লবঙ্গ (cloves), মসলা হিসেবে আমাদের দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় একটি নিত্য প্রয়োজনীয় উপাদান। তবে ঝাঁঝালো মসলা ছাড়াও নানান রোগ ব্যাধি থেকে মুক্তি পেতে লবঙ্গের উপকারিতা অনেক।
প্রাচীনকাল থেকেই সুস্থ থাকতে নানা রকম ঘরোয়া ভেষজ উপাদানের মধ্যে লবঙ্গের ব্যবহার ছিল লক্ষ্যণীয়। লবঙ্গে কি কি পুষ্টি উপাদান থাকে, লবঙ্গের উপকারিতা, খাওয়ার সঠিক নিয়ম, প্রতিদিন কতটুকু খেতে পারবেন এবং অতিরিক্ত লবঙ্গ খাওয়ার ক্ষতিকর দিকগুলো তুলে ধরা হয়েছে এই আলোচনায়।
লবঙ্গে কি কি পুষ্টি উপাদান আছে?
১০০ গ্রাম লবঙ্গতে থাকা বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান ও তার পরিমাণ নিচে তুলে ধরা হলোঃ
- প্রোটিন – ৩.২৭ গ্রাম
- কার্বোহাইড্রেট – ১০.৫১ গ্রাম
- ফাইবার – ৫.৪ গ্রাম
- পটাশিয়াম – ৩৭০ মিলিগ্রাম
- ক্যালসিয়াম – ৪৪ মিলিগ্রাম
- ফ্যাট – ০.১৫ গ্রাম
- ভিটামিন সি – ১১.৭ মিলিগ্রাম
- ভিটামিন ই – ০.১৯ মিলিগ্রাম
- শক্তি – ৪৭ কিলো ক্যালোরি
- সোডিয়াম – ৯৪ মিলিগ্রাম
- ম্যাগনেসিয়াম – ৬০ মিলিগ্রাম
- আয়রন – ১.২৮ মিলিগ্রাম
- ফোলেট – ৬৮ মাইক্রোগ্রাম
- ভিটামিন কে – ১৪.৮ মিলিগ্রাম
- কপার – ০.২৩১ মিলিগ্রাম
- জিংক – ২.৩২ মিলিগ্রাম
- ম্যাঙ্গানিজ – ০. ২৫৮ মিলিগ্রাম
- ফসফরাস – ৯০ মিলিগ্রাম
- ক্যারোটিন এ – ৮ মাইক্রোগ্রাম
- সেলেনিয়াম – ৭.২ মাইক্রোগ্রাম
- কোলেস্টেরল – ০ মিলিগ্রাম
এগুলো ছাড়াও লবঙ্গতে আরো অনেক ভিটামিন, মিনারেল ও অন্যান্য পুষ্টি উপাদান থাকে।
লবঙ্গের উপকারিতা
মানবদেহের জন্য উপকারিতা গুলো নিচে তুলে ধরা হলোঃ
(১) দাঁতের ব্যথা কমাতে লবঙ্গ
প্রায় সবরকম টুথপেস্টেরই একটি কমন উপকরণ হলো লবঙ্গ। লবঙ্গতে রয়েছে অ্যান্টি ইনফ্লেমেটরি উপাদান যা আমাদের দাঁতের যন্ত্রনা কমায়। এই উপাদানটি শরীরে প্রবেশ করার পর কিছু বিক্রিয়া করে আর বিক্রিয়ার ফলে নিমিষেই দাঁতের যন্ত্রণা কমে যায়। এছাড়াও লবঙ্গে এন্টিপ্লাক ও আন্টি জিনজিভাইটিস বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা আমাদের দাঁতকে সুস্থ রাখার জন্য অপরিহার্য। লবঙ্গ মুখের জীবনু প্রতিরোধে সাহায্য করে মাড়িতে সংক্রমণ এবং ব্যথা থেকেও মুক্তি দেয়।
(২) মাথা ব্যাথা ও যন্ত্রণা কমাতে লবঙ্গের ব্যবহার
মাথা ব্যথা কমাতে লবঙ্গের উপকারিতা অনেক। বেশি পরিমাণে রোদে যাওয়া, ঠাণ্ডা, ধোয়া ইত্যাদির কারণে শ্লেষ্মা বেড়ে যায়। যার ফলে মাথা ব্যাথা ও মাথার বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই মাথার ব্যথা থেকে উপশম পেতে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী নিয়মিত ও পরিমাণ মতো লবঙ্গ খাওয়া উচিত।
