হামহাম জলপ্রপাত যাবার উপায়

হামহাম জলপ্রপাত বা চিতা ঝর্ণা, মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার রাজকান্দি সংরক্ষিত বনাঞ্চলের গভীরে কুরমা বন বিট এলাকায় অবস্থিত একটি প্রাকৃতিক জলপ্রপাত বা ঝর্ণা। জলপ্রপাতটি ২০১০ খ্রিষ্টাব্দের শেষাংশে পর্যটন গাইড শ্যামল দেব বর্মার সাথে দুর্গম জঙ্গলে ভ্রমনকারী একদল পর্যটক আবিষ্কার করেন। তবে স্থানীয়দের কাছে এটি “চিত্রা ঝর্ণা” হিসেবে পরিচিত, কেননা একসময় এ জঙ্গলে চিতা বাঘ পাওয়া যেত। দুর্গম গভীর জঙ্গলে এই ঝরণাটি ১৪৭ কিংবা ১৭০ ফুট উঁচু যেটাকে বাংলাদেশের সবথেকে উঁচু ঝর্ণা হিসেবে সরকারিভাবে স্বীকৃত। যেকানে মাধবকুণ্ড জলপ্রপাতের উচ্চতা অক্টোবর ১৯৯৯-এর হিসাব অনুযায়ী ১৬২ ফুট। তবে হাম হাম ঝর্ণার উচ্চতা বিষয়ে কোনো প্রতিষ্ঠিত কিংবা পরীক্ষিত মত নেই। সবই পর্যটকদের অনুমান। তবে গবেষকরা মত প্রকাশ করেন যে, এর ব্যাপ্তি, মাধবকুণ্ডের ব্যাপ্তির প্রায় ৩ গুণ বড়।

<yoastmark class=

হামহাম জলপ্রপাত এর সংক্ষিপ্ত বিবরণ:

হাম হাম বা চিত্রা ঝর্ণার যৌবন হলো বর্ষাকাল। বর্ষা মৌসুমে প্রচন্ড গতিতে জলধারা গড়িয়ে পড়ে। শীতকালে তা মাত্র একটি ঝর্ণা ধারায় এসে মিশে। হাম হাম ঝর্ণার ঝরে পড়া পানি গহীন জঙ্গলের ভিতর দিয়ে ছড়া তৈরি করে বয়ে চলেছে। এরকমই বিভিন্ন ছোট-বড় ছড়া পার হয়ে জঙ্গলের জঙ্গলপথ পেরিয়ে এই ঝর্ণার কাছে পৌঁছতে হয়। ঝরণাটির কাছে যাওয়ার জন্য এখনও কোন রাস্তা তৈরি হয়নি। আঁকা-বাঁকা ছড়া ও জঙ্গলের ভিতর দিয়ে সাধারণত স্থানীয় অধিবাসী লোকদের থেকে কাউকে গাইড বা পথপ্রদর্শক নির্ধারণ করে হাম হাম ঝর্ণা ভ্রমন করতে হয়। হাম হাম ঝর্ণায় যেতে হলে কুড়মা বন বিটের চম্পারায় চা বাগান হয়ে যেতে হয়। চম্পারায় চা-বাগান থেকে হাম হাম ঝর্ণার দূরত্ব প্রায় সাত কি.মি।

<yoastmark class=

হাম হাম ঝর্ণায় যাবার পথে অত্যন্ত উঁচু মোকাম টিলা পাড়ি দিতে হয় এবং অনেক গিরিপথ ও ছড়ার কাদা মাটির মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। এছাড়া গভীর জঙ্গলে বয়েছে সাপ, মশা, বানর, এবং জোঁকের ভয় এসবের অত্যাচার সহ্য করে পথ চলতে হয়। বর্ষাকালে হাম হাম র্ঝনায় যাবার পথে আরেকটি ছোট ঝর্ণা দেখাতে পাওয়া যায় । হাম হামের পানি পড়ার রয়েছে ২টি ধাপ, সর্বোচ্চ ধাপ থেকে পানি পড়ছে মাঝখানের ধাপে, এবং সেখান থেকে আবার পানি পড়ছে নিচের অগভীর খাদে। ঝর্ণার নিকটবর্তি বাসিন্দারা হলেন আদিবাসী ত্রিপুরা।

