ইফতারের দোয়া ও নিয়ম : রোযা ইসলামে ৫টি স্তম্বের মধ্যে ৩ নাম্বার। রমযান মাসে রোযা রাখা প্রত্যেক সাবালক নারী পুরুষের উপর ফরজ করা হয়েছে। কেউ কেউ সারা বছর বিভিন্ন ধরনের নফল রোযা পালন করে থাকেন। রোযা রাখলে ইফতার করতে হয়। ইফতার হলো উম্মতে মুহাম্মাদীর জন্য বড় একটি পুরস্কার। মুসলিম শরীফে এসেছে,
– لِلصَّائِهِ فَرْحَتَانِ فَرْحَةٌ عِنْدَ فِطْرِهِ وَفَرْحَةٌ عِنْدَ لِقَاءِ رَبِّهِ. وَلَخُلُوْنُ فِيْهِ أَطْيَبُ عِنْدَ اللَّهِ مِنْ رِيحِ الْمِسْكِ
“রোযাদার ব্যক্তির জন্য দুটো আনন্দের সময় রয়েছে। এর একটি হলো ইফতারের সময়, আর অপরটি হলো পরকালে রবের (আল্লাহর) সাথে সাক্ষাতের সময়। আর রোযাদার ব্যক্তির মুখের গন্ধ আল্লাহর কাছে মেশকে আম্বরের চেয়েও অধিক পছন্দনীয়
পৃথিবীতে সকল আনন্দের মধ্যে অন্যতম আনন্দ হলো সারা দিন রোযা রেখে ইফতারের মুহূর্তে। সারা দিন অনাহারে থেকে একটি মানুষ সিয়াম সাধনায় এমনভাবে নিমগ্ন হয় যে, সে পানাহার এবং নিষিদ্ধ কর্ম থেকে বিরত থাকল এবং তার সামনে খাবার রাখা আছে, সে নিজ হাতে খাবার ধরছে, নাড়াচাড়া করছে, তারপরও কিন্তু মুখে দিচ্ছে না বা খাবার গ্রহন করছে না।
লক্ষ লক্ষ রোযাদার প্রচণ্ড ক্ষুধা পেটে নিয়ে সূর্যাস্তের তথা আল্লাহর হুকুমের অপেক্ষা করছে। সূর্যাস্তের পূর্ব মুহূর্তে রোযাদারের কত বড় ধৈর্য। লুকিয়ে কিছু মুখে দিলে কেউ দেখতো না? কিন্তু না রোযাদার তো তাকওয়ার অনুশীলনে মত্ত। ক্ষুধার জ্বালায় হাত–আঙুল নড়ছে বটে; কিন্তু খাবার মুখে তোলার সাহস নেই। এ দৃর্শটি স্বয়ং আল্লাহ রহমতের নজরে দেখছেন এবং রোযাদারের জন্য বরকতের দুয়ারগুলো খুলে দিয়ে রেখেছেন, ক্ষমার ঘোষণা দিয়ে যাচ্ছেন,
الصَّوْمُ لِي وَأَنَا أَجْزِيْ بِهِ يَدَعْ شَهْوَتَهُ وَأَكْلَهُ وَشُرْبَهُ مِنْ أَجْلِيْ
অর্থ্যাৎ- রোযা একমাত্র আমার জন্য, আমি নিজে রোযার প্রতিদান দেব অথবা আমি স্বয়ং নিজে তার বদলা হয়ে যাব। সে তার কামনা-বাসনা এবং খাবার চাহিদা আমার জন্যই ছেড়ে দিয়েছে। অতএব তার জন্য রয়েছে বড় ধরনের পুরস্কার।”
রোযা
নবী কারীম বলেছেন,
مَنْ فَظَرَ فِيْهِ صَائِمًا كَانَ لَهُ مَغْفِرَةٌ لِذُنُوبِهِ، وَعِشْقَ رَقَبَتِهِ مِنَ النَّارِ، وَكَانَ لَهُ مِثْلُ أَجْرِهِ مِنْ غَيْرِ أَنْ يُنْقَصَ مِنْ أَجْرِهِ شَيْءٌ ، قُلْنَا: يَا رَسُوْلَ اللَّهِ، لَيْسَ قُلْنَا يَجِدُ مَا يُفْطِرُ الصَّائِمَ ، فَقَالَ رَسُوْلُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : يُعْطِي اللَّهُ هَذَا الثَّوَاتِ مَنْ فَطَرَ صَائِمًا عَلَى مَذْقَةٍ لَبَنٍ أَوْ تَمْرَةٍ أَوْ شَرْبَةٍ مِنْ مَاءٍ ، وَمَنْ أَشْبَعَ صَائِمًا سَقَاهُ اللهُ مِنْ حَوْضِيْ شَرْبَةٌ لَّا يَظْمَأُ حَتَّى يَدْخُلَ الْجَنَّةَ
