সিলেট শহরের একটি আধ্যাত্মিক স্থাপনা হচ্ছে শাহ পরান (রঃ) এর মাজার। শাহ পরান (রঃ) এর মাজার সিলেট শহরের পূর্ব দিকে খাদিম পাড়া বর্তমান নাম খাদিম নগর এলাকায় একটি টিলার উপরে অবস্থিত। ১৩০৩ খ্রিস্টাব্দে মধ্যপ্রাচ্য হতে বাংলাদেশে আসা হযরত শাহ জালাল (রঃ) এর অন্যতম অনুসারী ও ভাগ্নে ছিলেন হযরত শাহ পরান (রঃ)। হযরত শাহ জালাল (রঃ) এর মাজার থেকে হযরত শাহ পরান (রঃ) এর মাজার ৮ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।
স্থানীয় বাসিন্দাদের তথ্যমতে হযরত শাহ পরান (রঃ) এর মাজার টিলায় ওঠা নামার জন্য তৈরি সিরিটি হচ্ছে মোগল আমলে নির্মিত। সেখানে মোগল স্থাপত্য রীতিতে নির্মিত একটি মসজিদ রয়েছে মাজারের পশ্চিম দিকে।
হযরত শাহ পরান (রঃ) এর বয়স যখন ১১ বছর তখন উনার পিতা ইন্তেকাল করেন। পরবর্তীতে তিনি দ্বীনি ধর্ম শিক্ষার লাভ করেন তার আত্মীয় প্রখ্যাত সুফি দরবেশ সৈয়দ আহমদ কবির (রহঃ) এর কাছে। হযরত শাহ পরান (রঃ) আধ্যাত্মিক শিক্ষা লাভের জন্য নেশাপুরের বিখ্যাত দরবেশ পাগলা আমিন (রহঃ) এর শরণাপন্ন হন। সেখান থেকে তিনি আধ্যাত্মিক শিক্ষায় দীক্ষিত হন। সে সময় শাহ পরান (রঃ) তার মামা শাহ জালাল (রঃ) এর সঙ্গী হয়ে হিন্দুস্তানে এসে ইসলাম প্রচার শুরু করেন।
হযরত শাহ পরান (রঃ) এর মাজার এর বর্ণনা
বাংলাদেশের সিলেট শহরের পূর্ব দিকে খাদিম পাড়া বা খাদিম নগর এলাকায় টিলার উপর একটি বিশাল বৃক্ষের নিচে রয়েছে শাহ পরান (রঃ) এর মাজার। মাজার টিলায় ওঠা নামার জন্য উত্তর ও দক্ষিণ দিকে সিঁড়ি রয়েছে যেগুলো প্রায় ৮ থেকে ১০ ফুট উঁচু দেখায়। লোকমুখে শোনা যায় সিঁড়িগুলো মোগল আমলে নির্মাণ করা হয়েছিল। মোগল বাদশাহদের স্থাপত্য কীর্তিতে নির্মিত মাজারের পশ্চিম পাশে একটি তিন গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ রয়েছে। প্রায় পাঁচশত মুসল্লী এই মসজিদটিতে একসাথে নামাজ আদায় করতে পারেন।
হযরত শাহ পরান (রঃ) এর মাজার থেকে প্রায় ১৫-২০ ফুট দক্ষিণ-পশ্চিমে রয়েছে মহিলাদের জন্য আলাদা একচালা বিশিষ্ট দালান ঘর। ওই দালানের মধ্যে অল্প পরিসরে দক্ষিণ পূর্ব দিকে আরেকটি ঘর রয়েছে। এই ঘরটিকে বিদেশি পর্যটকদের জন্য বিশ্রামাগার হিসেবে তৈরি করা হয়েছে। ঘরটির পাশেই রয়েছে একটি বিশাল পুকুর যা ওযু ও গোসলের জন্য ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
হযরত শাহ পরান (রঃ) এর জীবনী ও অলৌকিক ঘটনা
হযরত শাহ পরান (রঃ) এর মাজার তৈরি হবার পিছনে উনার জীবনী ও বেশ কিছু অলৌকিক ঘটনা লক্ষণীয়। মূলত শাহজালাল (রঃ) দিল্লি থেকে সিলেট আসার সময় নিজাম উদ্দিন আউলিয়া প্রদত্ত এক জোড়া কবুতর (সিলেটি ভাষায় কৈতর) সঙ্গে নিয়ে আসেন।