(৩) ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে
নিয়মিত লবঙ্গ খাওয়ার মাধ্যমে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। যাদের রক্তে বেশি মাত্রায় শর্করা রয়েছে তাদের জন্য লবঙ্গ একটি মহৌষধ। লবঙ্গ আমাদের শরীরের সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখে এবং আমাদের কর্মক্ষমতাকে বাড়িয়ে দেয়। এছাড়াও এটি আমাদের শরীরে ইনসুলিন তৈরিতে সাহায্য করে যার ফলে ডায়বেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকে।
(৪) হাড়ের সমস্যা দূর করতে
নারী-পুরুষ ও বয়স্কদের মধ্যে কমবেশি সকলেরই হাড়ের সমস্যা হয়ে থাকে। লবঙ্গে রয়েছে ফেনোলিক কম্পাউন্ড-ইউজিনল এবং ইউজিনল ডেরিভাটিভস। এটি আমাদের শরীরে প্রবেশ করার পর বোন-ডেনসিটির উন্নতি ঘটে। হাড়ের সমস্যা জনিত অনেক রোগের আশঙ্কা কমাতে এবং হাড় শক্ত করতে লবঙ্গের উপকারিতা অনেক।
(৫) পেটের সমস্যা দূর করতে
লবঙ্গ খেলে আমাদের দেহের মধ্যে অধিক পরিমানে এনজাইম তৈরী হয়। এটি আমাদের পেট ফাঁপা সমস্যা নিরাময় হয়। এছাড়াও পেটের আরো অনেক সমস্যা যেমন – পেটের গ্যাস, বদ হজম, পেট ব্যাথা, খিদে না হওয়া ও অজীর্ণ দূর হয়। এটি কলেরা বা আন্ত্রিক রোগেরও উপকার করে। লবঙ্গ আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য অনেক উপকারী একটি উপাদান।
(৬) কামোদ্দিপক ও যৌন সমস্যায়
কামোদ্দিপক ও যৌন রোগের জন্য লবঙ্গ অনেক উপকারী একটি উপাদান। এতে রয়েছে এন্টিঅক্সিডেন্ট ও এন্টি কার্সিনোজেনিক বৈশিষ্ট্যের স্নায়ু উপাদান, যা যৌনস্বাস্থ্য উন্নত করে। নিয়মিত লবঙ্গ খেলে যৌন স্বাস্থ্য ভালো থাকবে।
(৭) ব্রণ দূর করতে
ব্রণের চিকিৎসায় লবঙ্গের উপকারিতা রয়েছে। লবঙ্গে রয়েছে এন্টিঅক্সিডেন্ট ও অ্যান্টি ব্যাকটেরিয়াল বৈশিষ্ট্য যা ব্রণকে প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে। লবঙ্গের পেস্ট করে ব্রণের উপর দিয়ে রাখুন এতে ব্রনের দাগ ও ব্রণ দূর হয়ে যাবে।
(৮) স্ট্রেস কমাতে
লবঙ্গ প্রচুর স্ট্রেস ও উৎকণ্ঠা কমাতেও সাহায্য করে। সেজন্য লবঙ্গের চা খেতে পারেন অথবা ১/২ টি লবঙ্গ চুষে চুষে খেয়ে নিন। লবঙ্গ তেল সংবহনতন্ত্রকে উদ্দীপিত করে এবং মানসিক ক্লান্তিও কমাতে পারে। অনিদ্রা, স্মৃতিশক্তি হ্রাস, উদ্বেগ এবং বিষণ্নতা কমাতে লবঙ্গের উপকারিতা গুলো অনেক বেশি সহায়ক বলে প্রমাণিত।
কিসমিসের উপকারিতা ও অপকারিতা জানতে লিংকে ক্লিক করুন
(৯) হজমে সহায়তা করে
