মানবসভ্যতার বিকাশ সাধন হচ্ছে তার নিজস্ব গতিতে। বর্তমানে মানুষ শুধু স্থলেই বিশাল বিশাল ইমারত নির্মাণে সীমাবদ্ধ নেই। বরং মহাসমুদ্রে ভ্রমণের জন্য তৈরি করছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় জাহাজগুলো। এমনি একটি জাহাজ নিয়েই আজকের আলোচনা। সমুদ্রের বুকে ভেসে বেড়ানো বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম জাহাজ হারমনি অফ দ্য সিস সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারবেন এই লেখাতে।
হারমনি অফ দ্য সিস
Harmony of the seas: হারমনি অফ দ্য সিস পৃথিবীর বৃহত্তম জাহাজ গুলোর মধ্যে একটি। বর্তমানে এটি বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম ক্রুজ জাহাজ হিসেবে বিবেচিত হয়। এটি নিজেই একটি ভাসমান শহর এবং এর মধ্যে রয়েছে নানান বিনোদন পার্কের সংমিশ্রণ। ক্যারিবিয়ানের সুন্দর নীল সমুদ্রের মধ্য দিয়ে এটি তার গন্তব্য ভ্রমণ করে। সাধারন বোর্ডিং পাসের পরিবর্তে এই জাহাজে “ওয়াও ব্যান্ড”, এর ব্রেসলেট দেওয়া হয়। এই ব্রেসলেটটি অর্থপ্রদানের মাধ্যম এবং কেবিন-কী হিসেবেও ব্যবহৃত হয়।
হারমনি অফ দ্য সিসের আয়তন
এই জাহাজটি একটি সামুদ্রিক দৈত্য। এর যাত্রী ধারণ ক্ষমতা ৬৭৮০ জন। টাইটানিকের চেয়েও ৩০৬ ফুট বড় বিস্ময়কর এই জাহাজটি। এটি ১১৮৮ ফুট দৈর্ঘ্য এবং ২১৫.৫ ফুট প্রস্থের। তুলনামূলকভাবে এটি প্রায় দশতলা উঁচু ভবনের সমান।
এছাড়াও এতে রয়েছে ১৮টি ডেক আর চারটি ফুটবল খেলার মাঠ। এর ওজন প্রায় ২ লাখ ২৭ হাজার টন।
হারমনি অফ দ্য সিস এর নির্মাণকালীন তথ্য ও যাত্রা শুরুর ইতিহাস
২০১৩ সালে জাহাজটির নির্মাণ কাজ শুরু হয়। মোট ২ হাজার ৫০০ জন শ্রমিক এই জাহাজ নির্মাণে কাজ করেছেন। এটি নির্মাণে সময় লেগেছিল প্রায় তিন বছর। রয়েল ক্যারিবিয়ান ইন্টারন্যাশনাল নৌবহরের ২৫ তম জাহাজ ছিল ‘হারমনি অফ দ্য সিস’। এটি নির্মাণ করতে খরচ হয়েছে ৮০০ মিলিয়িন পাউন্ড, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৯ হাজার ৬০০ কোটি টাকা।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় যাত্রীবাহী জেট এয়ারবাস A380 -এর তুলনায় এই জাহাজটি প্রায় ১০ গুণ বেশি যাত্রী বহন করতে সক্ষম। দ্রুতগামী এ জাহাজটি ঘণ্টায় ২৫ কিলোমিটার বেগে দ্রুত ছুটতে পারে। এর চারিদিকে স্বচ্ছ কাঁচের দেয়াল, মাঝে মাঝে পরিস্কার স্টিল যা চোখ জুড়িয়ে দেয়।