“যে ব্যক্তি কোনো রোযাদারকে ইফতার করাবে, তার গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে এবং সে জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি পাবে, আর সে ওই রোযাদার ব্যক্তির রোযার সওয়াব পাবে যাকে সে ইফতার করিয়েছে; কিন্তু রোযাদার ব্যক্তির প্রাপ্ত সওয়াবের বিন্দুমাত্র কম করা হবে না।
আমরা (সাহাবিরা) আরয করলাম, হে আল্লাহর রাসূলুল্লাহ । রোযাদারকে ইফতার করাবার সামর্থ্য তো আমাদের নেই। নবী কারীম উত্তরে বললেন, আল্লাহ পাক এই সওয়াব ওই ব্যক্তিকে দান করবেন, যে ব্যক্তি কোনো রোযাদারকে সামান্য পরিমাণ দুধ অথবা একটি খেজুর কিংবা এক পেয়ালা পানি দ্বারাও ইফতার করাবে। আর যে ব্যক্তি কোনো রোযাদারকে পেট ভরে খানা খাওয়াবে আল্লাহ পাক তাকে আমার হাউজে কাউসার থেকে তৃপ্তিসহকারে পানি পান করাবেন। সে জান্নাতে প্রবেশ করা পর্যন্ত আর পিপাসিত হবে না।
নবী কারীম বলেছেন,
عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرٍو قَالَ : قَالَ رَسُولُ الله صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : إِنَّ لِلصَّائِمِ عِنْدَ فِطْرِهِ لَدَعْوَةٌ مَّا تُرَد
“হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আমর (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ বলেছেন, নিশ্চয়ই রোযাদার ব্যক্তির জন্য তার ইফতারের সময় এমন দু’আ করার সুযোগ আছে যা ফিরিয়ে দেয়া হয় না। তাই আমাদের উচিত ইফতারের সময় বেশি বেশি দোয়া করা।
ইফতারের সময়
ইফতার এর সময় হলে দিন সূর্য ডুবার সাথে সাথে ইফতারের দোয়া ও নিয়ম জেনে কিছু খেয়ে রোযা ভঙ্গ করা। পবিত্র কুরআন মাজীদে বলা হয়েছে,
ثُمَّ أَتِمُّوا الصِّيَامَ إِلَى الَّيْلِ
“তোমরা রোযাকে রাত পর্যন্ত পূর্ণ কর।
সূর্য ডুবার সাথে সাথে তাড়াতাড়ি করে ইফতার করা উচিত । এ জন্য নবী করিম (সা:) বলেছেন- আমার উম্মত ততদিন কল্যাণের মধ্যে থাকবে যতদিন তারা তাড়াতাড়ি ইফতার করবে। তাই সময় হওয়ার সাথে সাথে ইফতার করে নিতে হবে।
নোট: বর্তমান তথ্য প্রযুক্তির যুগে আমাদের ইফতারের সময় সম্পর্কে জানতে তেমন কোন অসুবিধা হয় না। বাংলাদেশ সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মসজিদের মাইকে আযান হওয়ার সাথে সাথেে আমরা ইফতার করে থাকি।
আর পড়ুন: রমজান মাসের প্রয়োজনীয় মাসলা মাসায়েল ও দোয়া সমুহ
নবী কারীম -এর ইফতার
হযরত আনাস ইবন মালেক (রা.) বলেন, নবী কারীম (সা:) সূর্যাস্তের সাথে সাথে কয়েকটি তাজা খেজুর দ্বারা ইফতার করতেন। তাজা খেজুর না থাকলে শুকনা খেজুর বা শুধু পানি পান করে রোযার ইফতার করতেন। তাই আমাদের উচিত হুজুর (সা:) এর সুন্নাত পালনের জন্য খেজুর দ্বারা ইফতার করা।
অমুসলিমের দেয়া ইফতার
যেহেতু রোযার ইফতার একটি তাকওয়ার ইবাদত। রোযায় যেন সমান্যতম ত্রুটি সৃষ্টি না হয় এজন্য সতর্ক থাকা একান্ত কর্তব্য। কোন অমুসলিমের ইফতারের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে ইফতারের জন্য প্রদত্ত হালাল খাবার দ্বারা ইফতার করা জায়িয। অনুরূপভাবে কোনো হিন্দু মহিলা হালাল খাবার দ্বারা ইফতার তৈরি করলে অথবা সাহরীর খাবার তৈরি করলে তা খাওয়াও জায়িয হবে। তবে যেহেতু ‘রামাযান’ তাকওয়ার মাস সেহেতু আবশ্যিকতা না থাকলে এসব এড়িয়ে চলা উচিত।
