অশ্বগন্ধার উপকারিতা ও অপকারিতা

অশ্বগন্ধা (Ashwagandha) একটি বহুগুণ সমৃদ্ধ উদ্ভিদ। প্রাচীনকাল থেকেই বিভিন্ন কবিরাজ, বৈদ, চিকিৎসক তাদের চিকিৎসায় অশ্বগন্ধার উপকারিতা গুলো প্রয়োগ করেছেন। মানবদেহের প্রতিটি অঙ্গের উন্নয়নে অশ্বগন্ধা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অবদান রাখে।

অশ্বগন্ধায় থাকা উপাদান, অশ্বগন্ধার উপকারিতা ও অপকারিতা, খাওয়ার নিয়ম ইত্যাদি বিষয় গুলো তুলে ধরা হলো এই আলোচনায়।

অশ্বগন্ধার ভেষজ উপাদান

প্রাচীনকাল থেকে অশ্বগন্ধা গাছের ফুল, পাতা, শিকড় ও বীজ আয়ুর্বেদিক ওষুধ তৈরি করার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। অশ্বগন্ধা একটি ভেষজ ওষুধ হিসেবে কাজ করে। অশ্বগন্ধার নির্যাসে এখনো পর্যন্ত ৩৫ ধরনের ফাইটোকেমিক্যাল উপাদান রয়েছে। তবে এর মধ্যে কিছু অন্যতম উপাদান হলো অ্যালকালয়েড, স্ট্রেরয়ডাল ল্যাক্টনস, ট্যানিনস, স্যাপোনিনস।

এই উপাদানগুলো যৌন ক্ষমতা সংক্রান্ত, ক্যান্সার, স্ট্রেস,প্রদাহ জনিত সমস্যা, বার্ধক্য জনিত সমস্যার বিরুদ্ধে লড়তে সাহায্য করে। এছাড়াও অশ্বগন্ধায় আরো উপস্থিত রয়েছে উইথানন, উইথাফেরিন এ, ডি, ই , উইথাননোলাইড হল বায়োঅ্যাক্টিভ পর্দাথ।

অশ্বগন্ধার উপকারিতা

আমাদের শরীরকে সুস্থ রাখতে অশ্বগন্ধার ভূমিকা অনেক। নিম্নে এর উপকারিতা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলোঃ

(১) ডায়বেটিস নিয়ন্ত্রণে

অশ্বগন্ধার মূল পাতার কোষে ফ্ল্যাবোনয়েডস নামক উপাদান রয়েছে। এই উপাদানটি ডায়াবেটিস রোগীদের দেহে ইনসুলিনের মাত্রা বাড়াতে সাহায্য করে। এছাড়াও অশ্বগন্ধার মূল ও পাতার রসে রয়েছে এন্টি – ডায়বেটিক উপাদান যা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।

(২) স্ট্রেস কমায়

অশ্বগন্ধার মধ্যে এনজাইলটিক নামক উপাদান রয়েছে। এই উপাদানটি মানুষের স্নায়ুতন্ত্রের উপর কাজ করে মানসিক ক্লান্তি দূর করতে সক্ষম হয়।

(৩) যৌন ক্ষমতা বাড়ায়

প্রাচীনকাল থেকে ছেলেদের যৌন সমস্যা দূর করতে অশ্বগন্ধা ব্যবহার করা হয়। অশ্বগন্ধা শরীরের প্রোজেস্টেরন ও টেস্টোষ্টেরণের পরিমান বাড়াতে সাহায্য করে। এই হরমন টি বৃদ্ধির ফলে যৌন মিলনের ইচ্ছা ও যৌন ক্ষমতা বাড়ে।

(৪) রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়

মানুষের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে অশ্বগন্ধার উপকারিতা ব্যাপক। অশ্বগন্ধায় রয়েছে এন্টি অক্সিডেন্ট ও এন্টি ইনফ্লেমেটরি উপাদান। এই উপাদান গুলো আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে।