লবঙ্গ শরীরের এনজাইম গুলোকে উদ্দীপিত করে এবং পাচনতন্ত্রকে উন্নত করে। হজমে সহায়তা করে এমন এনজাইম নিঃসরণের ও অ্যাসিড ক্ষরণের মাধ্যমে লবঙ্গ আমাদের হজম ক্ষমতা সক্রিয় করে তোলে। শরীরের রক্ত প্রবাহেরও উন্নতি ঘটায়। বমি বমি ভাব, এরাফ্লাটুলেন্স, গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা, ডিসপেপসিয়া এবং নসিয়া কমাতে সাহায্য করে।
(১০) সর্দি কাশি নিরাময়ে লবঙ্গ
লবঙ্গের বৈশিষ্ট্যের মধ্যে আরো একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সর্দি ও কাশি থেকে সুরক্ষা। লবঙ্গে রয়েছে অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি বৈশিষ্ট্য। এর প্রভাবে সর্দি ও কাশি কমে যায়। প্রকৃতপক্ষে, এটি একটি কফের ওষুধের মতো কাজ করে, যা মুখ থেকে সমস্ত শ্লেষ্মা অপসারণ করে শ্বাস নালী পরিষ্কার করে।
লবঙ্গ ও মধু খেলে কি হয়?
প্রাচীনকাল থেকে লবঙ্গ ও মধু বিভিন্ন রোগের ঔষধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। মধু ও লবঙ্গের উপকারিতা/ নানারকম ঔষধি গুণাবলী রয়েছে অনেক। যা আমাদের শরীরকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। লবঙ্গ হচ্ছে ঝাঁঝালো স্বাদের এবং এটি একটি এন্টি-ব্যাকটেরিয়াল বৈশিষ্ট্যযুক্ত উপাদান। নিয়মিত লবঙ্গ খাওয়ার ফলে নানা রকম জীবাণুর সংক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
অন্যদিকে মধুও অনেক গুণাগুণ সম্পন্ন একটি উপাদান। নিয়মিত সুস্থ থাকতে চাইলে অবশ্যই মধু খাওয়ার বিকল্প নেই। এটি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতেও সাহায্য করে। বিশেষ করে ঠান্ডা জনিত সমস্যার জন্য মধু বিশেষ কার্যকরী একটি উপাদান। মধু ও লবঙ্গ একসাথে খেলে আরো অনেক বেশি উপকৃত হওয়া যায়। যেমন- মুখের ব্রণ দূর করে, গলা ব্যথা দূর করে, বমি বমি ভাব দূর করে, মুখের আলসার নিরাময় করে, ত্বকের যত্নে ব্যবহৃত হয় ইত্যাদি।
খালি পেটে লবঙ্গ খাওয়ার উপকারিতা
সকালে খালি পেটে লবঙ্গ খাওয়ার উপকারিতা অনেক। প্রতিদিন এক থেকে দুইটা লবঙ্গ খালি পেটে খেলে অনেক উপকৃত হওয়া যাবে। লবঙ্গ গাছের শুকনা ফুলকেই আমরা লবঙ্গ মসলা হিসেবে চিনি। লবঙ্গের তেল বেদনানাশক হিসেবে কাজ করে।
খালি পেটে লবঙ্গ খেলে নানারকম অসুখের আশঙ্কা কমে যায়। যেমন: পরিপাকতন্ত্রকে শক্তিশালি করে, দাঁত ভালো রাখে, হজম ক্ষমতা বৃদ্ধি করে, শ্বাসকষ্ট নিরাময় করে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে, কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে, হাড়ের ঘনত্ব বজায় রাখে, বমি বমি ভাব দূর করে এছাড়াও আরো অনেক উপকারে আসে।
রাতে লবঙ্গ খাওয়ার উপকারিতা
