হিমালয় পর্বতমালা (Himalaya Mountains) আমাদের কাছে বিশাল এক বিস্ময়। বিশ্বের সর্বোচ্চ ও সর্বাপেক্ষা নবীন পর্বতশ্রেণী হচ্ছে হিমালয় পর্বতমালা। এটি কোনো একক শ্রেণী বা মালা নয়, এটি একটি ধারাবাহিক শ্রেণী যা একে অন্যের সমান্তরাল ধারায় লম্বা দূরত্ব স্থাপন করেছে। হিমালয় পর্বতমালা শুধু বিশালই নয় সে অপরূপ সুন্দরও। হিমালয় পর্বত এশিয়ার একটি পর্বতমালা যা তিব্বতীয় মালভূমি থেকে ভারতীয় উপমহাদেশকে পৃথক করেছে। এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পর্বতমালা।
হিমালয় পর্বতমালার বিস্তার
এশিয়া মহাদেশের ১৫ হাজার মাইল জুড়ে বিস্তৃত এই হিমালয় পর্বতমালা। এই একটি অঞ্চলে অবস্থিত পৃথিবীর সর্বোচ্চ ১৪ টি উঁচু পর্বত। ভারত, নেপাল, আফগানিস্তান, চীন, ভুটান ও পাকিস্তান এই ছয়টি দেশে হিমালয়ের অংশ রয়েছে।হিমালয় পর্বতমালা থেকে বিশ্বের তিনটি প্রধান নদী ব্রহ্মপুত্র,সিন্ধু ও গঙ্গা তাদের বিভিন্ন প্রধান ও অপ্রধান উপনদী সহ উৎপন্ন হয়েছে। সমভূমি থেকে সারিবদ্ধ ভাবে উচ্চ থেকে আরো উচ্ছে উঠে গেছে হিমালয় এর শ্রেণী আর অভ্রবেদি চূড়াশৃঙ্গ যেগুলোর মধ্যে রয়েছে বিখ্যাত মাউন্ট এভারেস্ট (৮,৮৪৮ মিটার), মাউন্ট k2 (৮,৬১০ মিটার ) ইত্যাদি।
হিমালয় ও অন্যান্য মধ্য এশিও পর্বত পৃথিবীর ছাদ অর্থাৎ পামির মালভূমি থেকে উৎপন্ন হয়ে বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে গেছে।পামীর মালভূমি থেকে হিমালয় ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তর, পশ্চিম ও পূর্ব দিক বেষ্টন করে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে বিস্তৃত হয়েছে। এই পর্বতশ্রেণীর পূর্বাঞ্চল পশ্চিমাঞ্চলের তুলনায় সংকুচিত এবং পরস্পরের খুব কাছাকাছি। এর ফলে আচমকা এগুলো সর্বোচ্চ উচ্চতায় উঠে গেছে। এ কারণেই এগুলোর তুষার আবৃত শৃঙ্গগুলো, যেমন কাঞ্চনজঙ্ঘা বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল থেকে দৃশ্যমান। হিমালয়ের প্রধান প্রধান শ্রেণীমালা আফগানিস্তান ও মায়ানমারের সীমান্ত মধ্যবর্তী প্রায় ৩০০০ কিমি স্থান জুড়ে বিরাজমান।
হিমালয় পর্বতমালার মধ্যে উল্লেখযোগ্য পর্বত শৃঙ্গ গুলো দেওয়া হল
১. মাউন্ট এভারেস্ট
চীন ও নেপাল সীমান্তে অবস্থিত বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ হচ্ছে মাউন্ট এভারেস্ট। মাউন্ট এভারেস্ট অর্থ- সাগর মাতা, চোমোলংমা বা কোমোলংমা, “মহাবিশ্বের মাতা”। এই এভারেস্টের উচ্চতা ৮,৮৪৮ মিটার বা ফুট ২৯,০২৮। ১৯৫৩ সালে এই এভারেস্টে প্রথম মানুষ আহরণে গিয়েছিল।
২. কে-2