(৫) ক্যান্সার প্রতিরোধ করতে

অশ্বগন্ধা ক্যান্সারের প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে। ক্যান্সারের কোষ গুলোকে ধ্বংস করতে সাহায্য করে। ক্যান্সার রোগীদের মধ্যে যাদের কেমোথেরাপি দিতে হয় তাদের শরীরকে কিছুটা উন্নত করতে পারে অশ্বগন্ধা। আয়ুর্বেদিক শাস্ত্রমতে পাতা ও মূলের নির্যাসে রয়েছে ফাইটোকেমিক্যালস যা কোষ গুলোকে ধ্বংস করতে ও কোষের রক্ত সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। এর ফলে ক্যান্সারের কোষগুলোকে প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়।

(৬) থাইরয়েড সমস্যায়

থাইরয়েডের সমস্যা দূর করতেও অশ্বগন্ধা সাহায্য করে। যাদের শরীরে থাইরয়েড হরমোনের পরিমাণ কম থাকে তারা এই অশ্বগন্ধা ব্যবহার করে উপকৃত হতে পারেন। কারণ অশ্বগন্ধা শরীরে থাইরক্সিন হরমোনের পরিমাণ বাড়ায়। যার ফলে যাদের থাইরয়েড সমস্যা রয়েছে তারা এটি সেবন করলে থাইরয়েড সমস্যা নিরাময় হবে।

(৭) ইনফেকশন সারাতে

অশ্বগন্ধার পাতা ও মূলে রয়েছে ইনফ্লেমেটরির মতো উপাদান। অশ্বগন্ধার এই উপাদান গুলো আমাদের বিভিন্ন ধরনের ইনফেকশন সারাতে সাহায্য করে।

আরও পড়ুন: মেথির উপকারিতা ও অপকারিতা। মেথির পুষ্ঠিগুণ

(৮) রক্ত চলাচল নিয়ন্ত্রণে

মানব দেহের রক্ত চলাচল নিয়ন্ত্রণ করতে অশ্বগন্ধা অনেক কার্যকরী। অশ্বগন্ধা সেবনের ফলে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক থাকে ও বিভিন্ন রোগ থেকে হৃদপিণ্ডকে রক্ষা করে।

(৯) চুলের যত্নে

আয়ুর্বেদ শাস্ত্র মতে চুলের যত্নে অশ্বগন্ধাকে অনেক উপকারী বলে মনে করা হয়। এটি চুল পড়া কমাতে, চুল মজবুত করতে, চুলের রুক্ষতা দূর করতে এবং অকালে চুল পাকা আটকাতে অনেক কার্যকরী একটি উপাদান।

(১০) ত্বকের যত্নে

ত্বকের যত্নেও অশ্বগন্ধা বেশ কার্যকরী একটি উপাদান বলে মনে করা হয়। অশ্বগন্ধা গাছের নির্যাস ত্বকের বার্ধক্যতার ছাপ পরতে দেয় না। এটি আপনার ত্বককে ভাঁজ পড়া থেকেও রক্ষা করবে।

এছাড়াও আরো বহু ক্ষেত্রেই অশ্বগন্ধার উপকারিতা রয়েছে।

অশ্বগন্ধা খাওয়ার নিয়ম

অশ্বগন্ধা খাওয়ার উপকারিতা
অশ্বগন্ধা

মানুষের জন্য অশ্বগন্ধা খাওয়ার উপকারিতা অনেক। এটি পৃথিবীতে সেরা ভেষজ উপাদান হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। অশ্বগন্ধা খাওয়ার নিয়ম নিচে তুলে ধরা হলোঃ

