ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর – যাবার উপায় ও ভ্রমন টিপস্

ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর (Bholaganj ‍sada pator) বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে সিলেট জেলার কোম্পানিগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত একটি ছোট গ্রাম। একদিকে দাঁড়িয়ে আছে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের উঁচু উঁচু পাহাড় অন্য দিকে ধলাই নদ, পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝর্নাধারা নদের পানির সাথে মিশে ভোলাগঞ্জকে অপরুপ সৌন্দর্যে পরিণত করেছে। মূলত পাহাড়ি পানি নদের পানির সাথে যোগ হয়ে সাদা পাথরের উপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়া ভোলাগেঞ্জের রুপের মূল উৎস।

একেবারে কাছে থেকে দেখলে মনে হয় উঁচু পাহাড় গুলো আকাশের মেঘের সাথে মিশে গেছে, এমন প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে যেতে কেই বা না চায়। প্রতিদিন দেশ-বিদেশ থেকে হাজার হাজার দর্শনার্থীরা এখানে আসেন এর আসল রুপ উপভোগ করতে। কেউ বা আবার সাদা পাথরের উপর দিয়ে প্রবাহিত পানিতে গা ভাসিয়ে দিয়ে অন্যন্য এক আনন্দ উপভোগ করেন। কেউ বা সাঁতার কাটেন, কেই ছবি তুলাতে ব্যস্থ থাকেন।

বর্তমানে ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর উৎপাদন, স্থাপত্য নকশা তৈরি, প্রাচীর ক্ল্যাডিং এবং কাউন্টারটপের মতো অলংকারিক নকশার বাহারি ডিজাইন দেখতে যায় সেখানে। এছাড়াও রয়েছে প্রকৃতি প্রেমীদের জন্য সেরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য।

ভোলাগঞ্জ পাথরের মূল উৎস

সাদা পাথর ভোলাগঞ্জ, সিলেট
ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর

ভোলাগঞ্জের শ্বেত পাথর, চুনা পাথর থেকে তৈরি হয় এবং এর রঙে আয়রন অক্সাইড মতো উপাদান নেই। ফলে এই পাথরের একটি বিশুদ্ধ সাদা আভা প্রকাশ পায়। এছাড়াও পাথরের স্থায়িত্ব অনেক বেশি এবং আবহাওয়ার সাথে মানানসই। তাই নির্মান কাজের জন্য এই পাথর অনেক বেশি চাহিদাসম্পন্ন।

ধলাই নদীর পানির সাথে ভারতের খাসিয়া জৈন্তিয়া পাহাড় থেকে প্রচুর পরিমাণে পাথর নেমে আসে। সেখান থেকে বাংলাদেশে পাথর উত্তোলন করা হয়। সেই পাথর উত্তোলনকে সহজ করতে ১৯৬৪-১৯৯৪ ইং পর্যন্ত রোপওয়ে নির্মান করা হয়। বর্তমানে তা আর ব্যবহৃত হচ্ছে না। রোপওয়ে ব্যবহৃত না হলেও ভোলাগঞ্জের পাথর উত্তোলন থেমে নেই।

স্থানীয় অনেক বাসিন্দাদের জীবিকা নির্বাহের প্রধান উৎস এই পাথর উত্তোলন। জিরো পয়েন্ট যাওয়ার পথে পাথর উত্তোলন ও ছোট ছোট নৌকায় পাথর বহনের এই দৃশ্য চোঁখে পড়বে। পরবর্তীতে এসব পাথর পক্রিয়া করে সারা দেশে নির্মাণ কাজের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়।

ভোলাগঞ্জ ভারত বাংলাদেশ সীমান্তে ১টি ল্যান্ড কাস্টম স্টেশন রয়েছে। এই স্টেশন দিয়ে প্রতিদিন শত শত ট্রাক চুনাপাথর বাংলাদেশে প্রবেশ করে।

কখন যাবেন ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর এলাকায়

বর্ষামৌসুম ও তার পরবর্তী কয়েক মাসের মধ্যে যাওয়াই উত্তম অর্থাৎ (জুন থেকে নভেম্বর) এই সময় গেলে ভোলাগঞ্জের আসল সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন। শীতকালে গেলে সেখানে সাদা পাথরের সৌন্দর্য দেখতে পাবেন কিন্তু নদী বা ছড়ায় পানির পরিমাণ কম থাকবে। আর শীতকালে সাদা পাথর এলাকায় নৌকা চলাচল বন্দ থাকে তখন পায়ে হেঁটে ঘুরে দেখতে হবে। পাশাপাশি জাফলং ও বিছনাকান্দি ঘুরে আসতে পারেন।

সিলেট থেকে কিভাবে ভোলাগঞ্জ যাবেন

সিলেট থেকে ভোলাগঞ্জ যাবার যোগাযোগ ব্যবস্থা অনেক ভালো। সিলেট থেকে ভোলগঞ্জ এর দূরত্ব ৩৫ কি.মি। দেশের যেখান থেকেই আপনি ভোলাগঞ্জ যেথে চান প্রথমে সিলেট শহরে আসতে হবে। সিলেট থেকে বাস, লেগুনা, সিএনজি বা প্রাইভেট কারে ভোলাগঞ্জ যাওয়া যায়।

