সিলেটের জায়গীরদার খান বাহাদুর আবু নছর মোহাম্মদ এহিয়া ওরফে জিতু মিয়ার আবাসস্থল ‘জিতু মিয়ার বাড়ি’ হিসেবে পরিচিত। মুসলিম স্থাপত্য কলার অনন্য নিদর্শন এ দালানটি নির্মাণ করেছিলেন খান বাহাদুর আবু নছর মোহাম্মদ এহিয়া ওরফে জিতু মিয়া। এটি সিলেটের অন্যতম প্রধান দর্শনীয় স্থান গুলোর মধ্যে একটি।
“চাদঁনী ঘাটের সিড়িঁ,
আলী আমজাদের ঘড়ি,
বঙ্কু বাবুর দাড়ি,
জিতু মিয়ার বাড়ি”
সিলেটের পরিচিতিতে বহুল প্রচলিত এই লোকগাঁথা।
জিতু মিয়ার বাড়ির অবস্থান
সিলেট নগরীর শেখঘাটে কাজীর বাজারে দক্ষিণ সড়কে অবস্থিত এই বাড়িটি। খান বাহাদুর আবু নছর মোহাম্মদ এহিয়া ওরফে জিতু মিয়া এই বাড়িটি নির্মাণ করেন। ১৮৯১ সালে এ বাড়ির সামনের দালানটি নির্মাণ করা হয়। বর্তমান কাজীর বাজার পশুর হাটের স্থানে অবস্থিত ছিলো পূর্বে এই বাড়িটি। ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে জিতু মিয়ার বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হলে ১৯১১ সালে বর্তমান স্থানে স্থানাস্তর ও সংস্কার করা হয়।
জিতু মিয়ার বাড়ির বর্ণনা
১৮৮৬ সালে জিতু মিয়ার বাবা মাওলানা আবু মোহাম্মদ আব্দুল কাদির এই মূল বাড়ীটি নির্মাণ করেন। এই বাড়িটি মোট ১ দশমিক ৩৬৫ একর জায়গা জুড়ে অবস্থিত। এই বাড়িটি চুন ও সুরকি দিয়ে মুঘল আমলের মুসলিম স্থাপত্য শৈলীতে নির্মিত। এটি দ্বিতল ভবন বিশিষ্ট একটি বাড়ি। ১৮৯৭ সালের প্রলয়ঙ্করকারী ভূমিকম্পে সিলেট ও আসামের অধিকাংশ স্থাপনার মতো এটিও অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরবর্তীতে ১৯১১ সালে জিতু মিয়ার বাড়ি টির সামনের অংশে একটি নতুন দালানটি নির্মাণ করেন; যা বর্তমানে মূল ভবন হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
বাড়িটি ইতিহাস ও বিখ্যাত হওয়ার কারন
খান বাহাদুর আবু নছর মোহাম্মদ এহিয়া ওরফে জিতু মিয়া (১৮৫১-১৯২৫) তিনি তার জীবনের প্রথম কিছু দিন সাব রেজিস্টার ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি এই চাকরি ছেড়ে দেন। ১৮৯৭ থেকে ১৯০৩ সাল পযর্ন্ত তিনি সিলেট অনারীর মেজিস্ট্রেট ছিলেন ও পৌরসভার ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন।
সিলেটের সে সময়ের এক অন্যতম আলোচিত বিষয় ছিল জিতু মিয়ার বাড়ি , পরিবারের বিলাসী জীবন যাত্রা ও জাকঁজমক চলাফেরা। প্রতিদিন শত শত লোকজন জরুরী প্রয়োজনে গ্রাম থেকে শহরে আসা মানুষগুলো জিতু মিয়ার বাড়িতে আতিথেয়তা গ্রহণ করতেন। কথিত আছে যে জিতু মিয়ার পরিবারে সবসময় ১২২টি চুলোয় রান্নাবান্না হত।
সিলেট সার্কিট হাউস গঠনের আগে খান বাহাদুরের বসত বাড়ি জিতু মিয়ার বাড়ি, এহিয়া ভিলা, সাব বাড়ি, কাজি বাড়ি ইত্যাদি নামে বাড়ি ছিল। তৎকালীন উপমহাদেশের খ্যাতনামা নেতৃবৃন্দ, যেমন- মহাত্মা গান্ধী, ঢাকার নবাব সলিমুল্লাহ, আসামের গভর্নর স্যার সাদ উল্লাহ, ভারতের সাবেক রাষ্টপতি জনাব ফখরুউদ্দিন আলি আহমেদ, ভারতের সাবেক আই. সি. এস. খান বাহাদুর গজনফর আলি, মজলুম নেতা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী খাজা নাযিম উদ্দিন, রাজনিতিবিদ ফরিদপুরের লাল মিয়া, মোহন মিয়া এই বাড়িতে অবস্থান করেছিলেন।
এছাড়াও উপমহাদেশের খ্যাতনামা আলেমে দ্বীন মওলানা হোসাইন আহমেদ মাদানি, পীর মুসলে উদ্দিন, মাওলানা সহুল আহমেদ উসমানী, ফরায়েজি আন্দোলনের প্রবাদ পুরুষ হাজী শরিয়াত উল্লাহর উত্তরসূরী বাদশা মিয়া, দুদু মিয়া, মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক এম.এ.জি. ওসমানী সহ উপমহাদেশের নামকরা ব্যাক্তিরা এই বাড়িতে থেকেছেন, আত্মীয়তার সম্পর্ক করেছেন। এখানে আরো বহু সভা সম্মেলনও করেছিলেন তারা। ব্রিটিশ পাকিস্তানি সময়ে সিলেট তথা উপমহাদেশের রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে- জিতু মিয়ার বাড়ি টি অন্যতম ছিল।