অমুসলিমকে সাথে নিয়ে ইফতার
মানবতার ধর্ম হচ্ছে ইসলাম। মানুষ হিসেবে সম্মান করতে গিয়ে নবী কারীম (সা:) একজন ইয়াহুদীর লাশ দেখে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন। মানুষকে সম্মান করার ঐতিহ্য মুসলিম মিল্লাতের একটি বৈশিষ্ট্য। মহানবী (সা:) অমুসলিম খ্রিস্টানদের মসজিদে নববীতে বসতে দিয়ে তাদের প্রতি এক বিরল সম্মান প্রদর্শন করেছিলেন। তিনি অমুসলিমকে মেহমান বানিয়ে নিজের ঘরে শুইতেও দিয়েছিলেন এবং তার প্রতি যত্নসহকারে মেহমানদারীও করেছিলেন। তিনি ছিলেন এক অদ্বিতীয় মেজবান এবং মেহমান নেওয়ায়।
অতএব এমন অমুসলিম বন্ধু, ব্যবসার সাথী, অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীকে সাথে নিয়ে ইফতার করা জায়িয, শরীয়তে বাধা নেই। এমনও তো হতে পারে যে, এই ইফতারের দস্তরখানার বরকতে, এতগুলো জান্নাতী রোযাদার ব্যক্তির পাশে বসার কারণে আল্লাহ পাক তাদের মধ্যে সহীহ বুঝ সৃষ্টি করে দিতে পারেন এবং কালেমার সুগন্ধিতে তারাও সুঘ্রাণিত হতে পারেন।
মুয়াজ্জিনের ইফতারের পদ্ধতি
ওয়াক্ত না হওয়া পর্যন্ত মুয়াজ্জিনের আযান দেয়া জায়িয নেই। অতএব মাগরিবের ওয়াক্ত হলে মুয়াজ্জিন মুখে একটি খেজুর খেয়ে অথবা পানি দিয়ে বিলম্ব না করে আযান দেয়া শুরু করবে। এমনটা যেন না হয় যে, মুয়াজ্জিন পেটভরে ইফতার করে আযান দেবে। অবশ্য এমনটা হয় না। এখানে মনে রাখা প্রয়োজন যে, মুয়াজ্জিন কিছু না খেয়েও আযান দিতে পারে । কারন আমাদের দেশের মানুষ ইফতারের জন্য মোয়াজ্জিনের আযানের অপেক্ষা করে এবং আযান হওয়া সাথে সাথে তারা ইফতার করে থাকেন।
ইফতারের আদব ও ইফতারের দোয়া ও নিয়ম
খেজুর দ্বারা ইফতার করা মুস্তাহাব। যদি খেজুর না থাকে তাহলে ঘরে যা আছে বা তৈরি হয়েছে পানি, চিড়া, ভাত, বিস্কুট, চা ইত্যাদি দ্বারা ইফতারে বাধা নেই। মাগরিবের পূর্বে ইফতার সাজিয়ে সামনে নিয়ে বসে অপেক্ষা করা মুস্তাহাব। এই সময়টা আল্লাহর নিকট অতি পছন্দনীয়। এসময় বান্দা যে দোয়া করে আল্লাহ তায়ালা তা কবুল করে নেন। তাই এ সময় বেশি বেশি আল্লাহর নিকট চাওয়া বা দোয়া করা উচিত এবং ইফতারের দোয়া ও নিয়ম জেনে ইফতার করা উচিত।
ইফতারের উত্তম সময়
দেরি না করে সূর্যাস্তের সাথে সাথেই ইফতার করা উত্তম।
হযরত সাহল ইবনে সাদ (রা:) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূল (সা:) বলেছেন,মানুষ কল্যাণের ওপর থাকবে ততদিন যতদিন সূর্যাস্তের সাথে সাথে দেরি না করে উফতার করবে। (বুখারী ও মুসলিম)
হাদীস শরীফে আরো এসেছে,
ثَلَاثَةٌ مِنْ سُنَنِ الْأَنْبِيَا: تَعْجِيلُ الْفُطُورِ وَتَأْخِيرِ السُّحُورِ وَالسّوَاكُ