ঢাকা থেকে বাসে সিলেট

ঢাকার গাবতলী, ফকিরাপুল, মহাখালী এবং সায়েদাবাদ বাস স্ট্যান্ড থেকে বাস ছেড়ে যায় সিলেটের উদ্দেশ্যে। বাসগুলো সাধারনত সকাল থেকে রাত ১২.৪৫ মিনিট পর্যন্ত তাদের ম্যানুয়ালি নির্দিষ্ট সময় পরপর তাদের যাত্রা শুরু করে।

গ্রীন লাইন পরিবহন, সৌদিয়া এস আলম পরিবহন, এনা পরিবহন, শ্যামলি পরিবহনের এসি বাসগুলোতে ভ্রমণ করতে পারেন। এই বাসগুলোর ভাড়া হয়ে থাকে ৮০০-১২০০ টাকা পর্যন্ত। তবে নন এসি বাসে ক্ষেত্রে শ্যামলী পরিবহন, ইউনিক সার্ভিস, এনা পরিবহনেও সিলেট যেতে পারেন। সেক্ষেত্রে ভাড়া হবে ৪০০-৫০০ টাকার মধ্যে। বাসে যেতে সময় লাগে প্রায় ৬-৮ ঘন্টা।

ঢাকা থেকে ট্রেনে সিলেট

ঢাকা থেকে সিলেটের ট্রেনে গেলে সময় লাগে ৭-৮ ঘন্টা।
ঢাকার কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে ছেড়ে যায় আন্তঃনগর ট্রেন পারাবত এক্সপ্রেস। সপ্তাহের প্রতিদিন জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস যাত্রা করে দুপুর ২ টায়। মঙ্গলবার ছাড়া সপ্তাহের প্রতিদিন সকাল ৬:৪০ মিনিটে এই ট্রেনটি যাত্রা শুরু করে। বুধবার ছাড়া সপ্তাহের প্রতিদিন রাত ৯.৫০ মিনিটে যাত্রা করে উপবন এক্সপ্রেস। শুক্রবার ছাড়া প্রতিদিন বিকাল ৪ টায় ছাড়ে কালনী এক্সপ্রেস। সাধারণত ভাড়া হয়ে থাকে ৩২০ টাকা থেকে ১০৯৯ টাকা পর্যন্ত।

ট্রেনে ভ্রমণের ক্ষেত্রে রাতে গমন করাই ভালো। সকাল হতে হতে পৌঁছে যাওয়া যায় সিলেট। তাই রাত ৯.৫০ মিনিটে উপবন এক্সপ্রেস আপনার যাত্রা শুরু করে সারারাত ট্রেনে ঘুমিয়ে সকাল থেকেই আপনার সিলেটে সাদা পাথরের ভোলাগঞ্জ ভ্রমণ শুরু করতে পারবেন।

আকাশপথে সিলেট

ভোলাগঞ্জ ভ্রমণ এর জন্য ঢাকা থেকে সবচেয়ে দ্রুত সিলেট যেতে পারবেন আকাশ পথে ভ্রমণের মাধ্যমে। ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ইউনাইটেড এয়ার, ইউএস বাংলা, রিজেন্ট এয়ার, নভোএয়ার করে সিলেটে যেতে পারবেন স্বল্প সময়ে। এক্ষেত্রে বিমানের ক্লাস অনুযায়ী টিকেটের মূল্য হতে পারে ৩৫০০ থেকে ১০০০০ টাকা পর্যন্ত।

চট্রগ্রাম থেকে সিলেট

ট্রগ্রাম থেকে ট্রেনে সিলেট যাওয়া যায়। পাহাড়িকা ও উদয়ন নামের দুটি ট্রেন সপ্তাহে ৬ দিন চলাচল করে।

ভোলাগঞ্জে কোথায় খাবেন

ভোলাগঞ্জ সাদাপাথর এলাকায় ভাত, মাছ, ভর্তা, পরটা-ভাজী ও স্থানীয় খাবার খাওয়ার মতো কিছু মানসম্মত হোটেল আছে। ভোলাগঞ্জ যাওয়ার পথে টুকের বাজারে আলম হোটেল, দেশবন্ধু রেস্টুরেন্ট, মায়া রেস্টুরেন্ট ও নবীন রেস্টুরেন্টসহ মোটামোটি মানের স্থানীয় লোকদের দ্বারা পরিচালিত কয়েকটি খাবারের হোটেল রয়েছে। ভোলাগঞ্জ সাদাপাথ এলাকায় যাত্রা শুরুর আগে সিলেট শহরে সকালের খাবার সেরে নিলে সিলেটে ফিরে এসে বিকালে/রাতের খাবার খেয়ে নিতে পারেন। তবে দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্য স্থানীয় হোটেলগুলোতে খেয়ে নিতে পারেন।

