ডিজিটাল প্রযুক্তি কি? ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার, প্রয়োগ ও সুবিধা-অসুবিধা

ডিজিটাল প্রযুক্তি (Digital Technology) মানব সভ্যতার ইতিহাসে এক নতুন দ্বার উন্মোচিত করেছে। বর্তমান বিশ্বের বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত করতে এবং আমাদের সকল কাজকে সহজ ও কম পরিশ্রমের করতে প্রযুক্তি অপরিহার্য। বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় সপ্তম শ্রেণীর পাঠ্যবই গুলোর সাথে ‘ডিজিটাল প্রযুক্তি বই’ সংযুক্ত করা হয়েছে। অতি পরিচিত এই ডিজিটাল প্রযুক্তি কি এবং কোন ডিভাইস গুলোকে ডিজিটাল প্রযুক্তি বলা হয় সে সম্পর্কে ধারণা রাখা সকলের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ।

তাই ডিজিটাল প্রযুক্তি কি, কাকে বলে, কয়েকটি ডিজিটাল প্রযুক্তির নাম, ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার, প্রয়োগ ও সুবিধা-অসুবিধা সমূহ জেনে নিতে পারেন এই লেখা থেকে।

ডিজিটাল প্রযুক্তির (Digital technology) ইতিহাস

প্রাচীনকাল থেকেই মানুষের মাঝে নানান প্রযুক্তির উদ্ভাবন শুরু হয়েছিল। আধুনিককালে সেই প্রযুক্তির উদ্ভাবনে নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে ডিজিটাল টেকনোলজি। বেল ল্যাবস গণিতবিদ ‘ক্লদ শ্যানন’, তাঁর অগ্রণী ১৯৪৮ প্রবন্ধে, যোগাযোগের গাণিতিক তত্ত্বে ডিজিটালাইজেশনের ভিত্তি স্থাপন করার জন্য কৃতিত্বপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। পরবরর্তীতে, ডিজিটাল বিপ্লব প্রযুক্তিকে এনালগ ফরম্যাট থেকে ডিজিটাল ফরম্যাটে রূপান্তরিত করেছে।

১৯৮০ -এর দশকে ডিজিটাল বিপ্লব শুরু হওয়ার পর থেকে, এনালগ ইলেকট্রনিক এবং মেকানিক্যাল ডিভাইস থেকে পরিবর্তিত হয়ে ডিজিটাল প্রযুক্তিতে অগ্রগামী হয়েছে। পৃথিবীব্যাপী ডিজিটাল প্রযুক্তির প্রসার লাভ করছে সর্বত্রই। বাংলাদেশেও ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে রূপকল্প ২০২১ বাস্তবায়নের ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। তার মূল শিরোনাম ছিল ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’। ১২ ডিসেম্বর ২০০৮ তারিখে ডিজিটাল বিপ্লবের ঘোষণা আসে। তারপর থেকে বাংলাদেশ ডিজিটাল বাংলাদেশের পথে অগ্রগামী হয়েছে প্রতিমুহূর্তে।

ডিজিটাল প্রযুক্তি কি? ডিজিটাল প্রযুক্তি বলতে কি বুঝায়?

গণনাকারীর দক্ষতা ও আধুনিক ক্ষমতা সম্পন্ন প্রযুক্তিই হলো ডিজিটাল প্রযুক্তি। মূলত ডিজিটাল শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ হলো- গণনাকারী বা গণনা করা। তাই আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে গণনা বা কম্পিউটার সম্পর্কিত পদ্ধতিগুলোকেই ডিজিটাল প্রযুক্তি বলা যায়।

এই প্রযুক্তি মূলত বিভিন্ন ইলেকট্রনিক টুল, সিস্টেম, ডিভাইস এবং রিসোর্স, যা ডেটা তৈরি, সঞ্চয় বা প্রক্রিয়া করে থাকে। ভিন্নভাবে বলতে গেলে, ডিজিটাল প্রযুক্তি হলো এমন একটি প্রযুক্তি, যার সাহায্যে কোন কাজ কম পরিশ্রমে সহজেই সম্পাদন করা যায় এবং কাজের ফলাফলকে আধুনিক রূপ দেওয়া যায়।

