বাংলাদেশের প্রকৃতি কন্যা জাফলং এক অসম্ভব সুন্দর দর্শনীয় স্থান। প্রতিবছর লাখো প্রকৃতি প্রেমীদের গমনাগমন হয় সিলেটের জাফলং এ। হয়তো আপনিও ভাবছেন প্রকৃতির সেই নিবিড় সৌন্দর্যের স্বাদ নিতে নিজে, পরিবারের সাথে অথবা বন্ধু-বান্ধবের সাথে গ্রুপ করে যাবেন জাফলং ভ্রমণ করতে। তবে জাফলং যাওয়ার পূর্বেই জানা উচিত জাফলং ভ্রমণ সম্পর্কে বিস্তারিত।
অপরূপা জাফলং
জাফলং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দিক থেকে সত্যিকারের রত্ন। প্রকৃতিকন্যা নামেই চিনে থাকি এই জাফলংকে। সবুজ পাহাড় এবং উপত্যকায় ঘেরা এটি বর্তমানে দেশের অন্যতম একটি মনোরম পর্যটন কেন্দ্র। জাফলং এর সৌন্দর্য লক্ষ্য করা যায় এর স্বচ্ছ নদী পিয়াইন, উপত্যকা, চারপাশের প্রাকৃতিক দৃশ্য, পাথর, নুড়ি ইত্যাদিতে ভরা। জাফলংয়ের সৌন্দর্য কে সরাসরি না দেখে তার স্বাদ নেওয়া যায়না।
সীমান্তের ওপারে ইন্ডিয়ান পাহাড় টিলা, ডাউকি পাহাড় থেকে অবিরাম প্রবাহমান জলপ্রপাত, ঝুলন্ত ডাউকি ব্রীজ, পিয়াইন নদীর স্বচ্ছ হীম ঠান্ডা পানি,উঁচু পাহাড় গুলোতে গহিন অরণ্য এবং নিরবতা সত্যিই আশ্চর্যকর এবং মনোমুগ্ধকর। সিলেট ভ্রমণে এসে জাফলং ভ্রমণ করতে না গেলে ভ্রমণের স্বাদ অপূর্নই থেকে যাবে।
জাফলং ভ্রমণ এর অন্যতম সৌন্দর্য হচ্ছে পিয়াইন নদী, যা উপত্যকার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। নফীর অয়ানিতে প্রতিফিলিত হয় আশেপাশের উচু উচু পাহাড়গুলো। সেখানে নৌকাভ্রমণ করা টাই মূল আকর্ষন। সেখানে রয়েছে অনন্য সব পাথর, যা এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। আসেপাশে থাকা পাহাড়ের চলমান ক্ষয়ের ফলেই আজকের এই ছোট ছোট পাহাড়গুলো তৈরি। এর মধ্যে কিছু পাথর এত বড় যে সেগুলোর ওজন কয়েকটক টন পর্যন্ত হয়ে থাকে। এই হাজারো পাথরগুলো কাছ থেকে দেখা, পানি প্রবাহের মধ্য দিয়ে সেই পাথরে বসার স্বাদ নিতে চায় সকল পর্যটকরা।
জাফলং তার চা বাগানের জন্য সমগ্র দেশ জুড়েই বিখ্যাত। বিশাল বিশাল চা বাগান এই এলাকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অনেকগুনে বৃদ্ধি করে। চা বাগান গুলো ঢেকে রাখে সেখানে থাকা পাহাড়কে। পর্যটকরা সেখানে প্রকৃতির নির্মল স্বাদ অনুভব করে ঘুরে বেড়ায় চা বাগানে। সেখানের চা শ্রমিকদের দৈনন্দিন কার্যকলাপ ও জীবনযাপনের ধরনও উপভোগ করা যায়।
এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাশেই রয়েছে চুনাপাথরের উৎপাদন। চুনাপাথরকে মূলত সিমেন্ট উৎপাদনে ব্যবহার করা হয়। আশেপাশের চুনাপাথরের খনি, খনির গভীর গর্ত আশেপাশের পাহাড়ি সৌন্দর্যও দেখার মতো।