কে- 2 হচ্ছে বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পর্বত শৃঙ্গ। এই পর্বতটি পাকিস্তান ও চীনের জিনজিয়ান সীমান্তে অবস্থিত। বিপদজনক পর্বতের মধ্যে অন্যতম এই পর্বতটি আহরণের জন্য। K2 অর্থ – চাগো গাংরি। পর্বতের উচ্চতা হচ্ছে ৮৬১১ মিটার আর ফুট ২৮,২৫১। ১৯৫৪ সালে এই পর্বতে প্রথম আহরণ হয়েছিল।
৩. কাঞ্চন জঙ্ঘা
বিশ্বের তৃতীয় সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ হচ্ছে কাঞ্চনজঙ্ঘা। ভারতের সর্বোচ্চ (সিকিম) এবং নেপালের সর্বোচ্চ দ্বিতীয় পর্বত শৃঙ্গ। ১৯৫৫ সালে এই পর্বতে প্রথম আহরণ হয়েছিল। কাঞ্চন জঙ্ঘা অর্থ – তুষারের পাঁচ রত্ন। কাঞ্চনজঙ্ঘার উচ্চতা ৮,৫৮৬ মিটার আর ফুট ২৮,১৬৯।
৪. লোৎসে
পৃথিবীর চতুর্থ উচ্চতম পর্বত শৃঙ্গ হচ্ছে লোৎসে। এটি নেপাল ও তিব্বতের মধ্যে এভারেস্টের ছায়াতে অবস্থিত। ১৯৫৬ সালে এই শৃঙ্গে প্রথম আহরণ হয়েছিল। লোৎসে অর্থ- “দক্ষিন শৃঙ্গ”। এই শৃঙ্গের উচ্চতা ৮,৫১৬ মিটার আর ফুট ২৭,৯৪০।
৫. মাকালু
হিমালয় পর্বতমালার অন্তর্ভুক্ত বিশ্বের পঞ্চম সর্বোচ্চ শৃঙ্গ হচ্ছে মাকালু। এটি নেপালে অবস্থিত। ১৯৫৫ সালে এই শৃঙ্গে প্রথম আহরণ হয়েছিল। মাকালু অর্থ -মহান কাল। এই শৃঙ্গের উচ্চতা ৮,৪৬২ মিটার আর ফুট ২৭,৭৬৫।
৬. চো ওইয়ু
চো ওইয়ু পৃথিবীর ষষ্ঠ পর্বত শৃঙ্গ। এটি নেপালে অবস্থিত। চো ওইয়ু অর্থ -বৈদূর্য দেবতা। প্রথম আহরণ হয়েছিল ১৯৫৪ সালে। শৃঙ্গের উচ্চতা ৮,২০১ মিটার আর ফুট ২৬,৯০৫।
৭. ধবলগিরি
নেপালে অবস্থিত বিশ্বের ৭ম সর্বোচ্চ শৃঙ্গ। ধবলগিরি অর্থ শ্বেতো পর্বত । ১৯৬০ সালে প্রথম আহরণ হয়েছিল। এর উচ্চতা ৮,১৬৭ মিটার আর ফুট ২৬,৭৬৪।
৮. মানাসলু
অর্থ – কুতাং,”আত্মার পর্বত”। এটি অষ্টম সর্বোচ্চ শৃঙ্গ। গোরখা হিমাল নেপালে অবস্থিত। ১৯৫৬ সালে প্রথম আহরণ হয়েছিল। এর উচ্চতা ৮১৫৬ মিটার, ফুট ২৬,৭৫৮।
৯. নাঙ্গা পর্বত
নাঙ্গা পর্বতের অর্থ – দিয়ামীর,” নগ্ন পর্বত “। এটি বিশ্বের সর্বোচ্চ নবম পর্বতশৃঙ্গ পাকিস্তানে অবস্থিত। প্রথম আহরণ ১৯৫৩ সালে আর পর্বতটি আহরণের জন্য বিপদজনকের অন্যতম। এর উচ্চতা ৮১২৫ মিটার,ফুট ২৬,৬৫৮।
১০. অন্নপূর্ণা
বিশ্বের দশম সর্বোচ্চ শৃঙ্গটি নেপালে অবস্থিত। অন্নপূর্ণা অর্থ- “শস্য দেবী”। ১৬৫০ সালে প্রথম আহরণ হয়েছিল। এর উচ্চতা ৮,০৯১ মিটার, ফুট ২৬,৫৪৫।
এগুলো ছাড়াও আরো পর্বত রয়েছে যেমন -গাসারব্রুম ১, ব্রড পিক, গাসারব্রুম ২,শিশা পাংমা ও নন্দা দেবী উল্লেখযোগ্য।
হিমালয় পর্বতমালায় অবস্থিত উদ্ভিদ
গ্রীষ্মমন্ডলীয় মৌসুমি বনাঞ্চলের গাছপালা থেকে আদ্র, স্যাঁতসেঁতে ও শুষ্ক পর্ণমোচী শাল বনের গাছপালার পার্থক্য লক্ষণীয়। হিমালয় পর্বতের যে অংশ বঙ্গোপসাগর থেকে আসা মৌসুমি বায়ুর আওতার মধ্যে সেখানে গাছ-গাছালি অনেক বেশি, যেমন সিকিম। আবার মরুভূমির দেখা পাওয়া যায় কুনার ও সিন্ধু উপত্যকায়। উপত্যকাময় অঞ্চলে কৃষিকাজ চলছে এবং যেদিকে ঢাল অল্প সেখানে পশুুচারণ ভূমি গড়ে উঠেছে।