পারিপার্শ্বিকভাবে আমরা ডিজিটাল প্রযুক্তি বলতে, বর্তমানে আধুনিক কালে যে সকল ডিভাইস উদ্ভাবন করা হচ্ছে সেগুলোকে বুঝে থাকি। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সকল প্রকার আধুনিক যন্ত্রপাতি ডিজিটাল প্রযুক্তি নয়। বরং কম্পিউটার ভিত্তিক বা সংখ্যাভিত্তিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে এমন ডিভাইস গুলোই ডিজিটাল প্রযুক্তি। বর্তমান পৃথিবীর সম্পূর্ণ রূপেই ডিজিটাল প্রযুক্তির উপর নির্ভরশীল হয়ে উঠছে। ছোট থেকে বড় কিংবা ব্যক্তিগত থেকে আন্তর্জাতিক সর্বত্রই এই প্রযুক্তি অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।

ডিজিটাল প্রযুক্তি কাকে বলে?

যে সকল প্রযুক্তি সংখ্যা ভিত্তিক কোন দক্ষতা, কৌশল এবং প্রক্রিয়ার সমষ্টি ব্যবহারের মাধ্যমে দ্রুত হিসাবকার্য করতে সক্ষম এবং বিভিন্ন প্রকার পণ্য পরিষেবা ও উদ্দেশ্য পূরণের কাজের ব্যবহৃত হয়, সেগুলোকে ডিজিটাল প্রযুক্তি বলে। উদাহরণস্বরূপ: সোশ্যাল মিডিয়া, অনলাইন গেমস, মাল্টিমিডিয়া এবং মোবাইল ফোন ইত্যাদি ফিজিকাল প্রযুক্তি।

ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার

জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই এখন ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে লক্ষ্য করা যায়। এর ব্যবহার ছাড়া পৃথিবীতে নেমে আসতে পারে প্রায় ১০০ বছর আগের পৃথিবীর মতো তথ্যহীনতার হাহাকার। আধুনিককালে ডিজিটাল টেকনোলজির বিস্তৃতি যে কত বেশি, তা শুধুমাত্র এর ব্যবহার ও উপকারিতা সমূহ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমেই অনুধাবন করা সম্ভব। এই প্রযুক্তির কয়েকটি প্রধান ব্যবহারিক ক্ষেত্র হলো:

  • এই প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে দ্রুত যোগাযোগ এবং কম খরচে প্রয়োজনীয় তথ্য স্থানান্তর করা যায়।
  • বিনা পরিশ্রমে এবং যাতায়াতের পরিশ্রম দূর করে ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম সম্পন্ন করার সকল ক্ষেত্রেই ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয়।
  • নাগরিকের সেবা নিশ্চিত করতে সরকারি বিভিন্ন সংস্থার কাজগুলো আরো সহজে কী করে পাওয়া যায় তার জন্য এখন ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করা হচ্ছে। বিভিন্ন ওয়েবসাইট বা মোবাইল অ্যাপস ব্যবহার করে শহর থেকে গ্রাম পর্যায়ে সাধারণ নাগরিকেরাই এখন নাগরিক সেবা নিচ্ছেন।
  • নিজেদের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রও আমরা ডিজটাল মাধ্যম ই-কমার্স ব্যবহার করে হাতের নাগালে পাচ্ছি।
  • এই প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রকার কমান্ড দিয়ে আধুনিক প্রযুক্তিগুলো নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
  • সামাজিক যোগাযোগের উন্নয়নে ব্যবহৃত হয়।
  • যেকোন তথ্য আদান-প্রদান এবং সেই তথ্য স্থায়ীভাবে সংরক্ষণের নির্ভরযোগ্য মাধ্যম ডিজিটাল প্রযুক্তি।
  • ডিজিটাল প্রযুক্তিই সত্যিকার অর্থে, মানুষের নানান কাজে ফলপ্রসূ উদ্ভাবনের নিশ্চয়তা দেয়।

কয়েকটি ডিজিটাল প্রযুক্তির নাম

পৃথিবীতে এখন লক্ষাধিক ডিজিটাল প্রযুক্তি নানা দেশের নানাভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এর মধ্যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ডিজিটাল টেকনোলজিগুলো হলো:

মোবাইল ফোন/ স্মার্টফোন, কম্পিউটার, ল্যাপটপ, ডেস্কটপ, হার্ডওয়্যার, সফটওয়্যার, ওয়াইফাই, মডেম, রাউটার, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI), মেশিন লার্নিং (ML), ব্লকচেইন, ইন্টারনেট অফ থিংস (IoT), ভার্চুয়াল বাস্তবতা (VR), অগমেন্টেড রিয়েলিটি (AR), সাইবার নিরাপত্তা প্রযুক্তি, ক্লাউড কম্পিউটিং, বিগ ডেটা, ডেটা বিশ্লেষণ, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং, রোবোটিক্স, 5G প্রযুক্তি, প্রাকৃতিক ভাষা প্রক্রিয়াকরণ (NLP), এজ কম্পিউটিং, স্বায়ত্তশাসিত যানবাহন, ক্রিপ্টোকারেন্সি, বায়োমেট্রিক প্রমাণীকরণ, পরিধানযোগ্য প্রযুক্তি, স্মার্ট গ্রিড প্রযুক্তি ইত্যাদি।

এছাড়াও রয়েছে- ভয়েস সহকারী (যেমন, Siri, Alexa), চ্যাটবট, কম্পিউটার ভিশন, ড্রোন (মানবহীন আকাশযান), স্মার্ট হোম প্রযুক্তি, 3D প্রিন্টিং, ন্যানো প্রযুক্তি, ওয়্যারলেস চার্জিং, অঙ্গভঙ্গি নিয়ন্ত্রণ প্রযুক্তি, ডিজিটাল টুইনস, ডিজিটাল স্বাস্থ্য প্রযুক্তি, সাপ্লাই চেইন প্রযুক্তি, রিমোট সেন্সিং, বায়োটেকনোলজি, নবায়নযোগ্য শক্তি প্রযুক্তি, ডিজিটাল ওয়ালেট, স্মার্ট ফার্মিং প্রযুক্তি, কোয়ান্টাম এনক্রিপশন, হিউম্যানয়েড রোবট, কম্পিউটার-এইডেড ডিজাইন (CAD), মিক্সড রিয়েলিটি, ফিনটেক (আর্থিক প্রযুক্তি) ইত্যাদি।

ডিজিটাল প্রযুক্তির গুরুত্ব

মানবজীবনের ডিজিটাল প্রযুক্তির গুরুত্ব রয়েছে অনেক। এই প্রযুক্তি যোগাযোগ, সহযোগিতা, বিষয়বস্তু ব্যবস্থাপনা, বিশ্লেষণ ডেটা অ্যাক্সেস এবং সামাজিক নেটওয়ার্কিং উন্নত করতে সাহায্য করতে পারে। স্টাফ এবং গ্রাহকের অভিজ্ঞতা একটি নতুন পদ্ধতি এবং ইন্টারঅ্যাক্টিভিটির সাথে উন্নত হয়েছে।
ডিজিটাল প্রযুক্তির সুবিধা ও অসুবিধা
প্রাথমিক জীবনে আমরা নানাভাবে ডিজিটাল প্রযুক্তির আওতায় এসে গেছি। তবে এর বহু উপকারিতা ও ব্যবহারিক প্রয়োগের পাশাপাশি কিছু নেতিবাচক দিকও রয়েছে। নিচে ডিজিটাল প্রযুক্তির সুবিধা ও অসুবিধা সমূহ তুলে ধরা হলো:

ডিজিটাল প্রযুক্তির সুবিধা সমূহ

  • যেকোন কাজ দ্রুত এবং কম পরিশ্রমে সম্পন্ন করা যায়।
  • যেকোন সময় যেকোন স্থান থেকে তথ্য অ্যাক্সেস করা যায়।
  • প্রচুর পরিমাণে ডেটা সংক্ষিপ্তভাবে এবং নিরাপদে সংরক্ষণ করা যায়।
  • বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে তাৎক্ষণিক এবং বিশ্বব্যাপী যোগাযোগের সুবিধা পাওয়া যায়।
  • প্রচলিত পদ্ধতির তুলনায় ডিজিটাল টুলের খরচ কম।
  • স্বয়ংক্রিয় কাজ এবং কর্মপ্রবাহের মাধ্যমে প্রক্রিয়াগুলোকে স্ট্রীমলাইন করা যায়৷
  • ব্যক্তিগত পছন্দ অনুযায়ী সেবা এবং পণ্য পাওয়া যায় সহজেই।
  • পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তের দূরত্বে ব্যক্তি বা দলের মধ্যে নিরবচ্ছিন্ন সহযোগিতা করতে সক্ষম।
  • ক্রমাগত উদ্ভাবন এবং নতুন প্রযুক্তির বিকাশকে উৎসাহিত করে এই ডিজিটাল টেকনোলজি।
  • ডিজিটাল সিস্টেম সহজেই বর্ধিত চাহিদা বা ব্যবহারের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারে।
  • কাগজ এবং ভৌত সম্পদের প্রয়োজনীয়তা হ্রাস করে।
  • ভৌগলিক ব্যবধান দূর করে, বিশ্বব্যাপী মানুষ এবং ধারণাকে সংযুক্ত করে।
  • তথ্যের স্থায়িত্ব নিশ্চিত করে।
  • অবসর এবং বিনোদনের জন্যও রয়েছে বিস্তৃত ডিজিটাল সামগ্রী।
  • ইন্টারেক্টিভ এবং বিভিন্ন শিক্ষামূলক সম্পদের মাধ্যমে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার কার্যক্ষমতা বাড়ায়।

ডিজিটাল প্রযুক্তির অপব্যবহার ও অসুবিধা সমূহ

  • ডিজিটাল ডিভাইসের উপর অত্যধিক নির্ভরতার ফলে মানুষের ঐতিহ্যগত দক্ষতা এবং স্বয়ংসম্পূর্ণতা লোপ পাচ্ছে।
  • হ্যাকিং, ডেটা লঙ্ঘন এবং সাইবার হুমকির সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
  • অতিরিক্ত স্ক্রীন টাইম চোখের চাপ সৃষ্টি করে, অনিদ্রা এবং অন্যান্য শারীরিক সমস্যায় অবদান রাখে।
  • বর্ধিত ডিজিটাল মিথস্ক্রিয়া মুখোমুখি যোগাযোগ এবং সামাজিক বিচ্ছিন্নতা হ্রাস করছে।
  • শিক্ষা, কাজের সুযোগ এবং তথ্য অ্যাক্সেসে বৈষম্য তৈরি করে।
  • ডিভাইস থেকে ইলেকট্রনিক বর্জ্য এবং শক্তি নিঃসরণের ফলে পরিবেশগত অবনতি হচ্ছে।
  • ধ্রুবক সংযোগের ফলে মানুষের মনোযোগের স্প্যান কমে যায় এবং উৎপাদনশীলতা কমে যায়।
  • ডিজিটাল প্রযুক্তির অতিরিক্ত নজরদারি এবং ডেটা সংগ্রহের ফলে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা এবং স্বায়ত্তশাসনের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
  • অটোমেশন এবং AI এর অগ্রগতির ফলে কিছু পেশার মানুষ চাকরি হারাচ্ছে বা স্থানচ্যুত হচ্ছে।
  • প্রযুক্তিগত ত্রুটির ফলে দৈনন্দিন জীবনে নানান জটিলতার সৃষ্টি হচ্ছে।

বর্তমানে ডিজিটাল প্রযুক্তির বেশ কিছু অসুবিধা বা নেতিবাচক দিক থাকলেও এটি আমাদের দৈনন্দিন ব্যবহারের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে। তাই চাইলেও এর ব্যবহার ও প্রয়োগ বন্ধ করা সম্ভব নয়।

শেষকথা

আধুনিক প্রযুক্তির ডিজিটালাইজেশন আমাদের জীবনযাত্রার মানকে কয়েক ধাপ এগিয়ে নিয়েছে। কিন্তু এর ভালো প্রভাবের পাশাপাশি নেতিবাচক প্রয়োগও রয়েছে বিশ্বব্যাপী, যা মানবজাতির জন্য হুমকিস্বরূপ। তাই এর অপব্যবহার গুলো এড়িয়ে মানব সভ্যতার উন্নয়নের জন্য প্রাত্যহিক কর্মকাণ্ডে ডিজিটাল প্রযুক্তি গুলো ব্যবহার করা উচিত।