জাফলংয়ের স্থানীয় সংস্কৃতি ও সেখানের খাবার উপভোগ করার মতো। স্থানীয় জনসংখ্যা বিভিন্ন জাতিসত্তার সংমিশ্রণ এবং তাদের সংস্কৃতি ঐতিহ্য গুলোতে রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন আকর্ষন। অনেক পর্যটক স্থানীয়দের সাথে ভাব বিনিময় ও খাবারের স্বাদ নেওয়াটা অনেকটাই উপভোগ করে। সেখানে থাকা বাজারগুলো স্থানীয় হস্তশিল্প এবং গহনা সহ অন্যান্য কেনাকাটার জন্য একটি দুর্দান্ত জায়গা।
সব মিলিয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, স্বচ্ছ নদী, অনন্য পাথর, বিস্তীর্ণ চা বাগান, চুনাপাথর খনি এবং স্থানীয় সংস্কৃতি, খাবার, হস্তশিল্প ইত্যাদি একজন জাফলং ভ্রমণ কারীকে বিমোহিত করে। আপনার দর্শনের জন্যও সেরা একটি স্থান হতে পারে জাফলং।
জাফলং এর অবস্থান
জাফলং বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত একটি জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র। এটি ভারতের মেঘালয় রাজ্যের সীমান্তবর্তী সিলেট জেলার গোয়াইনঘাট উপজেলায় খাসিয়া-জৈন্তা পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত। পিয়াইন নদী উপত্যকার কেন্দ্রস্থল দিয়ে প্রবাহিত এবং চারপাশে সবুজ পাহাড়ের সাথে পাহাড় চিড়ে বয়ে চলেছে অনবরত ঝর্না। আসেপাশে সাজানো নানান রঙের নুড়ি পাথর। সিলেট শহর থেকে প্রায় ৬২ কিলোমিটার দূরে সড়কপথে জাফলংয়ের অবস্থান। সিলেট শহর থেকে জাফলং ভ্রমণ এ যাওয়ার জন্য নিয়মিত বাস ও ব্যক্তিগত গাড়ির সেবাও পাওয়া যায়। এছাড়াও নিকটতম বিমানবন্দর হল ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, যা সিলেটে অবস্থিত।
জাফলং ভ্রমণ এর উপযুক্ত সময়
জাফলং ভ্রমণে দর্শনার্থীরা বেশিরভাগই বেশে নেয় বর্ষাকালকে। তবে আপনি চাইলে যেকোন সময়েই যেতে পারেন জাফলং ভ্রমণ করতে। জাফলং এর সৌন্দর্য ভিন্ন মৌসমে ভিন্ন রূপ ধারন করে। বর্ষায় জাফলং কে দেখা যায় ভিন্ন লাবন্যময় রূপে। পরিবেশ যেন নতুন করে প্রান ফিরে পায়, হয়ে উঠে স্বচ্ছ। স্নিগদগ্ধ সেই পরিবেশ মনের মাঝে অনুভূত হয় ফুরফুরে ভাব। পাশের খাসিয়া পাহাড়ের চূড়ায় সবুজ রঙের পাশ দিয়েই বিচরন করে সাদা মেঘ। হঠাৎ করেই যখন তখন শুরু হয় অঝোরধারায় পাহাড়ি বৃষ্টি। সেই সাথে সুউচ্চ পাহাড় থেকে নেমে আসে সাদা ঝর্ণাধারা। যে দৃশ্য সকলেরই নয়ন জুড়ায় এবং মনে এনে দেয় এক ভিন্ন শিহরন।
অন্যদিকে, শীতে ভিন্ন রূপে দেখা যায় জাফলংকে। চারিদিকে গভীর সবুজ অরন্য, সুবিশাল পাহাড়ের চূড়া, হালকা নিবিড় কুয়াশা। সব মিলিয়ে ঠান্ডা পরিবেশ ভালোই স্বাদ নেওয়া যায় জাফলংয়ের। তাই আপনার সুবিধা অনুযায়ী বছরের যেকোন সময়েই যেতে পারেন জাফলংয়ে।
জাফলং কিভাবে যাবেন
বাংলাদেশের যেকোন স্থান থেকে সড়ক, রেল এবং আকাশপথে যেতে পারবেন জাফলং ভ্রমণ করতে। ঢাকা থেকে সিলেটের দূরত্ব প্রায় ২৪০ কিলোমিটার। সেখানে যেতে সময় লাগে প্রায় ৬-৮ ঘণ্টা পর্যন্ত।