“নবীগণের সুন্নাত তিনটি :
- তাড়াতাড়ি ইফতার করা;
- দেরিতে সাহরী খাওয়া; এবং
- মিসওয়াক করা।”
ভুলবশত দিনের বেলায় খাওয়া
রোযাদার ব্যক্তি ভুলবশত দিনের বেলায় অথবা রোযা থাকা অবস্থায় খাবার খেয়ে ফেললে তাতে রোযার কোনো ক্ষতি হবে না। এ প্রসঙ্গে হযরত আবূ হুরায়রা (রা.) রাসূলুল্লাহ থেকে হাদীস বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ বলেছেন,
مَنْ نَّسِيَ فَأَكُل أَوْ شَرِبَ وَهُوَ صَائِمٌ فَلْيُتِمَّ صِيَامَهُ، فَإِنَّمَا هُوَ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ أَطْعَمُهُ وَسَقَاهُ
“যে ব্যক্তি ভুলে গেল সে রোযাদার, এ অবস্থায় সে খাওয়া বা পানাহার করল। সে যেন তার রোযা পূর্ণ করে। কেননা, আল্লাহই তাকে পানাহার করিয়েছেন।’ ভুলবশত খেলেও সূর্যাস্ত পর্যন্ত রোযা রাখতে হবে এবং ওই রোযার কোনো কাযা-কাফফারা করতে হবে না।
রোযাদারকে খেতে দেখলে বারণ করা
রামাযান মাসে দিনের বেলায় কেউ যদি কাউকে পানাহার করতে দেখে তাহলে সাথে সাথে তাকে রোযার কথা স্মরণ করিয়ে দেবে। কেননা, নবী -এর নামাযে যখন ভুল হয়ে গেল তখন তিনি সাহাবীগণকে বলেছিলেন, “আমি যখন ভুলে যাই তোমরা আমাকে স্মরণ করিয়ে দিও।
বিলম্বে ইফতার করা
কোন কোন জায়গায় ইফতার দেরিতে করতে হয়। যেমন এমন এক কোনো জায়গা যেখানে ঘড়ি, রেডিও, টেলিভিশন বা মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক নেই এবং আকাশ মেঘাচ্ছন্ন অথবা প্রচণ্ড ধুলার আস্তরণ থাকার কারণে আকাশে প্রতিবন্ধকতা থাকা অবস্থায় ইফতার শিগগির করা মুস্তাহাব নয়; বরং এ রকম দিনে একটু সময় নিয়ে বিলম্বে ইফতার করবে। বিলম্বে ইফতার করা মাকরূহ তখন যখন আকাশ পরিষ্কার থাকবে অথবা সূর্যের আলো ডুবা পর্যন্ত বিলম্ব করে ইফতার করা মাকরূহ।
ইফতারের দোয়া
হযরত মুয়ায ইবন যোহরা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী কারীম যখন ইফতার করতেন তখন এই দোয়াটি পাঠ করতেন—
ইফতারের দোয়া আরবি:
اللَّهُمَّ لَكَ صُمْتُ وَعَلَى رِزْقِكَ أَفْطَرْتُ
ইফতারের দোয়া বাংলা : আল্লাহুম্মা লাকা ছুমতু ওয়া আলা রিজকিকা আফতারতু
ইফতারের দোয়া বাংলা অর্থসহ: “হে আল্লাহ! কেবল তোমার উদ্দেশ্যেই রোযা রেখেছি এবং তোমার দেয়া রিযিক দিয়েই ইফতার করছি।
ইফতারের পরে এই দোয়াটি পড়বেন,
ذهَبَ الظُّمَأُ وَابْتَلَتِ الْعُرُوْقُ وَثَبَتَ الْأَجْرُ إِنْ شَاءَ اللَّهُ
“পিপাসা দূরীভূত হয়েছে, ধমনীগুলো শীতল হয়েছে আর যদি আল্লাহ চান তো প্রতিদানও নির্ধারিত হয়েছে।
আরও পড়ুন: তারাবির নামাযের দোয়া ও নিয়ত
শেষকথা:
রোজা বান্দার প্রতি আল্লাহ তায়ালার এক অনুগ্রহ মাত্র। আল্লাহ তায়ালা বলেন রোযা আমার আর রোযার প্রতিদান আমার নিজ হাতে দিব (সুবহানআল্লাহ) । আমাদের উচিত রমযানের সকল নিময় কানুন জেনে সঠিকভাবে রোযা রাখা ও ইফতারের দোয়া ও নিয়ম জেনে সঠিক সময়ে ইফতার করা। আমিন