কবুতর জোড়া গুলো সিলেটে নিয়ে আসার পর বংশবৃদ্ধি পেতে থাকে এবং শাহ জালাল (রঃ) এর কবুতর বলে জালালী কৈতর নামে খ্যাত হয়। ধর্মীয় অনুভূতির কারণে এই কবুতর কেউ শীকার করত না। শাহ পরান (রঃ) এই বিষয়টি আমলে না নিয়ে, প্রতিদিন একটি করে কবুতর খেতেন। কবুতরের সংখ্যা কম দেখে শাহা জালাল (রঃ) অনুসন্ধানে মূল ঘটনা জেনে রুষ্ট হন।
এই কথাগুলো শাহ পরান (রঃ) জানতে পেরে গোপন করে রাখা মৃত কবুতরের লোম বা পালক হাতে উঠিয়ে বাতাসে উড়িয়ে দিয়ে বললেন, আল্লাহর হুকুমে কবুতর হয়ে শাহ জালালের কাছে পৌঁছে যাও। সাথে সাথে লোম বা পালক গুলো এক ঝাক কবুতর হয়ে শাহ জালালের কাছে পৌঁছে গেল। শাহ জালাল তার ভাগ্নে শাহ পরান (রঃ) ডেকে বললেন, তোমার অলৌকিক শক্তি দেখে আমি সন্তুষ্ট হয়েছি।
কিন্তু এভাবে প্রকাশ্যে কেরামত প্রকাশ করা সঠিক নয়। সব মানুষের বুঝ শক্তি একরকম হয় না। এভাবে কেরামত প্রকাশ করার ফলে মানুষ ভুল বুঝতে পারে বা আমাদের সম্পর্কে ভুল ধারণা বা ভুল ব্যাখ্যা দিতে পারে। এরপর শাহ পরান (রঃ) কে খাদিম পাড়া বা খাদিম নগর এলাকায় ইসলাম প্রচারের জন্য পাঠিয়ে দেন। শাহ পরান (রঃ) খাদিম নগরে ইসলাম প্রচারে তার জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত নিজেকে নিয়োজিত রাখেন।
হযরত শাহ পরান (রঃ) এর মাজার কিভাবে যাবেন
সিলেট থেকে মাজারে
সিলেট শহরের যে কোন প্রান্ত থেকে সিএনজি, রিকশা বা অটো রিক্সা করে খুব সহজেই হযরত শাহ পরান (রঃ) এর মাজার দর্শনে যেতে পারবেন।
ঢাকা থেকে মাজারে
ঢাকার সায়েদাবাদ বা গাবতলী বাস স্ট্যান্ড থেকে সিলেটের বাস ছেড়ে যায় । ফকিরাপুল, মহাকালী সায়েদাবাদ বাস স্টেশন থেকে এস আলম,গ্রীন লাইন, শ্যামলী, সৌদিয়া ও এনা পরিবহনের এসি বাস যাতায়াত করে। এই বাসগুলোর সিট ভাড়া ১২০০ থেকে ১৪০০ টাকার মধ্যে। ঢাকা থেকে সিলেটে যেতে নন এসি বাস গুলোর মধ্যে শ্যামলী, এনা, হানিফ ও ইউনিক পরিবহনের জনপ্রতি ভাড়া ৫০০ থেকে ৫৭০ টাকা পর্যন্ত ।
ঢাকা থেকে আকাশ পথে ও সিলেট যাওয়া যায় খুব দ্রুত সময়ে। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বিমান বাংলাদেশ, ইউএস বাংলার বিমান এবং নভোএয়ার নিয়মিতভাবে সিলেটের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়।
ট্রেনে করেও ঢাকা থেকে সিলেটে যেতে পারবেন। বিমান বন্দর কিংবা কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন হতে কালনী, উপবন, পারাবত ও জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস ট্রেনের মাধ্যমেও যেতে পারবেন।
সিলেট শহরে যাওয়ার পর সেখান থেকে সিএনজি, রিকশা অথবা অটো রিক্সা করে হযরত শাহ পরান (রঃ) এর মাজারে যেতে পারবেন।
আরও পড়ুন: হযরত শাহ জালাল (র:) মাজার, সিলেট – ভ্রমন টিপস্
