আসছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় জাহাজ – আইকন অব দ্য সিস

পৃথিবীর ইতিহাসে যুগে যুগে বহু সামুদ্রিক প্রমোদতরী যাত্রা করেছে। পৃথিবীর ধারণাকালীন ইতিহাসের মধ্যে সবচেয়ে বড় জাহাজ নির্মিত হচ্ছে, যা ‘আইকন অব দ্য সিস (Icon of the Seas)’ নামে পরিচিত।

বাণিজ্যিকভাবে ২০২৪ সালে যাত্রা শুরুর কথা থাকলেও, বর্তমান থেকেই বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত হচ্ছে এই সামুদ্রিক দানবের আলোচনা ও গুণগান। নির্মানাধীন ও পরীক্ষানাধীন এই জাহাজটির পরিপূর্ণ তথ্য প্রকাশ করা না হলেও, প্রকাশিত হয়েছে এর গঠন, ধারণ ক্ষমতা, নির্মাণের ইতিহাস, উদ্বোধনের সম্ভাব্য তারিখ এবং জাহাজের সকল সুবিধা সমূহ। বিশ্বের সবচেয়ে বড় জাহাজের খেতাব নিয়ে আগমনকারী এই ‘আইকন অব দ্য সিস’ এর বিস্তারিত তথ্য জানতে পারবেন এই লেখা থেকে।

গঠন ও ধারণ ক্ষমতা

বিশাল এই জাহাজটির ওজন ২ লক্ষ ৫০ হাজার ৮০০ টন। অর্থাৎ, দুটি সিএন টাওয়ারকে ভাসিয়ে রাখার চেষ্টার সঙ্গে একে তুলনা করা যায়। জাহাজটির দৈর্ঘ্য ১২০০ ফুট। এই জাহাজটি ৫ হাজার ৬১০ যাত্রী ও ২ হাজার ৩৫০ ক্রু সদস্য অর্থাৎ মোট ৭ হাজার ৯৬০ যাত্রী পরিবহণে সক্ষম।

ঐতিহাসিক টাইটানিকের দৈর্ঘ্য ছিল ২৬৯ মিটার বা ৮৮২.৫৪ ফুট। টাইটানিকের থেকেও কতটা বড় এই জাহাজ, তা এখানেই স্পষ্ট।

যাত্রা শুরু

২০২৪ সালের ২৭ জানুয়ারি বাণিজ্যিক ভাবে যাত্রা শুরু করবে এই প্রমোদতরী। এটি আমেরিকার ফ্লরিডার মায়ামি থেকে যাবে পূর্ব এবং পশ্চিম ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে। ৭ রাতের ইস্টার্ন ক্যারিবিয়ান ট্রিপে মায়ামি, ফিলিপ্সবার্গ, শার্লট আমালি এবং কোকোকে; অথবা, ব্যাসেটেরে, সেন্ট কিটস অ্যান্ড নেভিস, শার্লট আমালি এবং কোকোকে ভ্রমণ করা যাবে।

আর পশ্চিম ক্যারিবিয়ান ৭ রাতের ট্রিপে থাকবে মায়ামি, রোটান, কোস্টা মায়া, কোজুমেল এবং কোকোকে ভ্রমণ। প্রায় ১ সপ্তাহ সময় লাগবে যাত্রা করতে। নির্মাণকারী সংস্থার সূত্রে খবর, ২০২৫ সালের এপ্রিল পর্যন্ত জাহাজটি মায়ামি থেকে ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের উদ্দেশে যাত্রা করবে। তার পর জাহাজের গতিপথ পরিবর্তন করা হতে পারে।

আইকন অব দ্য সিস তৈরির ইতিহাস

জাহাজটির মালিক রয়্যাল ক্যারিবিয়ান ইন্টারন্যাশনাল সংস্থা এবং ফিনল্যান্ডের শিপইয়ার্ডে নির্মাণ করা হয়েছে। ২০১৬ সালে রয়্যাল ক্যারিবিয়ান “সমুদ্রের আইকন” এর জন্য একটি ট্রেডমার্ক নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছিল। পরবর্তীতে ২০১৬ সালের অক্টোবর মাসের রয়্যাল ক্যারিবিয়ান এবং ফিনিশ জাহাজ নির্মাতা মেয়ার তুর্কু “আইকন” নামে দুটি জাহাজ নির্মাণের আদেশ ঘোষণা করেন।

এই দুটি জাহাজের মধ্যে একটি ২০২৩ সালের চতুর্থ মাসে এবং আরেকটা ২০২৫ সালের মধ্যে সরবরাহ করা হবে বলে তারা বলেছিলেন। DNV দ্বারা জাহাজগুলোকে শ্রেণীবদ্ধ করা হবে।

২০২১ সালের জুন মাসে আইকন অব দ্য সিস এর জন্য ইস্পাত কাটা শুরু হয়। ২০২১ সালের অক্টোবরে, রয়্যাল ক্যারিবিয়ান ঘোষণা করেছিল যে জাহাজের জন্য প্রথম এলএনজি ট্যাঙ্কটি জার্মানির রোস্টকের নেপটন ওয়ের্ফট এ ইনস্টল করা হয়েছে। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে, ভাসমান ইঞ্জিন রুম ইউনিট, এলএনজি ট্যাঙ্ক সহ, টাগ দিয়ে ফিনল্যান্ডের তুর্কুতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।