ঢাকা থেকে বাসে সিলেট
ঢাকার গাবতলী, ফকিরাপুল, মহাখালী এবং সায়েদাবাদ বাস স্ট্যান্ড থেকে বাস ছেড়ে যায় সিলেটের উদ্দেশ্যে। বাসগুলো সাধারনত সকাল থেকে রাত ১২.৪৫ মিনিট পর্যন্ত তাদের ম্যানুয়ালি নির্দিষ্ট সময় পরপর তাদের যাত্রা শুরু করে।
সৌদিয়া এস আলম পরিবহন, গ্রীন লাইন পরিবহন, এনা পরিবহন, শ্যামলি পরিবহনের এসি বাসগুলোতে ভ্রমণ করতে পারেন। এই বাসগুলোর ভাড়া হয়ে থাকে ৮০০-১২০০ টাকা পর্যন্ত। তবে নন এসি বাসে ক্ষেত্রে হানিফ এন্টারপ্রাইজ, শ্যামলী পরিবহন, ইউনিক সার্ভিস, এনা পরিবহনেও সিলেট যেতে পারেন। সেক্ষেত্রে ভাড়া হবে ৪০০-৫০০ টাকার মধ্যে। বাসে যেতে সময় লাগে প্রায় ৬-৮ ঘন্টা।
ঢাকা থেকে ট্রেনে সিলেট
ঢাকা থেকে সিলেটের ট্রেনে গেলে সময় লাগে ৭-৮ ঘন্টা।
- ঢাকার কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে ছেড়ে যায় আন্তঃনগর ট্রেন পারাবত এক্সপ্রেস। মঙ্গলবার ছাড়া সপ্তাহের প্রতিদিন সকাল ৬:৪০ মিনিটে এই ট্রেনটি যাত্রা শুরু করে।
- সপ্তাহের প্রতিদিন জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস যাত্রা করে দুপুর ২ টায়।
- বুধবার ছাড়া সপ্তাহের প্রতিদিন রাত ৯ঃ৫০ মিনিটে যাত্রা করে উপবন এক্সপ্রেস।
- শুক্রবার ছাড়া প্রতিদিন বিকাল ৪ টায় ছাড়ে কালনী এক্সপ্রেস।
সাধারণত ভাড়া হয়ে থাকে ৩২০ টাকা থেকে ১০৯৯ টাকা পর্যন্ত। ট্রেনে ভ্রমণের ক্ষেত্রে রাতে গমন করাই ভালো। সকাল হতে হতে পৌঁছে যাওয়া যায় সিলেট। তাই রাত ৯ঃ৫০ মিনিটে উপবন এক্সপ্রেস আপনার যাত্রা শুরু করে সারারাত ট্রেনে ঘুমিয়ে সকাল থেকেই আপনার সিলেটে জাফলং ভ্রমণ শুরু করতে পারবেন।
আকাশপথে সিলেট
জাফলং ভ্রমণ এর জন্য ঢাকা থেকে সবচেয়ে দ্রুত সিলেট যেতে পারবেন আকাশ পথে ভ্রমণের মাধ্যমে। ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ইউএস বাংলা, ইউনাইটেড এয়ার, রিজেন্ট এয়ার, নভোএয়ার, বিমান বাংলাদেশে করে সিলেটে যেতে পারবেন স্বল্প সময়ে। এক্ষেত্রে প্রতি সিটের জন্য বিমানের ক্লাস অনুযায়ী টিকেটের মূল্য হতে পারে ৩৫০০ থেকে ১০০০০ টাকা পর্যন্ত।
সিলেট থেকে জাফলং
সিলেটের মূল শহর থেকে জাফলংয়ের দূরত্ব প্রায় ৬২ কিলোমিটার। সেখান থেকে জাফলং যেতে প্রায় দেড় থেকে দুই ঘন্টা সময় লাগে। বাস, মাইক্রোবাস, লেগুনা, সিএনজিতে করে যেতে পারবেন জাফলং ভ্রমণ করতে। সেখানে কদমতলী থেকে জাফলং যাওয়ার বাস পাওয়া যায়। জনপ্রতি লোকাল বাস ভাড়া ৭০ টাকা এবং বিরতিহীন গেইট লক বাস ভাড়া ১০০ টাকা। এছাড়াও সিলেট শহরের সোবহানীঘাট থেকেও বাসে যেতে পারবেন জাফলং।