প্রকৃতি

হাম হাম জলপ্রপাত বা চিত্রা ঝর্ণা সংলগ্ন রাজকান্দি বনাঞ্চলে রয়েছে সারি সারি কলাগাছ, জারুল গাছ, চিকরাশি কদম গাছ। এর ফাঁকে ফাঁকে উড়তে থাকে মন জুড়ানো নানা রঙের প্রজাপতি (butterfly)। ডুমুর গাছের শাখায় আর বাঁশ বাগানে দেখতে পাওয়া যায় অসংখ্য হনুমানের। এছাড়াও রয়েছে মুলি বাঁশ, ডলু বাঁশ, মির্তিঙ্গা, কালি বাঁশ ইত্যাদি বিভিন্ন নামের বিভিন্ন প্রজাতির বাঁশ।

কোন মৌসুমে ঘুরতে যাবেন হাম হাম জলপ্রপাত

শৗত মৌসুমে হামহাম জলপ্রপাত ভ্রমনের উপযুক্ত সময়। শীতকালে পানি কিছুটা কম থাকে। বর্ষাকালে পানি বেশি থাকে বিদায় হামহাম জলপ্রপাতে যাওয়া অনেক কষ্টকর। তাই বিভিন্ন স্থান থেকে ছুটে আসা পর্যটকদের কাছে শীতকালটা হামহাম ঝর্না দর্শনের উপযুক্ত সময়।

হাম হাম জলপ্রপাত যাওয়ার উপায়

বাংলাদেশের যে কোন স্থান হতে মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলা শহরে এসে শ্রীমঙ্গল থেকে প্রথমে কলাবন পাড়ায় যেতে হবে। সকাল সকাল হামহাম ঝর্ণার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলে ভাল হয়। কলাবন পাড়ায় যাওয়ার জন্য সিএনজি ভাড়া রিজার্ভ এক হাজার থেকে বারোশত টাকার মত লাগতে পারে, কলাবন পাড়া যাওয়ার জন্য জীপ গাড়ীও আছে । দরদাম করে গাড়ী রিজার্ভ করা ভালো। কলাবন পাড়ায় পৌছে প্রথমে একজন গাইড ঠিক করে নিবেন। ভ্রমনকারীরা প্রত্যেকে সাথে একটি লাটি নিতে ভুল করবেন না। কলাবন থেকে হাম হাম জলপ্রপাত বা চিত্রা ঝর্নায় যাতায়াতের জন্য ২টি ট্রেইল রয়েছে, একটি ঝিরি পথ ও অন্যটি পাহাড়ি পথ। ঝিরিপথে পায়ে হেটে সময় একটু বেশি লাগে তাবে ঝিরি পথের সৌন্দর্য পাহাড়ে পথের চেয়ে অনেক বেশি। হাম হাম ঝর্নায় যেতে আনুমানিক ২ থেকে ৩ ঘন্টা সময় লাগতে পারে।

<yoastmark class=

কোথায় থাকবেন

শ্রীমঙ্গল শহরের আশে পাশে ভালো মানের অনেক রিসোর্ট ও আবাসিক হোটেল রয়েছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, পাঁচ তারকা রিসোর্ট গ্র্যান্ড সুলতান টি রিসোর্ট এন্ড গলফ, নভেম ইকো রিসোর্টে, লেমন গার্ডেন রিসোর্ট, দুসাই রিসোর্ট এন্ড স্পা, টি হেভেন রিসোর্ট, শ্রীমঙ্গল টি রিসোর্ট, নিসর্গ ইকো-রিসোর্ট, শান্তি বাড়ি ইকো রিসোর্ট, সুইস ভ্যালি রিসোর্ট, গ্র্যান্ড সেলিম রিসোর্ট।
আবাসিক হোটেল: হোটেল মেরিনা, হোটেল আল-রহমান, টি টাউন রেস্ট হাউস, হোটেল ইউনাইটেড রেসিডেন্সিয়াল।