হারমোনি অফ দ্য সিস ফ্রান্সের সেন্ট-নাজাইরি থেকে ১৭ মে সকাল ৬ টায় লন্ডনের ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়ে সাউদাম্পটনে পৌঁছেছে। উৎসুক জনতা জাহাজটি দেখতে ভিড় জমিয়েছে। এতে আছে ২০টি ক্যান্টিন, ২৩টি সুইমিংপুল, ৫২টি গাছ, ক্যাসিনো, মদের দোকান, ২৭৪৭ টি কেবিন ও নানান সুযোগ-সু্বিধা। জাহাজের নাবিক আছে ২১০০ জন।
আরও পড়ুন: ওয়ান্ডার অব দ্য সিস – বিশ্বের সবচেয়ে বড় জাহাজ
সেখান থেকে ২০১৬ সালের মে মাসের ২২ তারিখ রটারড্যামের উদ্দেশ্যে প্রথম আনুষ্ঠানিক যাত্রায় এটি সাউথহ্যাম্পটন ছাড়ে। প্রথম যাত্রায় সমুদ্র উপকূলের নান্দনিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে হাজার হাজার মানুষ ভিড় করেছে। শরৎকালে জাহাজটির রুট হবে যুক্তরাষ্টের ফ্লোরিডা হয়ে ভূমধ্যসাগরের কাছাকাছি দেশগুলো। আর শীতকালে ক্যারিবিয়ান দেশগুলো।
এই জাহাজটি ৭৭টি দেশ থেকে যাত্রী তুলতে পারবে। এটি এমন একটি জাহাজ যা শুধু যাত্রীই বহন করে না, সমুদ্রের সৌন্দর্য্যও বাড়ায়। এর নিরাপত্তায় রয়েছে বিপুল সংখ্যক পুলিশ। এতে একা এক সপ্তাহ ভ্রমণে খরচ পড়বে ১ লাখ ২ হাজার টাকা আর পরিবারসহ ৩ লাখ ১৪ হাজার টাকা।
হারমোনি অফ দ্য সিস স্টেটরুম
এ জাহাজটিতে প্রবেশ করা মাত্রই যেকোনো যাত্রীর মনে হবে যে, সে স্বপ্নের জগতে রয়েছে। এই জাহাজটিতে ২ হাজার ৭৫৯টি স্টেটরুম রয়েছে। সেইসঙ্গে ২৮টি বারান্দা রয়েছে। যেন রুমে বসেই যাত্রীরা সাগরের সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে পারে। এতে রয়েছে মোট ১৮টি ডেক। যার মধ্যে ১৬টি ডেকে রয়েছে ২ হাজার ৭৪৭টি কেবিন। দুই তলা বিশিষ্ট এই জাহাজের সিগনেচার রুমটিকে বলা হয় “রয়েল লফট স্যুট”। রয়েল লফট স্যুটের প্রথম তলাতে রয়েছে ১৬০০ স্কয়ার ফুটের একটি লিভিং স্পেস। অন্যদিকে ২য় তলাটি ৮৭৪ স্কয়ার ফুটের। দুটি মিলিয়ে ২৪৭৪ স্কয়ার ফুট। শহরের বড় যে কোনো বড় অ্যাপার্টমেন্টের চেয়েও অনেক বেশি বড়।
এখানের কেবিনগুলির মৌলিক সুবিধাগুলির মধ্যে রয়েছে টেলিভিশন, টেলিফোন, ঝরনা সহ ব্যক্তিগত বাথরুম, ড্রেসিং টেবিল এবং হেয়ার ড্রায়ার। পরিচিত কেবিন বিভাগগুলি ছাড়াও, হারমনি অফ দ্য সিস উদ্ভাবনের সাথে স্কোর করে যেমন ভিতরের কেবিনে ভার্চুয়াল ব্যালকনি এবং একা ভ্রমণকারীদের জন্য স্টুডিও কেবিন। এছাড়াও স্যুট গেস্টদের জন্য ডেডিকেটেড এলাকা রয়েছে, যেমন একটি স্যুট লাউঞ্জ এবং একটি ফুল-সার্ভিস পুল ডেক।
হারমনি অফ দ্য সিস এর রেস্তোরাঁ