কোথায় থাকবেন
সিলেট শহরে থাকার জন্য সেখানে বিভিন্ন মানের আবাসিক হোটেল রয়েছে। সবচেয়ে বেশি হোটেলের সংখ্যা হচ্ছে শাহ জালাল মাজার গেইট ও লালা বাজার এলাকায়। এখানকার হোটেল গুলোতে বিভিন্ন মানের রুম রয়েছে ৪০০ থেকে ৩০০০ টাকা পর্যন্ত ।
সিলেট শহরের উল্লেখযোগ্য হোটেল গুলোর মধ্যে রয়েছে হোটেল দরগা গেইট এবং এবং দরগা গেইটের হোটেল স্টার প্যাসিফিক, ভিআইপি রোডে অবস্থিত হোটেল হিল টাউন, বন্দর বাজারে অবস্থিত হোটেল মেট্রো ইন্টারন্যাশনাল, লিংক রোডের হোটেল গার্ডেন ইন, শাহজালাল উপশহরে অবস্থিত হোটেল রোজ ভিউ, নাইওর পুলের হোটেল ফরচুন গার্ডেন, জেল সরকে অবস্থিত হোটেল ডালাস, তালতলায় অবস্থিত হোটেল গুলশান সেন্টার ইত্যাদি আরও অনেক হোটেল রয়েছে সিলেট শহরে। গুরুত্ব হোটেল গুলোতে স্বাচ্ছন্দ্যে অবস্থান করে হযরত শাহ পরান (রঃ) এর মাজার ঘুরে আসতে পারেন।
খাবারের ব্যবস্থা
রাত্রি যাপনের জন্য যে হোটেল গুলো ভাড়া নেয়া হবে সেখানেও খাবারের ব্যবস্থা থাকে। তাছাড়া সিলেট শহরের জিন্দাবাদ এলাকায় বেশ কিছু জনপ্রিয় রেস্টুরেন্ট রয়েছে যেমন রয়েল শেফ, পানসি, স্পাইসি, পাঁচ ভাই, ভোজন বাড়ি ও প্রীতি রাজ রেস্টুরেন্ট উল্লেখযোগ্য। সিলেটের জনপ্রিয় সাতকরা বা হাত করা এবং আথুনি পোলাও খেয়ে দেখতে পারেন ।
ভ্রমন টিপস
- স্থানীয়ভাবে বিভিন্ন সাশ্রয়ী সিলেট ভ্রমণ ট্রিপের ব্যবস্থা থাকলে তা গ্রহণ করা অধিক সুবিধা জনক।
- হযরত শাহপরান (রঃ) এর মাজারের পাশাপাশি একই সাথে সিলেটের আরো বেশ কিছু দর্শনীয় স্থান, যেমন- জাফলং, বিছানাকান্দি, রাতারগুল, সংগ্রামপুঞ্জি ঝর্ণা, লালাখাল, হাকালুকি হাওর, ভোলাগঞ্জ ইত্যাদি স্থান ঘুরে আসতে পারেন।
- যাতায়াত, থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা সম্পর্কে পূর্ব ধারণা রাখুন।
- মাজারের অভ্যন্তরীণ এলাকায় নির্দেশনা মেনে চলুন।
হযরত শাহ পরান (রঃ) এর মাজার সম্পর্কে সচরাচর জিজ্ঞেসিত প্রশ্নোত্তর (FAQ’s)
হযরত শাহ পরান (রঃ) কোথায় জন্মগ্রহণ করেন?
হযরত শাহ পরান (রঃ) ইয়েমেনের হাদ্রামাউত এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন।
হযরত শাহ পরান (রঃ) কোথায় মৃত্যুবরণ করেন?
তৎকালীন খাদিম পাড়া বর্তমান নাম খাদিম নগর, সিলেটে হযরত শাহ পরান (রঃ) মৃত্যুবরণ করেন।
হযরত শাহপরান (রঃ) এর মাজার কোথায় অবস্থিত?
বাংলাদেশের সিলেট জেলাশহরের পূর্ব দিকে থাকা খাদিমনগর এলাকার বড় একটি টিলার (ছোট পাহাড়ের) উপরে হযরত শাহপরান (রঃ) এর মাজার অবস্থিত।
শেষকথা: প্রতিদিন ওলী আউলিয়া প্রেমিকদের মিলন মেলায় পরিণত হয় হযরত শাহ পরান (রঃ) এর মাজার। সিলেট ভ্রমন বা অন্য প্রয়োজনে আসলে শাহ পরান (র.) মাজার জিয়ারত করে যেতে পারেন।