কাপ্তাই লেক (kaptai lake) হচ্ছে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের রাঙ্গামাটি জেলার একটি কৃত্রিম হ্রদ। ১৯৫৬ সালে কর্ণফুলী পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য কর্ণফুলী নদীর উপর কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ করা হয়। পরবর্তীতে এই বাঁধ নির্মাণের ফলে রাঙ্গামাটি জেলার ৫৪ হাজার একর কৃষি জমি পানিতে ডুবে যায় এবং এই হ্রদের সৃষ্টি হয়।
কাপ্তাই উপজেলা হচ্ছে অপরূপ সৌন্দর্যে ভরা পাহাড়, লেকের অথৈ জলরাশি এবং চোখ জুড়ানো সবুজের সমারোহ। এই কৃত্রিম হ্রদটি ১,১০০০ হাজার বর্গ কিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে আয়তনে সর্ব বৃহত্তর এই কৃত্রিম হ্রদটি। একদিকে যেমন লেকের মধ্যে রয়েছে অথৈ জলের মধ্যে বহু প্রজাতির মাছ ও অনেক জীববৈচিত্র তেমনি পাহাড়ে রয়েছে বিভিন্ন উদ্ভিদ ও বিভিন্ন প্রাণীর সম্ভার।
এখানে রয়েছে আঁকাবাঁকা পাহাড়ের রাস্তা, ছোট বড় বিভিন্ন পাহাড়, ঝরনা আর জলের সাথে সবুজের মিতালী। এই হ্রদটি কৃত্রিম হলেও প্রকৃতি তার নিজের মতো করে সাজিয়েছে কাপ্তাই হ্রদকে। কাপ্তাই লেক এর এখানে জলকেন্দ্রিক মানুষের জীবনযাত্রা, ছোট ছোট দ্বীপ, লেকের চারপাশের পরিবেশ ও বিভিন্ন রকমের পাখির কলকাকলিতে পর্যটকদের মন মুগ্ধ করে তোলে।
একনজরে কাপ্তাই হ্রদ সম্পর্কে কিছু তথ্য
★অবস্থান – দক্ষিণ-পূর্ব বাংলাদেশ।
★ধরন- আধার।
★স্থানাঙ্ক- ২২°২৯’৪৫” উত্তর, ৯২°১৩’৪৫” পূর্ব।
★প্রাথমিক অন্তঃ প্রবাহ- কর্ণফুলী নদী।
★প্রাথমিক বহিঃপ্রবাহ- কর্ণফুলী নদী।
★অববাহিকা- ১১,১২২ বর্গ কিলোমিটার (৪,২৯৪ বর্গমাইল)।
★অববাহিকার দেশসমূহ- বাংলাদেশ।
★গড় গভীরতা- ১০০ ফুট (৩০ মিটার)।
★সর্বোচ্চ গভীরতা- ৪৯৫ ফুট (১৫১ মিটার)।
কাপ্তাই লেকের ইতিহাস
কাপ্তাই বাঁধ
১৯৫৬ সালে পাকিস্তান সরকার আমেরিকার অর্থায়নে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ করেন। ১৯৬২ সালে কাপ্তাই বাঁধের নির্মাণ কাজ শেষ হয়। এই বাধটি নির্মাণ করেন ইউতাহ ইন্টারন্যাশনাল ইন কর্পোরেট এবং ইন্টারন্যাশনাল ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি। বাঁধটি ৬৭০.৬ মিটার (২,২০০ ফুট) দীর্ঘ ও ৫৪.৭ মিটার (১৭৯ ফুট) উচ্চতায় নির্মাণ করা হয় ।
কাপ্তাই লেক প্রকল্পের জন্য তখন প্রায় ২৫ কোটি ৪০ লাখ টাকা বাজেট নির্ধারণ করা হয় কিন্তু পরবর্তীতে তা ৪৮ লাখ টাকা ছাড়িয়ে যায়। এ বাঁধের পাশে রয়েছে ১৬টি জল কপাট সংযুক্ত ৭৪৫ ফুট (২২৭ মিটার) দীর্ঘ একটি পানি নির্গমন পথ বা স্পিলওয়ে। প্রতি সেকেন্ডে ৫ লাখ ২৫ হাজার কিউসেক ফিট পানি এ স্পিলওয়ে নির্গমন করতে পারে ।
বিদ্যুৎ উৎপাদন
প্রথম পর্যায়ে এই কেন্দ্রের বিদ্যুৎ উৎপাদন ১ লাখ ২০ হাজার কিলোওয়াট ক্ষমতা ধরা হয়েছিল। প্রথমে ৪০ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন ১ ও ২ নাম্বার ইউনিট স্থাপন করা হয়। পরবর্তীতে তা ১৯৬৯ সালে ৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্নের তিন নাম্বার ইউনিট স্থাপন কাজ শুরু করা হয়। বর্তমানে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২৩০ মেগাওয়াট এবং পাঁচটি ইউনিট চালু রয়েছে ।