অন্যান্য তথ্য
খাঁন বাহাদুর জিতু মিয়ার প্রথম স্ত্রী ছিলেন তার চাচা মাওলানা আব্দুল রহমানের মেয়ে সারা খাতুন। সারা খাতুনের অকালে মৃত্যুবরণ করেন। পরবর্তীতে তিনি ঢাকার নবাব পরিবারের খাজা রসুল বক্সের মেয়েকে তিনি দ্বিতীয় বিয়ে করেন। পরবর্তীতে তার দ্বিতীয় স্ত্রীও অকালে মৃত্যুবরণ করেন। তাদের ঘরে তখন পর্যন্ত কোনো সন্তান সন্তনি ছিল না।
পরবর্তীতে জিতু মিয়া আরও বিয়ে করেছিলেন বলে জানা গেছে। সে সব স্ত্রীর ঘরে তার বহু সন্তান সন্ততি রয়েছে। কিন্তু দুরদর্শী জিতু মিয়া তার জমিদারি ও আলীশান বাড়িটির অস্তিত্ব চিরদিন অক্ষত রাখতে চেয়েছিলেন। তাই তিনি মৃত্যুর আগে ১৯২৪ সালে নিজেকে নিঃসন্তান দাবি করেন। এই বিষয় উল্লেখ করে জিতু মিয়া তৎকালীন আসাম সরকারের অনুমোদন নিয়ে তারঁ যাবতীয় সম্পত্তি ওয়াকফ করেন।
কে বি এহিয়া ওয়াকফ এস্টেট নামে এস্টেট এর মোতাওয়াল্লি নিযুক্ত হন তৎকালীন জেলা প্রশাসক। জিতু মিয়ার মৃত্যু পর তার পুত্র মাওলানা আবু মোহাম্মদ আবদুর কাদির ও মাওলানা আবুল হোসাইন মোহাম্মদ আব্দুর রহমান তাদের বিশাল জায়গীরকে কেন্দ্র করে জমিদারি এস্টেট গড়ে তোলেন। উল্লেখ যে খান বাহাদুর তার সম্পত্তির ৬০% সমাজ সেবা, ধর্মিয় কাজ, শিক্ষা মুলক কাজে দান করে গেছেন।
বর্তমান অবস্থা
জিতু মিয়ার বাড়ি টির নিচ তলার মূল কক্ষটি ড্রয়িং রুম হিসেবে আগে ব্যবহৃত হত। সেখানে রয়েছে জিতু মিয়ার সংগৃহীত ক্যালিওগ্রাফি করা পবিত্র কুরআন ও হাদিসের বাণী। এই কক্ষটির ডান দিকের অপর পাশে একটি কক্ষে রয়েছে একটি লম্বা কালো টেবিল ও ২০টি চেয়ার, যা তৎকালীন সময়ে সভাকক্ষ হিসেবে ব্যবহৃত হতো।
বর্তমানে এই বাড়িটিকে একটি জাদুঘর হিসেবে রূপান্তর করার প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। সেখানে সিলেটের বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী জিনিস প্রদর্শন করা হবে। এখানে প্রতিদিন শত শত দর্শনার্থীরা এই বাড়িটি কে দেখতে আসে।
কিভাবে জিতু মিয়ার বাড়িতে যাবেন
জিতু মিয়ার বাড়িতে যেথে হলে প্রথমে আপনাকে সিলেট শহরে আসতে হবে। সারা দেশ থেকে বাস, ট্রেন ও বিমানে সিলেট আসা যায়। সিলেট পৌছে রিক্সা ও অটোতে করে জিতু মিয়ার বাড়ি পৌছাতে পারবেন।
থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা
সিলেটের উল্লেখযোগ্য হোটেল সমূহ হল জিন্দাবাজারে অবস্থিত হোটেল পাঁচ ভাই, উঠান রেস্টুরেন্ট, পানশি, এবং পালকিতে দেশী বিদেশী বিভিন্ন প্রকারের খাবার যেমন ভিন্ন রকমের ভর্তা, ভাজি, মাছ, মাংস সহ আরো অনেক আইটেমের রয়েছে। এসব হোটেলের খাবারের মান অনেক ভালো এবং মূল্যও অনেক কম। এসব হোটেলে খাবার খেতে পারেন।
সিলেটে থাকার মত অনেকগুলো মানসম্মত আবাসিক হোটেল আছে, আপনি আপনার সামর্থ অনুযায়ী যে কোন ধরনের ছোট বড় হোটেল থাকতে পারবেন। থাকার মত কয়েকটি পরিচিত হোটেল হল – দরগা গেইটে হোটেল হিল টাউন, গুলশান, কায়কোবাদ, সুরমা ইত্যাদি। প্রতি রুমের ভাড়া ৫০০/- টাকা থেকে ৫০০০/- টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে ।
সিলেট জেলার অন্যান্য দর্শনীয় স্থান
সিলেট জেলার অন্যান্য দর্শনীয় স্থানের মধ্যে আছে হযরত শাহজালাল (র.) এর মাজার, হযরত শাহপরাণ (র.) এর মাজার, ক্বীন ব্রীজ, আলী আমজদের ঘড়ি, মালনীছড়া চা বাগান, জাফলং, বিছনাকান্দি, রাতারগুল জলাবন, লোভাছড়া, লালাখাল, পান্থুমাই ঝর্ণা, সংগ্রামপুঞ্জি ঝর্ণা, হাকালুকি হাওর, ভোলাগঞ্জ, ড্রিমল্যান্ড পার্ক এবং জাকারিয়া সিটি।
আরও পড়ুন:
পৃথিমপাশা নবাব বাড়ি পর্যটকের আকর্ষণ