেল পাওয়া যায়। দরগা গেটে কম খরচে ৫০০ থেকে ১০০০ টাকায় মানসম্মত হোটেল পাওয়া যায়।

সিলেটের ভালো মানের আবাসিক হোটেলগুলো হলো- হলি ইন, লা ভিস্তা হোটেল, হোটেল হিল টাউন, হোটেল মেট্রো, সুরমা, ব্রিটানিয়া হোটেল, পানসি ইন, কায়কোবাদ, হোটেল হলি গেইট, ইন্টারন্যাশনাল ইত্যাদি। এ সকল হোটেলে খরচ হতে পারে ২০০০ থেকে ১০০০০ টাকা পর্যন্ত। এছাড়াও লালা বাজার এলাকায় মাত্র চারশত টাকা থেকে পাঁচশত টাকায় বিভিন্ন মানের হোটেলে থাকতে পারবেন।

কোথায় খাবেন

সিলেট শহরে খাবার খুব সহজে পাওয়া যায়, আপনি খাবার খেতে চাইলে জিন্দাবাজার এলাকার পানসী, পাঁচ ভাই, পালকি রেস্টুরেন্ট উল্লেখযোগ্য। এই রেস্টুরেন্ট গুলোতে সুলভ মূল্যে বিভিন্ন প্রকার ভর্তা, খিচুড়ি, মাংসের বিভিন্ন প্রকার বিরিয়ানি  পাবেন। জনপ্রতি সকালের নাস্তা খরচ হতে পারে ৫০-১০০ টাকা এবং দুপুরের খাবারে খরচ হতে পারে ১৫০-২০০ টাকা। এছাড়াও আপনার পছন্দমত বিভিন্ন রকমের খাবার সেখানে খেতে পূর্বেই দাম জেনে নিতে পারেন।

সিলেট জেলার অন্যান্য দর্শনীয় স্থান

প্রকৃতির রূপসোভার স্থান সিলেটের আলী আমজদের ঘড়িঘর ভ্রমণ এর পাশাপাশি আরও বেশ কিছু ভ্রমণ উপযোগী ও দর্শনীয় স্থান রয়েছে। যেমন- লালাখাল, ভোলাগঞ্জের সাদা পাথর, তামাবিল, জৈন্তাপুর, সংগ্রামপুঞ্জি ঝর্ণা বা মায়াবী ঝরনা, রাতারগুল, শাপলা বিল, জাফলং, বিছনা কান্দি, হযরত শাহ জালালের মাজার, হযরত শাহ পরানের মাজার, ফেঞ্চুগঞ্জ সার কারখানা, ক্রীন ব্রিজ, ডিমলেন্ড, জেনারেল উসমানি শিশু পার্ক, হযরত শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, মাধবকুন্ড জলপ্রপাত ইত্যাদি দর্শনীয় স্থান।

FAQ

আলী আমজদের ঘড়ি কোথায় অবস্থিত?
সিলেট শহরের প্রবেশদ্বারে সুরমা নদীর তীর ঘেঁষে ক্রীন ব্রিজের পার্শ্বে সিলেট সদর উপজেলায় অবস্থিত।

ঘড়িঘরের প্রতিষ্ঠাতা কে?
জমিদার আলী আহমদ খান।

কত সালে ঘড়ি ঘরটি নির্মান করা হয়?
১৮৭৪ সালে, ১৪৮ বছর আগে।

শেষকথা: আপনি যদি সিলেট শহর ভ্রমন করে থাকেন তাহলে, ইতিহাসের স্বাক্ষী আলী আমজদের ঘড়ি টি একবার হলেও দর্শন করুন।