রির্জাভ গাড়িতে জাফলং ভ্রমণ করতে যেতে পারবেন বন্দরবাজার শিশু পার্কের সামনে থেকে সিএনজি, লেগুনা কিংবা মাইক্রোবাসে। সিলেটের প্রায় সব জায়গা থেকেই রিজার্ভ গাড়ি পেয়ে যাবেন জাফলং যাওয়ার জন্য। জাফলং যাওয়া আসার জন্য রিজার্ভ সিএনজি ভাড়া ১২০০ থেকে ১৫০০ টাকা, লেগুনা ভাড়া ২০০০ থেকে ২৫০০ টাকা, মাইক্রোবাস ভাড়া রিজার্ভ ৩০০০ থেকে ৫০০০ টাকা পর্যন্ত। একসাথে অনেকজন জাফলং ঘুরতে যেতে চাইলে রিজার্ভ গাড়ি নেওয়াই ভালো। এক্ষেত্রে জাফলং এর আশেপাশের স্থানগুলোও সহজেই ঘুরতে পারবেন।
জাফলং ভ্রমণ করতে রিজার্ভ গাড়ি ঠিক করার পূর্বে অবশ্যই কোন কোন স্থানে ঘুরতে চান তা বলে দরদাম ঠিক করে নিন। জাফলং যাওয়ার রাস্তাতেও পাবেন অনন্য আনন্দ। সেখানে রাস্তায় এখন অত্যন্ত উন্নত এবং মনোরম দৃশ্য সমৃদ্ধ।
জাফলংয়ে থাকার ব্যবস্থা
জাফলং এর জেলা পরিষদের বাংলো ছাড়া তেমন কোনো ভালো থাকার জায়গা নেই। তাই জাফলং ভ্রমণ কারী পর্যটকেরা বেশিরভাগই রাত্রিযাপনের জন্য সিলেটে ফিরে আসেন। আপনি যদি জাফলংয়েই থাকতে চান তাহলে মামার বাজার এলাকায় জাফলং ইন হোটেল, হোটেল প্যারিস ও আরো কিছু রেস্ট হাউজ পাবেন। এছাড়াও জৈন্তিয়া হিল রিসোর্ট থেকে জাফলং এর অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন।
সিলেটের বেশিরভাগ ভালো মানের হোটেল শাহজালাল মাজারকে ঘিরে অবস্থিত। সেখানে দরগাগেট, কদমতলী, তালতলা, লামাবাগান, আম্বরখানা ইত্যাদি স্থানে ভালো মানের আবাসিক হোটেল পাওয়া যায়। দরগা গেটে কম খরচে ৫০০ থেকে ১০০০ টাকায় মানসম্মত হোটেল পাওয়া যায়।
সিলেটের ভালো মানের আবাসিক হোটেলগুলো হলো- হলি ইন, হোটেল হিল টাউন, সুরমা, পানসি ইন, লা ভিস্তা হোটেল, কায়কোবাদ, হোটেল হলি গেইট, ব্রিটানিয়া হোটেল, হোটেল মেট্রো ইন্টারন্যাশনাল ইত্যাদি। এ সকল হোটেলে খরচ হতে পারে ২০০০ থেকে ১০০০০ টাকা পর্যন্ত। এছাড়াও লালা বাজার এলাকায় মাত্র ৪০০ থেকে ৫০০ টাকায় বিভিন্ন মানের হোটেলে থাকতে পারবেন।
জাফলং ভ্রমণ এ আপনি যদি সিলেটের লাক্সারি হোটেল ও রিসোর্টে থাকতে চান সেক্ষেত্রে হোটেল নুরজাহান গ্র্যান্ড, রোজ ভিউ হোটেল, নিরভানা ইন, গ্র্যান্ড প্যালেস, নাজিমগড় রিসোর্ট ইত্যাদি হোটেলে থাকতে পারেন। সেই হোটেল গুলোতে প্রতিরাতের জন্য খরচ হতে পারে ৮০০০ থেকে ৩০০০০ টাকা পর্যন্ত।
জাফলংয়ে খাবারের ব্যবস্থা
জাফলং ভ্রমণ এ খাবারের জন্য পাবেন জাফলং পর্যটক রেস্টুরেন্ট, জাফলং ভিউ রেস্টুরেন্ট, সীমান্ত ভিউ রেস্টুরেন্ট এছাড়াও বিভিন্ন সাধারণ হোটেল। তবে জাফলং রেস্টুরেন্টের পরিমাণ কম হওয়ায় খাবারের মূল্য কিছুটা বেশি। তাই সিলেট শহরে খাবার খেতে চাইলে জিন্দাবাজার এলাকার পানসী, পাঁচ ভাই, পালকি রেস্টুরেন্ট উল্লেখযোগ্য।