খাবার

হামহাম জলপ্রপাত বা চিত্রা ঝর্না  যাবার পূর্বে কলাবন পাড়ায় স্থানীয় লোকের দেওয়া ছোট ছোট হোটেল আছে সেখানে খেয়ে নিতে পারেন। বর্তমানে হাম হাম ঝর্ণায় যাবার রাস্তায় চা, বাদাম, ছোলাবুট যাওয়া যায়, যা খেয়ে সাময়িক খিদা নিবারন করতে পারেন। এছাড়া হামহাম যাবার পূর্বে ব্রেড, কলা ও অন্যান্য শুকনো খাবার নিতে পারেন। খাবার পানি নিতে ভুলবেন না। মেনে রাখবেন বেশি ভারী ব্যাগ বা অন্যান্য মালামাল বহন করা থেকে বিরত থাকবেন, যেহেতু রাস্তা অনেক দুর্গম।

হাম হাম ঝর্ণার আশপাশের দর্শনীয় স্থান

হাম হাম জলপ্রপাত ভ্রমণে মনে রাখা উচিত

হাম হাম জলপ্রপাত যাবার সয়ম পর্যটকরা খাবার এবং প্লাস্টিকের পানীর বোতল সঙ্গে করে নিয়ে থাকেন এবং অন্যান্য খাবার নোংরা হওয়া থেকে রক্ষা করার জন্য পলিথিন ব্যবহার করে থাকেন। খাবার পর সেসব বস্তু যেখানে সেখানে ফেললে পরিবেশ নষ্ট হয়। কেউ এসব বস্ত নিয়ে আসতে আগ্রহ দেখান না। যার ফলে ঝর্ণার অঞ্চল নষ্ট হয় এমনকি জঙ্গলের সৌন্দর্য্যহানির পাশাপাশি পরিবেশের জন্য ব্যাপক ক্ষতি হয়। তাই পর্যটকদেরকে উচিত পঁচনশীল বর্জ্য পুতে ফেলা এবং অপচনশীল বর্জ্য যেমন পানির বোতল ও পলিথিন সঙ্গে করে নিয়ে আসা কিংবা পুড়িয়ে ফেলার সু-পরামর্শ দেয়া হল।

হামহাম জলপ্রপাত ভ্রমন টিপস ও সর্তকতা

  • সাবধানে চলাচল করবেন।
  • অপ্রয়োজনীয় মললা যেখানে যেখানে ফেলবেন না।
  • স্থানীয় লোকদের সাথে ভালো ব্যবহার করুন, প্রয়োজন হলে তাদের থেকে সাহায্য নিন।
  • প্রয়োজনীয় পানি সাথে নিন, খাবার স্যালাইন সাথে রাখতে পারেন।
  • ব্যাক প্যাক হালকা রাখবেন।
  • সন্ধ্যা হওয়ার পূর্বেই যেন ফিরে আসা যায় সেদিকে লক্ষ্য রাখবেন।
  • বিশেষ সতর্কতা: বর্ষাকালে ঝিরি পথে জোঁক অনেক বেশি থাকে, পাশাপাশি মশা, সাপের ভয়ও রয়েছে এবস মাথায় নিয়ে পথ চলতে হবে।
আরও পড়ুন: পর্যটকের আকর্ষণ পৃথিমপাশা নবাব বাড়ি

শেষকথা

ভ্রমন পিপাসু লোকদের কাছে একটি চ্যালেঞ্জের নাম হাম হাম জলপ্রপাত বা চিত্র ঝর্না দর্শনীয় স্থান। যারা চ্যালেঞ্জ নিতে প্রস্তুত তাদের কাছে হামহাম ঝর্না একটি আনন্দদায়ক মুহুর্ত হতে পারে।