আপনি কি ভোলাগঞ্জ থাকতে চান

আপনি ভোলাগঞ্জ থাকতে হলে প্রথমে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় যেতে হবে। কোম্পানীগঞ্জের হালিমা বোর্ডিং, হোটেল আল ছাদিক, হোটেল আল হাসান, বাদশা বোর্ডিং এবং অন্যান্য মানসম্পন্ন নন-এসি আবাসিক হোটেল রয়েছে এবং কোম্পানিগঞ্জ জেলা পরিষদের একটি পোস্ট বাংলো রয়েছে। সেখানে থাকতে পারেন।

অথবা ভোলাগঞ্জ ঘুরে বিকেলে বা সন্ধ্যায় সিলেট শহরে ফিরে আসতে পারেন। সিলেট শহরেও থাকতে পারেন, সেখানে থাকার সু ব্যবস্থা রয়েছে । সিলেটের কয়েকটি আবাসিক হোটেলের তথ্য নিম্নরুপ:

হোটেলের নাম ও ভাড়া অবস্থান যোগাযোগ
হোটেল ময়রুন নেছা, ভাড়া প্রতিরাত ৩০০ টাকা থেকে শুরু দরগা গেইট, সিলেট, বাংলাদেশ ০১৭২৬ ৭৪৩৮৫২
হোটেল অনুপম দরগা গেইট, সিলেট, বাংলাদেশ ০১৭১১-৯৫০৭৫০
হোটেল সাফা আল মারওয়া (এসি- নন এসি), ভাড়া প্রতিরাত ৯০০ টাকা থেকে শুরু পূর্ব দরগা গেইট, সিলেট, বাংলাদেশ ০১৭৭৯-৭৩৭৪১৯
হোটেল দরগাহ ভিউ, ভাড়া প্রতিরাত ৫০০-১০০০০ টাকা পর্যন্ত দরগা গেইট, সিলেট, বাংলাদেশ +৮৮০৮২১-৭১৭০৬৬
হোটেল বাগদাদ লালবাজার, সিলেট, বাংলাদেশ ০১৭১২-১৭৬৬৮২

সতর্কতা ও সচেতনতা

  • পাথর এলাকায় পায়ে হাঁটার সময় খুবই সাবধান থাকবেন, যেন পাথরে পা পিছলে গিয়ে পা মছকাতে পারে।
  • পানির স্রোত বেশি থাকলে পানিতে নামবেন না, পানির ধাক্কায় পাথরে আঘাত  লেগে  আহত হতে পারেন।
  • অনুমতি ছাড়া অন্য কারো ভিডিও বা ছবি তুলা থেকে বিরত থাকবেন। অন্যতায় ঝামেলার মধ্যে পড়তে পারেন।
  • আপনি এমন কিছু করবেন না যার জন্য সাদা পাথর এলাকার পরিবেশ হুমকির মুখে পড়ে।
  • পরিবেশের ক্ষতি করে এমন জিনিস যেমন পলিথিন বা প্লাস্টিকের বোতল পর্যটন এলাকায় ফেলবেন না। আপনার আমার সকলের উচিত প্রকৃতির এই সৌন্দর্য বেঁচে থাকার সুযোগ দেওয়া।
  • পর্যটন এলাকাটি ভারতের সীমান্তে অবস্থিত তাই বর্ডারের একেবারে কাছে না যাওয়াই ভালো।
  • পর্যটন এলাকায় অবস্থানকালে বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড (বিজিবি) সদস্যদের নির্দেশনা মেনে চলুন।
  • আপনার সাথে থাকা মূল্যবান জিনিসপত্র সাবধানে রাখুন।
  • কেনাকাটা করার সময় দেখে শুনে দরদাম করে কিনুন।
  • সময়ের প্রতি লক্ষ রাখুন। সন্ধ্যা হলে ফিরে আসতে কষ্টকর হবে।
  • একদিনে ভোলাগঞ্জ পর্যটন এরিয়া, তুরাংছড়া ও উত্তমছড়া দর্শন করতে চান তবে খুব সকালে যাত্রা শুরু করতে হবে।

প্রশ্ন উত্তর পর্ব

সিলেট থেকে ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর এলাকার দূরত্ব কত কি.মি?

সিলেট থেকে ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর এলাকার দূরত্ব ৩৫ কি.মি।

ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর কোথায় অবস্থিত?

ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর সিলেট জেলার কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জ গ্রামে অবস্থিত।

শেষ কথা

ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর এলাকাটি ১টি গ্রুপ বা পরিবারের সবাইকে নিয়ে দর্শনের জন্য একটি চমৎকার স্থান। এলাকাটির সৌন্দর্য আপনাকে মুগ্ধতার অনুভূতি দেবে। সাদাপাথর এলাকায় এক দিনের ভ্রমনে আপনি সন্তুষ্ট থাকবেন। শুভ হোক আপনার ভ্রমণ।