হিমালয় পর্বতমালার নদ নদী
ভৌগলিকভাবে হিমালয় পর্বত পাকিস্তানের গিলগিটে সিন্ধু নদী থেকে শুরু করে ভারত, পূর্ব ভারত, ভুটান, নেপাল তিব্বত হয়ে দক্ষিণ-পূর্ব তিব্বতে ব্রহ্মপুত্র নদের দক্ষিনাঞ্চলীয় বাঁক পর্যন্ত বিপুল স্থলবাগ জুড়ে রয়েছে। হিমালয় পর্বত-মালার গুরুত্বপূর্ণ কিছু নদী, যেমন সিন্ধু, তিস্তা, শতদ্রু, কালি ও ব্রহ্মপুত্র আড়াআড়িভাবে হিমালয়ের বুক চিড়ে ছুটে চলেছে। সিন্ধু ও শতদ্রু নদীর মধ্যবর্তী হিমালয়ের অংশটুকু পাঞ্জাব ও কাশ্মীর হিমালয় নামে পরিচিত। শতদ্রু ও কালি নদীর মধ্যবর্তী পরবর্তী অংশটি কুমায়ূন হিমালয় এবং কালি ও তিস্তা নদীর মধ্যবর্তী তৃতীয় অংশটি নেপাল হিমালয় নামে পরিচিত। তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্র মধ্যবর্তী চতুর্থ অংশটির নাম আসাম হিমালয়।
ভ্রমন করতে পারেন: আগ্রার তাজমহল
হিমালয় পর্বতমালায় অবস্থিত প্রাণীজগৎ
বাংলাদেশের সীমান্ত সংলগ্ন পূর্ব ভারতের প্রাণীকুলের মধ্যে রয়েছে বাগ, হাতি, চিতা, গন্ডার, বানর ইত্যাদি। সর্পকুলের মধ্যে কেউটে আর অজগর উল্লেখযোগ্য। হিমালয়ে পক্ষীজগৎ খুবই সমৃদ্ধ। হিমালয়ের নদীসমূহ থেকে পর্যাপ্ত সেচ উন্নয়ন ও জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের সম্ভাবনা প্রচুর রয়েছে। দার্জিলিং, শিমলা, নৈনিতাল ও মুসৌরির মনোরম আবহাওয়ার কারণে ভারতের তাপদগ্ধ অঞ্চলের মানুষের কাছে এগুলো স্বাস্থ্যনিবাস হিসেবে খুবই জনপ্রিয়। বাংলাদেশের রংপুর ও পঞ্চগড় জেলা থেকে শীতের সকালে জঙ্ঘার তুষারাবৃতি চুড়াগুলো চোখে পড়ে।
হিমালয় পর্বতমালার সৃষ্টি
মূলত এশিয়ান প্লেট ও ভারতীয় প্লেটের মধ্যে এক সংঘর্ষের ফলে হিমালয়ের সৃষ্টি হয়। আজ থেকে প্রায় ৪ কোটি বছর আগে গন্ডোয়ানাল্যান্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ভারত পূর্বমুখে ভাসমান অবস্থায় এশীয় স্থলভাগের সঙ্গে ধাক্কা খায়। মধ্যবর্তী টেথিস সাগর দক্ষিণ তিববতের গর্ভে উত্তরমুখী অধোগমনের দ্বারা হারিয়ে যায়, আর এই সংঘর্ষ হিমালিয় গিরিজনি বলয়ের সৃষ্টি করে। বিগত ৪ কোটি বছর ধরে প্রতিবছর প্রায় ৫ সেমি হারে ভারতীয় প্লেটের অব্যাহতভাবে উত্তরমুখী বিচলন একে এশিয়ান প্লেটের ভিতর ঠেলে দিয়েছে এবং ভারতের উত্তর প্রান্তের প্রচন্ড সংঘট , হিমালয় পর্বতমালায় ও চীনে চ্যুতি ও ভূমিকম্প, তিববতে ফাটল ও চ্যুতি এবং হিমালয়ের উত্থান, যা আজও বছরে কয়েক মিলিমিটার হারে উঠছে, এসব কিছুই ফলত ব্যাপক সংকোচনের প্রতিফলন।