  • হালকা কুসুম গরম দুধের সাথে ৪-৫ গ্রাম অশ্বগন্ধার গুড়া ও মধু মিশিয়েও খেতে পারেন।
  • অশ্বগন্ধা ট্যাবলেটও পাওয়া যায়। প্রতিদিন রাতে একটি করে অশ্বগন্ধা ট্যাবলেট খেলে অনেক উপকার পাওয়া যাবে।
  • অশ্বগন্ধার মূল পানিতে ফুটিয়ে ঠান্ডা করে  খাওয়া যাবে।
  • এছাড়া অশ্বগন্ধার সিরাপ রয়েছে। আপনি চাইলে অশ্বগন্ধার সিরাপ সেবন করতে পারেন।
  • অশ্বগন্ধা গাছের সঙ্গে অ্যালকোহল মেশানো এক ধরনের ওষুধ পাওয়া যায়, যাকে অশ্বগন্ধর টিংচার বলা হয়। আপনারা এই টিংচারও সেবন করতে পারেন।
  • অশ্বগন্ধার মূল, দুধ,মধু এবং বাদামের মিশ্রণ ঘুমের টনিক হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। এতে মানসিক চাপ ও দুশ্চিন্তা কমবে।
  • অশ্বগন্ধার পাতার একটি পেস্ট বা মলমের প্রলেপ ক্ষতস্থানে দিলে দ্রুত ক্ষত সারাতে কার্যকরী।
  • মধুর সঙ্গে অশ্বগন্ধা মিশ্রিত করে ব্যবহার করলে যৌনস্বাস্থ্যের জন্য তা উপকারী হয়।

অশ্বগন্ধা গাছটি চেনার উপায়

অশ্বগন্ধা নামের অর্থ ঘোড়ার গন্ধ যা মূলের গন্ধকে বুঝায়। আসল অশ্বগন্ধা শনাক্ত করার জন্য এর গন্ধ শুকে দেখতে হয়। যখন এর গাছপালা চূর্ণ করা হয়, তখন যদি এটা থেকে ঘোড়ার প্রস্রাবের মতো গন্ধ পাওয়া যায়, তখন এটি আসল অশ্বগন্ধা হিসাবে বিবেচিত হয়। অশ্বগন্ধা গাছের দৈর্ঘ্য ৩৫ থেকে ৭৫ সেমি।

দুই প্রজাতির অশ্বগন্ধা হয়। যথা: জংলি ও সাধারন অশ্বগন্ধা। জংলি অশ্বগন্ধার পাতা কিছুটা মোটা হয়। অন্যদিকে সাধারণ অশ্বগন্ধার পাতা নরম ও পাতলা হয়। সাধারণ অশ্বগন্ধার লাল চেরির মত ফল হয়। এভাবে অশ্বগন্ধা গাছটি চেনা যাবে।

হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসায় অশ্বগন্ধার উপকারিতা

অশ্বগন্ধা হোমিওপ্যাথিক বিভিন্ন ধরনের রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। হোমিওপ্যাথিক মেডিসিনটি তৈরি করা হয় অশ্বগন্ধার মূল আরক ব্যবহার করে। হোমিওপ্যাথিতে অশ্বগন্ধা ব্যবহার করা হয় যে সকল ধরনের রোগ নিরাময়ের জন্য সেগুলোর নিচে তুলে ধরা হলোঃ

  • সব ধরনের যৌন সমস্যা দূর করে।
  • ইরেক্টাইল সমস্যা দূর করে।
  • প্রমেহ হওয়া দূর করে।
  • দ্রুত বীর্যপাতের সমস্যা দূর করে।
  • স্বপ্নদোষের সমস্যা দূর করে।

নারীদের জন্য অশ্বগন্ধার উপকারিতা

অশ্বগন্ধা ছেলেদের উপকারিতার পাশাপাশি মেয়েদের ক্ষেত্রেও অনেক উপকারিতা বয়ে আনে। নিয়মিত অশ্বগন্ধা ব্যবহার করলে যে সকল ধরনের উপকার পেতে পারেন সেগুলো নিচে তুলে ধরা হলোঃ

  • ত্বকের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি করে।
  • সন্তান জন্মদানের ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
  • ফিমেল হরমোন বৃদ্ধি করে।
  • ক্যান্সার প্রতিরোধ করে।
  • মাসিক ঋতুস্রাব নিয়মিত করে।
  • দুশ্চিন্তা,খিটখেটে ভাব এবং মানসিক চাপ কমাতে কার্যকরী।