হারমনি অফ দ্য সিস একটি ভ্রমণ জাহাজ। তাই এখানে ছুটি কাটাতে আসা যাত্রীদের আনন্দ গ্রহণে যেনো কোন অসুবিধা না হয় সেদিকে কঠোরভাবে খেয়াল রাখা হয়। বিশ্বের ৮০ টি দেশ থেকে ২ হাজার ১০০ জন কর্মচারী যাত্রীদের সেবায় নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। জাহাজের সবচেয়ে এক্সক্লুসিভ কেবিনে যারা থাকবেন তাদের সেবায় থাকবে রয়েল জেনিস উপাধির খানসামা। এরা অতিথিদের মালপত্র খুলতে ও গোছাতে অতিথিদের সহযোগিতা করবে।
ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ বা ডিনার নিয়ে অতিথি বা যাত্রীদের কোনো চিন্তা নেই। এই জাহাজটিতে ২০টি ডাইনিং অপশন ও বার রয়েছে। খাবারের মধ্যে রয়েছে হটডগ থেকে শুরু করে সুশি পর্যন্ত। জাহাজটিতে খোলা হয়েছে একটি বায়োনিক বার। যেখানে রোবটরা কাস্টমারদের চাহিদা অনুযায়ী ককটেলও বানিয়ে দেবে।
হারমনি অফ দ্য সিস এর বিনোদন, খেলাধুলা এবং বিশ্রাম
বছরের সবচেয়ে দর্শনীয় আকর্ষণগুলির সমন্বয়ে হারমনি অফ দ্য সিস বিভিন্ন রকম বিনোদন দিয়ে থাকে। যেমন: কমেডি ক্লাব, আইসক্রিম রিভিউ এবং ব্রডওয়ে-স্টাইল শো, অ্যাকোয়া থিয়েটারে অ্যাক্রোবেটিক পারফরম্যান্স বা ক্যাসিনো রয়্যালে একটি গেম ইত্যাদি। এছাড়াও রয়েছে বিশ্রামের জন্য সী স্পা-এর অনেকগুলি ক্লাস এবং অত্যাধুনিক সরঞ্জাম সহ ফিটনেস সেন্টার, বোর্ডওয়াক, জনপ্রিয় ওয়েসিস ক্যারোসেল ইত্যাদি ৷
এখানে আপনি সমুদ্রের দীর্ঘতম স্লাইডের মাধ্যমে হুইজ করতে পারবেন। আলটিমেট অ্যাবিস টি ৩০ মিটারেরও বেশি লম্বা। এটি জাহাজের স্ট্রেনে পুল এবং স্পোর্টস জোনে শুরু হয়ে এবং ১০টি ডেকের উপরে বোর্ডওয়াকের দিকে নিয়ে যায়। জাহাজের মাঝখানে পানি সুপারসেল, টাইফুন এবং ঘূর্ণিঝড় বাতাসকে একসাথে স্লাইড করে পারফেক্ট স্টর্ম গঠন করে। এছাড়াও শিশুদের জন্য রয়েছে বেশ কয়েকটি স্লাইড এবং বহু খেলনা সামগ্রী।
শিশু এবং কিশোর-কিশোরীদের জন্য এখানে আলাদা স্থান রয়েছে। সেখানে তারা তাদের বয়সের অন্যদের সাথে খেলতে পারে, ঘোরাঘুরি করতে পারে এবং অ্যাডভেঞ্চারের অভিজ্ঞতা নিতে পারে। জাহাজের মাঝখানে অবস্থিত সেন্ট্রাল পার্কে রয়েছে সাড়ে দশ হাজারের বেশি উদ্ভিদ, ৪৮টি অাঙুরগাছ ও ৫২টি বড় গাছ। এগুলোর কোনো কোনোটি ২০ ফুট পর্যন্ত লম্বা।
শেষকথা
বিংশ শতাব্দীর সেই টাইটানিককে পিছনে ফেলে বর্তমানে তৈরি হচ্ছে আরব বৃহৎ সমুদ্র-প্রমোদকারী জাহাজ। সত্যিই সেগুলো যেন সমুদ্রের বুকে একটি সম্পূর্ণ শহর। অতিরিক্ত ব্যয়বহুল হওয়া সত্ত্বেও, হারমনি অফ দ্য সিস জাহাজে একবার ভ্রমণ করা, যেন নতুন দিগন্তে একটি অপরূপ শহরকে ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়া।