হিমালয়ের ভূতাত্ত্বিক বিবর্তনের পেছনে কয়েকটি মডেলের ধারণা দেওয়া হয়েছে। প্রধানত সব মডেলেই এ ধারণার সমর্থন পাওয়া যায়, যে মেসোজোয়িক যুগে ভারতের উত্তরাঞ্চলীয় সঞ্চার (drift), ক্রিটেসিয়াস-প্রাক টারশিয়ারি যুগে সিন্ধু-সাংপো (Tsangpo) সন্ধিবলয় এবং সেনোজোয়িক যুগে ভারতীয় প্লেট ও এশিয়ান প্লেটের মধ্যে সংঘর্ষ ও এর কারণে সৃষ্ট সংকোচন ও বিকৃতি হিমালয় পর্বত সৃষ্টির জন্য দায়ী। বাংলাদেশের বঙ্গীয় অববাহিকা উত্তরে পূর্ব হিমালয় ও পূর্বে ইন্দো-বার্মা শ্রেণীমালা থেকে প্রধানত আহূত গিরিজনি অবক্ষেপে পূর্ণ।
আরও পড়ুন: আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ
হিমালয় পর্বতমালার অন্যান্য বৈশিষ্ট্য
হিমালয় পর্বত-মালার আত্মপ্রকাশ আমাদের গ্রহের নবজীবীয় (সিনোজোয়িক) ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা- শুধু এর ভূতাত্ত্বিক সংশেষের কারণেই নয়, বরং এশিয়ার পরিবেশগত ভারসাম্যে এর প্রভাবের কারণেও। বিশাল এই উপমহাদেশে তুষার-হিমবাহের একটিই আস্তানা, আর তা হচ্ছে হিমালয়- যার গগনস্পর্শী সুউচ্চ চূড়াগুলো স্থায়িভাবে জমাট বরফের বিস্তীর্ণ আস্তরণে ঢাকা; যেখান থেকে নেমে আসছে অসংখ্য ছোট-বড় হিমেল রসনা যেগুলো হিমবাহ নামে পরিচিত। বাংলাদেশের সীমান্তের কাছে চিত্তাকর্ষক কয়েকটি হিমবাহ হচ্ছে ২৬ কিমি দীর্ঘ জেমু (সিকিম) ও কাঞ্চনজঙ্ঘা (দৈর্ঘ্য ১৬ কিমি)।
হিমালয়ের আকাশ ছোঁয়া রংধনু চূড়াগুলো পর্বতারোহীদের হাতছানি দিয়েছে যুগ যুগ ধরে। প্রায় অগম্য এই সুউচ্চ চূড়ায় ভ্রমণের সুবিধা নেই, এমনকি বিমানপথেও নয়। কেবলমাত্র দক্ষিণাঞ্চলীয় পর্বত পাদদেশে যাওয়ার রেল সংযোগ রয়েছে। চীন ও কাশ্মীরের মধ্যে এবং ভারত থেকে নেপাল ও সিকিম হয়ে চীন পর্যন্ত রয়েছে পাকা রাস্তা। শ্রীনগর ও কাঠমুন্ডে রয়েছে বড় বিমানবন্দর।
হিমালয় পর্বতমালার সম্পর্কে সচরাচর জিজ্ঞাসিত কিছু প্রশ্নোত্তর (FAQ’s)
পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পর্বত কোনটি?
পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পর্বত হচ্ছে মাউন্ট এভারেস্ট (Mount Everest)। এটি চীন ও নেপাল সীমান্তে অবস্থিত বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ। এর উচ্চতা ৮,৮৪৮ মিটার বা ফুট ২৯,০২৮।
মাউন্ট এভারেস্ট অর্থ কি?
মাউন্ট এভারেস্ট অর্থ- সাগর মাতা, চোমোলংমা বা কোমোলংমা, “মহাবিশ্বের মাতা”।
হিমালয় পর্বতমালা এশিয়ার কতটুকু জায়গা জুড়ে বিস্তৃত?
এশিয়া মহাদেশের ১৫ হাজার মাইল জুড়ে বিস্তৃত হিমালয় পর্বতমালা।
শেষকথা
হিমালয় পর্বতমালায় প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ যাতায়াত করে। ভারতবর্ষ ভ্রমনে গেলে হীমালয় পর্বতমালা ভ্রমন করতে পারেন।