পুরুষদের জন্য অশ্বগন্ধার উপকারিতা

অশ্বগন্ধা পুরুষদের জন্য অনেক ভালো ও উপকারি একটি ভেষজ উপাদান। বিভিন্ন কারণে পুরুষের প্রজনন ক্ষমতা কমছে বা কমে যাচ্ছে। তার মধ্যে রয়েছে মানসিক চাপ, বিশ্রামের অভাব, মধ্যপাণ ও ধূমপান এর অভ্যাসে যার কারণে দ্রুত হারে কমে যাচ্ছে শুক্রনুর সংখ্যা বা উৎপাদন। পুরুষদের ক্ষেত্রে অশ্বগন্ধার উপকারি দিকগুলো সম্পর্কিত তথ্য নিচে তুলে ধরা হলোঃ

  • পুরুষদের যৌন আকাঙ্ক্ষা বৃদ্ধি করে।
  • শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি করে।
  • যৌন শক্তি বৃদ্ধি করে।
  • শুক্রাণুর সংখ্যা বৃদ্ধি করে।
  • শরীরের টেস্টোস্টেরন হরমনের সংখ্যা বৃদ্ধি করে।
  • ইরেক্টাইল ডিফাংশনের চিকিৎসায় অনেক কার্যকরী।
  • মানসিক চাপ ও উদ্বেগ থেকে মুক্তি দেয়।

অশ্বগন্ধার অপকারিতা | ক্ষতিকর দিক

সবকিছুরি ভালো দিকের পাশাপাশি ক্ষতিকর দিক ও থাকে। তেমনি অশ্বগন্ধার উপকারিতার পাশাপাশি অপকারিতাও রয়েছে। তাই এই ভেষজ উপাদানটি গ্রহণের পূর্বে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে নিবেন। এর ক্ষতিকর দিকগুলো নিচে তুলে ধরা হলোঃ

  • গর্ভবতী মহিলাদের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা নিরাপদ নয়। অনেক সময় দেখা গিয়েছে যে পশুপাখিদের বেশি মাত্রায় ডোজ দেওয়ার ফলে তাদের গর্ভপাত অথবা সময়ের আগে বাচ্চা প্রসব হয়ে গিয়েছে।
  • দীর্ঘদিন অশ্বগন্ধা সেবনের ফলে বমি বমি ভাব, ডায়রিয়া ও গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা দেখা দেয়। সে ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদী সেবন না করাই উচিত।
  • অশ্বগন্ধা খেলে ঘুম ভালো হয়। সেক্ষেত্রে অশ্বগন্ধা খেলে ঘুমের ঔষুধ না খাওয়াই ভালো। আর বেশি প্রয়োজন পড়লে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে নিবেন।
  • অশ্বগন্ধা রক্তকে পাতলা করে। এক্ষেত্রে কোন অস্ত্র পাচার অথবা এই সম্পর্কিত কোন ঔষুধ গ্রহণ করলে সমস্যা হতে পারে। কারণ রক্ত পাতলা হওয়ার ফলে অনেক রক্তপাত হতে পারে যা অনেক মারাত্মক। সেক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করবেন।
  • বাচ্চাদের দুধ খাওয়ানো মায়েদের ক্ষেত্রে অশ্বগন্ধা ঔষুধ না খাওয়াই ভালো।
  • দীর্ঘদিন যাবত ব্যবহার করলে ঝিমিয়ে পড়া, ব্লাড প্রেসার কমে যাওয়া, শ্বাস প্রশ্বাস সংক্রান্ত সমস্যা ও অস্বাভাবিক হৃদস্পন্দনের সমস্যা দেখা দিতে পারে।

তাই নিয়ম মেনে সঠিক পরিমাণে অশ্বগন্ধা সেবন করা উচিত।

শেষকথা 

সুস্থ-সবল জীবন যাপনের জন্য অন্যতম গুণসম্পন্ন উদ্ভিদ হলো অশ্বগন্ধা। সঠিক নিয়মে সেবন/ ব্যবহার করলেই অশ্বগন্ধার উপকারিতা পাবেন। তবে এটি সেবনের ক্ষেত্রে সঠিক দিকনির্দেশনা অনুসরণ না করলে এর ক্ষতিকর দিক প্রতিফলিত হতে পারে।