এই রেস্টুরেন্ট গুলোতে সুলভ মূল্যে বিভিন্ন প্রকার ভর্তা, খিচুড়ি, মাংসের বিভিন্ন প্রকার খাবার পাবেন। জনপ্রতি সকালের নাস্তা খরচ হতে পারে ৫০-১০০ টাকা এবং দুপুরের খাবারে খরচ হতে পারে ১৫০-২০০ টাকা। এছাড়াও আপনার পছন্দমত বিভিন্ন রকমের খাবার সেখানে খেতে পূর্বেই দাম জেনে নিতে পারেন।
জাফলং এর পার্শ্ববর্তী অন্যান্য দর্শনীয় স্থান
প্রকৃতির রূপসোভার স্থান জাফলং ভ্রমণ এর পাশাপাশি আরও বেশ কিছু ভ্রমণ উপযোগী ও দর্শনীয় স্থান রয়েছে। যেমন- লালাখাল, ভোলাগঞ্জের সাদা পাথর, তামাবিল, জৈন্তাপুর, সংগ্রামপুঞ্জি ঝর্ণা বা মায়াবী ঝরনা, রাতারগুল, শাপলা বিল ইত্যাদি দর্শনীয় স্থান। চলুন সেই স্থানগুলোর ভ্রমণ ধারনা সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক-
লালাখাল
লালাখাল জাফলং ভ্রমণ কারীদের জন্য সিলেটের একটি জনপ্রিয় পর্যটন গন্তব্য। এটি স্ফটিক-স্বচ্ছ নীল পানি এবং শ্বাসরুদ্ধকর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য পরিচিত। চারপাশের পাহাড় গুলো সবুজ গাছে আচ্ছাদিত, ঘূর্ণায়মান নদী এবং এলাকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এটিকে প্রকৃতি প্রেমীদের জন্য অবশ্যই দর্শনীয় গন্তব্য করে তুলেছে।
লালাখালের সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় হলো এর গভীর নীল পানি এবং সবুজ পাহাড়ের মধ্যে রঙের ভিন্নতা। লালাখালের পানি এতটাই স্বচ্ছ যে নদীর তলদেশে থাকা পাথর ও নুড়ি দেখা যায় সহজেই। এছাড়াও সেখানকার পানি শীতল এবং সতেজ, যা সাঁতার কাটা, বোটিং এবং মাছ ধরা উপভোগ করার জন্য একটি আদর্শ জায়গা। নদীর চারপাশের পাহাড় গুলো ঘন বন এবং চা বাগানে আচ্ছাদিত একটি নিবিড়-শান্ত পরিবেশ। এছাড়াও এখানে রয়েছে পাখি, বানর ও হরিনসহ বিভিন্ন বন্যপ্রানীর আবাসস্থল।
সিলেটের জাফলং ভ্রমণ করতে গেলে অবশ্যই এই স্থান ঘুরে আসতে পারেন।
রাতারগুল
রাতারগুল সিলেট বিভাগে অবস্থিত একটি মিঠা পানির জলাভূমি। এটি একটি অনন্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের স্থান, যা পর্যটকদের বিস্মিত করে তোলে। রাতারগুলের সৌন্দর্য নিহিত তার সবুজ, স্বচ্ছ পানি এবং সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্যে।
রাতারগুলের বনটি উচু উচু গাছে ভরা, যার মধ্যে কিছু কিছু ১০০ বছরেরও বেশি পুরনো। সকল গাছগুলো মিলে তৈরি করে একটি ঘন ছাউনি যা বিভিন্ন ছোট উদ্ভিদ ও প্রাণী জাতিকে ছায়া ও আশ্রয় প্রদান করে। বনের জলাশয়ের পানি খুবই স্বচ্ছ এবং সবুজ, যাতে উপরের নীল আকাশ প্রতিফলিত হয়। এটি একটি অত্যাশ্চর্য আয়নার মতো দেখতে। পর্যটকরা সেখানে বনের মধ্য দিয়ে নৌকায় যাত্রা করতে পারেন এবং নির্মল ও শান্ত পরিবেশে নিজেকে নিমজ্জিত করতে পারেন।