অনেক বেশি ঔষধি গুনাগুন থাকায় লবঙ্গের উপকারিতা যেকোনোভাবে সেবন করলেই পাওয়া যায়। প্রত্যেকদিন রাতে ঘুমানোর আগে এক গ্লাস গরম পানি ও ১টি লবঙ্গ খেলে, খুব সহজেই নানা রকম রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে। নিয়মিত লবঙ্গ খেলে গলার বিভিন্ন সমস্যা আর সংক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। যেমন :- বমি বমি ভাব, বদহজম, গ্যাস জনিত সমস্যা, হাঁপানি, কলেরা, মাথাব্যথা ও সর্দি-কাশি থেকে ও উপসম পাওয়া যাবে।
চিবিয়ে লবঙ্গ খাওয়ার উপকারিতা
প্রতিদিন সকালে অথবা রাতে খালি পেটে লবঙ্গ চিবিয়ে খাওয়ার অনেক উপকারিতা রয়েছে। খালি পেটে দুটি করে লবঙ্গ চিবিয়ে রস খান অথবা লবঙ্গ চুষে চুষে খান। এতে করে আপনার পেট পরিস্কার, মাথাব্যথা, গলা ব্যথা বা গলা ফুলে উঠা, শ্বাসকষ্ট, কোষ্ঠকাঠিন্য, বদহজম ও সর্দি-কাশি ইত্যাদি রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
লবঙ্গ বেশি পরিমাণে খাওয়া যাবে কি?
প্রতিদিন লবঙ্গের গুড়া ১ থেকে ২ গ্রাম খাওয়া যাবে। লবঙ্গ তেল ১ থেকে ৩ ফোটা ব্যবহার করা যাবে। অথবা, দৈনিক সম্পূর্ণ লবঙ্গ ১/২ টা খাওয়া যাবে। অকারনে মুখে লবঙ্গ পুরে রাখা এটি স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। তাই চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী লবঙ্গ নিয়মিত খাওয়া প্রয়োজন।
লবঙ্গ খাওয়ার নিয়ম
সাধারণত আমরা লবঙ্গ কে মসলা হিসেবেই ব্যবহার করে থাকি। এছাড়াও একটি ঔষধি গুনাগুন সম্পন্ন উপাদান। তাই অন্যভাবে লবঙ্গের উপকারিতা পেতে খাওয়ার নিয়ম নিচে দেয়া হলোঃ
- মধুর সঙ্গে লবঙ্গ মিশিয়ে খাওয়া যায়।
- লবঙ্গ গরম পানিতে ফুটিয়ে খাওয়া যায়।
- লবঙ্গ মুখে চিবিয়ে খাওয়া যায়।
- চায়ের পানি গরম করার সময় ৪/৫ টা লবঙ্গ দিয়ে চা খেলে সর্দি কাশি ও গলা ব্যথা থেকে উপশম পাওয়া যায়।
- খালি পেটে লবঙ্গ খেলে বেশি উপকার পাওয়া যায়।
লবঙ্গের অপকারিতা | ক্ষতিকর দিক
প্রত্যেকটা খাবার বা উপাদানের ভালো ও খারাপ দিক রয়েছে। যেকোনো খাবারই পরিমাণের চেয়ে বেশি পরিমাণে গ্রহণ করলে শরীরে বিভিন্ন ক্ষতিকর প্রভাব দেখা দিতে পারে। লবঙ্গের কিছু ক্ষতিকর দিকগুলো হলোঃ
- অতিরিক্ত পরিমাণে লবঙ্গের তেল শরীরে ব্যবহার করলে এলার্জি সমস্যা দেখা দিতে পারে।
- পরিমানের চেয়ে বেশি লবঙ্গ খেলে শরীরের রক্ত পাতলা হয়ে যেতে পারে।
- অতিরিক্ত পরিমাণে লবঙ্গ খেলে হাইপারগ্লাইসেমিয়ার সমস্যা হতে পারে।
শেষকথা
শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে সুস্থ থাকতে চাইলে, নিয়মিত লবঙ্গ খাওয়া অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে। স্বাস্থ্য সচেতন হিসেবে লবঙ্গের উপকারিতা গুলো আমাদের গ্রহণ করা উচিত। তবে অতিরিক্ত মাত্রায় লবঙ্গ সেবন থেকে বিরত থাকুন।