২০২২ সালের এপ্রিলে পাল তোলা হয়েছিল। ২০২২ সালের মে মাসে, রয়্যাল ক্যারিবিয়ান নিশ্চিত করেছে যে সমুদ্রের আইকন জাহাজটি ওয়েসিস জাহাজের চেয়েও বড় হবে।

২০২৩ সালের ১৯শে জুন আইকন অফ দ্য সিস সমুদ্রে প্রথম ট্রায়ালের জন্য যাত্রা করে। এ সময় শত শত মাইল পরিভ্রমণ করেছে। পরীক্ষা করা হয়েছে প্রধান ইঞ্জিন, ব্রেক সিস্টেম, স্টিয়ারিং, শব্দ ও কম্পনের মাত্রা। ৪৫০ জন বিশেষজ্ঞ চার দিন ধরে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জাহাজটিকে সমুদ্র যাত্রার জন্য ছাড়পত্র দিয়েছেন।

চলতি বছর জাহাজটিকে আরো একবার ট্রায়াল দেয়া হবে। মায়ার তুর্কু শিপইয়ার্ডের সিইও টিম মেয়ার এক বিবৃতিতে বলেন, জাহাজটির পেছনে আমরা অনেক অর্থ, সময় ও প্রকৌশল দক্ষতা ব্যয় করেছি। এই প্রমোদতরীতে পর্যটকদের প্রয়োজনীয় সবকিছুই আছে।

আইকন অব দ্য সিস এর সুবিধাসমূহ ও বৈশিষ্ট্য

আইকন অব দ্য সিস
আইকন অব দ্য সিস

এটি বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ ও বিলাসবহুল একটি প্রমোদতরী। প্রায় ৪০ রকম বিনোদনের ব্যবস্থা থাকছে এই প্রমোদতরীতে। বৃহত্তম এ জাহাজটির সবচেয়ে বড় আকর্ষণ বা বিশেষত্ব হলো যাত্রী ধারণ ক্ষমতা এবং অবশ্যই এর ওয়াটার পার্ক।

এখানে ছয়টি ওয়াটার স্লাইড রয়েছে। এর মধ্যে একটি ‘ওপেন ফ্রি-ফল স্লাইড’, একটি ‘ফ্যামিলি রাফ্ট স্লাইড’ এবং দুটি ‘ম্যাট-রেসিং স্লাইড’ রয়েছে। এছাড়াও ৭টি সুইমিং পুল ও ৯টি বিশেষ ধরনের পানির ঘূর্ণি আছে। জাহাজের ভিতরে বিশাল আকার একটি থিম পার্ক রয়েছে। এখানে কৃত্রিম বিচ সহ রিসোর্ট রয়েছে।

আরও পড়ুন: ওয়ান্ডার অব দ্য সিস – বিশ্বের সবচেয়ে বড় জাহাজ

আরো রয়েছে অ্যাকোয়া থিয়েটার, সুইম আপ বার, লাইভ মিউজিকের ব্যবস্থা। বিলাসবহুল সেই জাহাজটিতে রয়েছে খেলার জায়গা, বাস্কেটবল কোর্ট, আইস স্কেটিং রিঙ্ক, সার্ফ সিমুলেটর, জিপ লাইন ইত্যাদি। বিভিন্ন রকম পানাহার, আমোদ-প্রমোদের ব্যবস্থাও থাকছে।

আইকন অব দ্য সিস জাহাজে ২০ রকমের ডেক রয়েছে। এমনকি প্রাপ্ত বয়স্কদের সময় কাটানোর জন্য এখানে পিয়ানো বারের মতো বিশেষ জায়গা রাখা হয়েছে। সমুদ্রের দৃশ্য উপভোগ করার পাশাপাশি গ্রুপ ভ্রমণকারীদের জন্য আরও ২৮ রকমের বিনোদনের বন্দোবস্ত রয়েছে। যাঁরা পরিবারের সঙ্গে প্রমোদতরীতে ভ্রমণ করবেন তাঁদের জন্য বিশেষ ধরনের সেবাযত্ন রয়েছে। বৃহত্তম এই ক্রুজে ২৮ ধরনের কেবিন থাকছে।

জাহাজের ৮২ শতাংশ রুমে ৩ থেকে ৪ জন আরাম করে থাকতে পারবে। এছাড়াও ৭০ শতাংশ রুমের সঙ্গে রয়েছে ব্যালকনি। এই জাহাজের কেবিন ভাড়া মাথাপিছু সর্বনিম্ন ৮৯৬ ডলার থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ১ হাজার ৭০৩ মার্কিন ডলার খরচ হবে। আর ক্রিসমাসের সময় জাহাজের ফ্যামিলি টাউন হাউস সুইটে থাকলে খরচ পড়বে ৮৫ হাজার ডলার।

শেষকথা

বর্তমানে আইকন অব দ্য সিস জাহাজটির প্রতিষ্ঠাতা কোম্পানি, জাহাজের প্রথম যাত্রার সিট বুকিং বা টিকেট কাটার জন্য অনলাইন এবং অফলাইন কার্যক্রম চালু রেখেছে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় জাহাজ এবং বহু সুযোগ সুবিধা থাকায় এর টিকিট মূল্যও হবে অনেক বেশি। তবে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ এই জাহাজে আরোহণের অনুভূতিও হবে ভিন্নরকম।