রাতারগুল বিভিন্ন প্রজাতির পাখি, সরীসৃপ, মাছ, স্তন্যপায়ী প্রাণী সহ বিভিন্ন ধরণের বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল। এটি বিশ্বের সেরা মিঠাপানির জলাভূমির মধ্যে একটি। প্রকৃতির মধ্যে এটি গড়ে তুলেছে একটি অনন্য এবং মূল্যবান বাস্তুতন্ত্র।
রাতারগুলের সৌন্দর্য শুধু এর প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, এই এলাকার মানুষ ও সংস্কৃতিতেও রয়েছে। স্থানীয় জনগোষ্ঠীর রয়েছে এই বনের সাথে গভীর সম্পর্ক। এবং তারা এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সরাসরি জড়িত। দর্শনার্থীরা স্থানীয় জনগণের উষ্ণ মনোভাব এবং আতিথেয়তা অনুভব করে এবং তাদের ঐতিহ্যগত জীবনধারা সম্পর্কে জানতে পারে।
সব মিলিয়ে ভ্রমণের জন্য রাতারগুলের সৌন্দর্য এর প্রাকৃতিক পরিবেশ, স্বচ্ছ পানি এবং বৈচিত্র্যময় বন্যপ্রাণীর মধ্যে রয়েছে। তাই আপনি প্রকৃতির স্বাদ নিতে চাইলে অবশ্যই ঘুরে আসতে পারেন জাফলং ভ্রমণ এ রাতারগুল।
তামাবিল
তামাবিল জাফলং এর উপত্যকায় অবস্থিত একটি দর্শনীয় স্থান। এটি বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্তে অবস্থিত। তামাবিল তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, নির্মল পরিবেশ এবং সংস্কৃতির জন্য বিখ্যাত। তামাবিলের অন্যতম আকর্ষণ হলো তামাবিল-জাফলং সড়ক। জাফলং ভ্রমণ করে তামাবিল যেতে রাস্তার পাশেই রয়েছে পাহাড়, সবুজ চা বাগান এবং একটি প্রবাহিত নদীর শ্বাসরুদ্ধকর দৃশ্য। তামাবিলে পৌছানোর পূর্বেই গাড়িতে ভ্রমণের সময় এলাকার মুগ্ধকরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারেন।
তামাবিলের জাফলং উপত্যকার মনোরম ল্যান্ডস্কেপের জন্য বিশেষভাবে পরিচিত। স্বচ্ছ জলাশয়ের পানি পাথরের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়, যার চারপাশে সবুজ পাহাড় রয়েছে, আহ কি মনোরম দৃশ্য। স্থানটি পাথর সংগ্রহ করার জন্যও বিখ্যাত। বিভিন্ন শ্রমিকরা সেখানে নদীর তলদেশ থেকে পাথর সংগ্রহ করে থাকেন।
তামাবিলের একটি উল্লেখযোগ্য সাংস্কৃতিক তাৎপর্যও রয়েছে। এটি বিখ্যাত খাসিয়া উপজাতির আবাসস্থল। খাসিয়া উপজাতিরা তাদের অনন্য জীবনধারা এবং ঐতিহ্যের জন্য পরিচিত। পর্যটকরা সেখানে তাদের ঐতিহ্যবাহী জীবনধারার অভিজ্ঞতা লাভ করতে পারে এবং তাদের সাথে কথা বলে মাধ্যমে তাদের সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে পারেন সহজেই।
ভ্রমণের জন্য এই তামাবিল একটি সুন্দর স্থান যা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সংস্কৃতি এবং অ্যাডভেঞ্চারের একটি নিখুঁত সংমিশ্রণ। তাই আপনার জাফলং ভ্রমণ এ এই স্থানটিও রাখতে পারেন।
জৈন্তাপুর
জৈন্তাপুর ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের একটি ছোট শহর। এই শহরে জৈন্তাপুর রাজবাড়ি সহ বেশ কয়েকটি ঐতিহাসিক স্থান রয়েছে। জাফলং ভ্রমণ এর পাশাপাশি দেখতে পাবেন জৈন্তাপুরের রাজকীয় প্রাসাদ টি, যা ১৭ শতকে নির্মীত হয়েছিলো।
জৈন্তাপুরের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এর লীলাভূমি এবং প্রাকৃতিক দৃশ্য। এই শহরটি পাহাড়, বন এবং চা বাগান দ্বারা বেষ্টিত। প্রকৃতি প্রেমীদের জন্য একটি নিখুঁত প্রশান্তিদায়ক স্থান। চারিদিকের চোখ মেললেই পাহাড়, বিস্তৃত চা বাগান, এবং আদিম জলপ্রপাত। সব মিলিয়ে অত্যন্ত মনোরম দৃশ্য তৈরি করে।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ছাড়াও জৈন্তাপুর তার প্রাণবন্ত স্থানীয় সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের জন্য বিখ্যাত। শহরটি অনেক গুলো জাতিগত সম্প্রদায়ের আবাসস্থল। প্রতিটি জাতির রয়েছে নিজস্ব নিজস্ব রীতিনীতি এবং বিশ্বাস। পর্যটকরা তাদের ঐতিহ্যবাহী উৎসবে যোগদান, স্থানীয় খাবারের স্বাদ গ্রহণ এবং বন্ধুত্বপূর্ণ স্থানীয়দের সাথে আলাপচারিতার মাধ্যমে স্থানীয় সংস্কৃতি সম্পর্কে ব্যাপক ধারনা লাভ করে থাকে।
সব মিলিয়ে ভ্রমণের জন্য জৈন্তাপুর একটি সুন্দর এবং নির্মল গন্তব্য যা ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের একটি নিখুঁত সংমিশ্রন। তাই আপনি সিলেটের জাফলং ভ্রমণ করতে চাইলে এই স্থানটিও ভ্রমণ করতে পারেন।
আরো পড়ুন: শ্রীমঙ্গল দর্শনীয় স্থান, হোটেল ও রিসোর্ট
সংগ্রামপুঞ্জি ঝর্ণা বা মায়াবী ঝর্ণা
সংগ্রামপুঞ্জি ঝর্ণা বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের একটি অত্যাশ্চর্য জলপ্রপাত। একে মায়াবী ঝরনাও বলা হয়। জলপ্রপাতটি একটি প্রত্যন্ত এলাকায় অবস্থিত। এর চারপাশে সবুজ বন এবং পাহাড় দ্বারা বেষ্টিত। ফলে প্রকৃতি প্রেমীদের জন্য জাফলং ভ্রমণ এর পাশাপাশি এটি একটি উপযুক্ত গন্তব্য হয়ে দাড়িয়েছে।
জলপ্রপাতটি ৩০ ফুটের বেশি উচ্চতাসম্পন্ন এবং এর থেকে স্বচ্ছ পানি নিচের পুলে নেমে আসছে ধারাবাহিকভাবে। যা একটি মুগ্ধকর দৃশ্য তৈরি করে পর্যটকদের বিস্মিত করে। এই ঝরনার পানি এতটাই পরিষ্কার যে পানির নিচে পাথর এবং বালি দেখতে পাওয়া যায়।
আশেপাশের অঞ্চলটি বিস্তৃত উদ্ভিদ এবং প্রাণীর আবাসস্থল। এছাড়াও পর্যটকরা এখানে জলপ্রপাতের চারপাশের বনে বিভিন্ন প্রজাতির পাখি, বানর এবং অন্যান্য বন্যপ্রাণী দেখতে পারেন।
এই আশ্চর্যকর মায়াবী ঝরনা, আশেপাশের বন এবং বন্যপ্রাণী ইত্যাদি উপাদান বাংলাদেশের প্রাকৃতিক গভীর সৌন্দর্য উপভোগ করতে সহায়তা করে। তাই জাফলং ভ্রমণ করতে গেলে এই স্থানেও ভ্রমণের স্বাদ গ্রহন করতে পারেন।
ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর
ভোলাগঞ্জ বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত একটি ছোট গ্রাম। এটি উচ্চমানের শ্বেতপাথর উৎপাদনের জন্য পরিচিত। ভোলাগঞ্জের শ্বেতপাথরের সৌন্দর্য নিহিত রয়েছে এর বিশুদ্ধতা ও অনন্য গঠনের মধ্যে।
ভোলাগঞ্জের শ্বেতপাথর চুনাপাথর থেকে তৈরি হয় এবং এর রঙে আয়রন অক্সাইড মতো উপাদান নেই। ফলে এই পাথরের একটি বিশুদ্ধ সাদা আভা প্রকাশ পায়। এছাড়াও পাথরের স্থায়িত্ব অনেক বেশিএবং আবহাওয়ার সাথে মানানসই। তাই নির্মানকাজের জন্য এই পাথর অনেক বেশি চাহিদাসম্পন্ন।
বর্তমানে ভোলাগঞ্জ সাদাপাথর উৎপাদন, স্থাপত্য নকশা তৈরি, প্রাচীর ক্ল্যাডিং এবং কাউন্টারটপের মতো অলংকারিক নকশার বাহার দেখতে অনেকে যায় সেখানে। এছাড়াও রয়েছে প্রকৃতি প্রেমীদের জন্য সেরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। তাই সিলেট- জাফলং ভ্রমণ করতে গেলে আপনিও ঘুরে আসতে পারেন এই গ্রামটিতে।
জাফলং ভ্রমণ টিপস
- জাফলংয়ে গ্রুপ করে একসাথে ভ্রমণ করলে স্বল্প খরচে অধিক আনন্দ পাবেন।
- জাফলং এর পাশাপাশি আশেপাশের দর্শনীয় স্থানগুলো উপভোগ করুন।
- সিলেট থেকে জাফলং যেতে গাড়ি ঠিক করতে দরদাম করে নিন।
- জাফলং এর কোন কিছু কিনতে বা খেতে চাইলে দরদাম করে নিন।
- পানিতে নামার পূর্বে সতর্ক থাকুন। অনেক স্থানে বেশ গভীর।
- জাফলং সীমান্তবর্তী এলাকা তাই সীমান্ত নির্দেশনা মেনে চলুন।
- স্থানীয়দের সাথে সুন্দর ব্যবহার করুন তবে ঘনিষ্ঠ না হওয়াই ভালো।
Faq
সিলেট থেকে জাফলং এর দূরত্ব কত?
৬২ কি.মি।
জাফলং কিসের জন্য বিখ্যাত?
জাফলং সিলেট জেলা তথা বাংলাদেশের অন্যতম দর্শনীয় স্থান যা সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলায় ভারতের মেঘালয় রাজ্য সীমান্ত ঘেঁষে অবস্থিত। সিলেট থেকে জাফলং এর দুরত্ব মাত্র ৬২ কিলোমিটার। পিয়াইন নদীর স্বচ্ছ পানির ধারা, ভারতের ঝুলন্ত ডাউকি ব্রিজ, বিরাট উঁচু উঁচু পাহাড়ে সাদা মেঘের খেলা জাফলংকে করেছে অতুলনীয়।
জাফলং এর নদীর নাম কি?
জাফলং নদী বা ডাউকি নদী বাংলাদেশ-ভারতের একটি আন্তঃসীমান্ত নদী।
সিলেট থেকে জাফলং ভাড়া কত টাকা?
সিলেট থেকে জাফলং যাওয়া-আসা সহ সারাদিনের জন্যে রিজার্ভ সিএনজি ভাড়া লাগবে ১২০০ থেকে ১৫০০ টাকা, মাইক্রোবাস রিজার্ভ নিলে ভাড়া লাগবে ৩০০০ থেকে ৫০০০ টাকা। লেগুনা ২০০০-২৫০০ টাকা । একসাথে কয়েকজন ঘুরতে গেলে গাড়ি রিজার্ভ করে নেওয়া ভাল হবে এবং যাওয়ার পথে বিছনাকান্দিসহ অন্যান্য দর্শনীয় স্থান ঘুরে দেখতে পারবেন।
সিলেট কিসের জন্য বিখ্যাত?
সিলেট জেলা চা-পাতা, কমলালেবু, সাত রঙের চা, সাতকড়ার আচার এর জন্য বিখ্যাত।
সর্বশেষ
পরিবারের সাথে কিংবা বন্ধু বান্ধবের সাথে গ্রুপ করে অবসর সময়ে উপরোক্ত ভাবে চলে যেতে পারেন জাফলং ভ্রমণ করতে। জাফলং ভ্রমণ এর এই মনোরম সৌন্দর্যের ব্যাখ্যা শেয়ার করুন আপনার প্রিয় বন্ধুদের সাথে।