অধিভুক্ত এলাকা
কাপ্তাই নামের এই লেকের কারণে ওই এলাকার কৃষি জমির প্রায় ৪০ শতাংশ পানিতে ডুবে যায় যা পরিমাণে ৫৪ হাজার একর কৃষি জমি। এছাড়াও সরকারি সংরক্ষিত বর্ণের ২৯ বর্গমাইল এলাকা ও অশ্রেণীভুক্ত ২৩৪ বর্গমাইল বনাঞ্চল ও ডুবে যায়। সে সময়ে প্রায় ১৮ হাজার পরিবারের ১ লাখ মানুষের বাস্তচ্যুত হয়।
আরও পড়ুন: আজকের ট্রেনের সময়সূচী
কাপ্তাই লেকের আশেপাশের কিছু দর্শনীয় স্থান
কাপ্তাই হ্রদকে ঘিরে রাঙ্গামাটি জেলার দর্শনীয় স্থান গুলো বিশেষভাবে গড়ে উঠেছে। লেকের দুই পাড়েই পাহাড় ও টিলা দিয়ে ঘেরা। লেকের মাঝখানে রয়েছে ঝুলন্ত ব্রিজ। ট্রলার, নৌকা ও স্পিড বোট ভাড়া করে লেকে ভ্রমণ করা যাবে। এ লেকের পাড়ে রয়েছে বৌদ্ধ মন্দির ও চাকমা রাজবাড়ি। সেখানকার পুরাতন চাকমা রাজবাড়ী লেক নির্মাণের সময়ে পানিতে তলিয়ে যায়। শুভলং জলপ্রপাতে ট্রলারে করে যাওয়া যাবে।
পাহাড় থেকে লেকের সৌন্দর্য দেখার জন্য কাপ্তাই লেক প্যারাডাইস পিকনিক স্পট চাইলে ঘুরে আসতে পারেন। কাপ্তাই এর কাছে কর্ণফুলী নদীতে কায়াকিং করার ব্যবস্থা রয়েছে। আপনারা চাইলে সেই অভিজ্ঞতা ও নিতে পারেন ।ক্যাবল কারে চড়ার ইচ্ছা থাকলে শেখ রাসেল ইকোপার্কে যেতে পারেন। বাংলাদেশের বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের বৃহত্তম বিহার রাজ বনবিহার রাঙ্গামাটি শহরের কাছে অবস্থিত যা দর্শনার্থী এবং পূনার্থীদের জন্য খুবই আকর্ষণীয় স্থান।
কাপ্তাই লেক ভ্রমন/কিভাবে যাবেন
ঢাকার কমলাপুর ও সায়েদাবাদ থেকে বিভিন্ন মানের বাসে করে সরাসরি কাপ্তাই যাওয়া যায়। ঢাকা থেকে কাপ্তাই যেতে প্রায় ৭ থেকে ৮ ঘন্টা সময় লাগে। সেক্ষেত্রে ভাড়া পরবে ৮০০ থেকে ১২০০ টাকা পর্যন্ত।
বান্দরবন থেকে কাপ্তাই যেতে চাইলে রোয়াংছড়ি বাস স্ট্যান্ড থেকে রাঙ্গামাটি গামী বাসে করে গিয়ে বড়াইছড়ি নামতে হবে। এখান থেকে সিএনজি করে কাপ্তাই যেতে পারবেন।
আপনি চাইলে সরাসরি চট্টগ্রাম থেকে কাপ্তাই যেতে পারবেন। বদ্দারহাট বাস স্ট্যান্ড থেকে কাপ্তাই এর উদ্দেশ্যে প্রতি ৩০ মিনিট পর পর বাস ছেড়ে যায়। বদ্দারহাট থেকে কাপ্তাই যেতে বাস ভাড়া লাগে ৮০ থেকে ১২০ টাকা পর্যন্ত। সময় লাগবে প্রায় দুই ঘন্টার মত। অথবা ঢাকা থেকে ট্রেনে করে চট্টগ্রামে এসে সেখান থেকে বদ্দারহাট বাস স্ট্যান্ডের মাধ্যমে কাপ্তাই যেতে পারবেন।
রাঙ্গামাটি থেকে সড়কপথে বাসে অথবা সিএনজির মাধ্যমে ও কাপ্তাই যাওয়া যাবে। অথবা ট্রলার, নৌকা বা স্পিড বোট এর মাধ্যমেও কাপ্তাই লেক ভ্রমণ করে কাপ্তাই বাজারেও যাওয়া যাবে।
কোথায় থাকবেন
কাপ্তাইয়ে রাত্রি যাপনের জন্য এখনো তেমন কোনো ভালো মানের আবাসিক হোটেল গড়ে ওঠেনি। তাই সেখানে রাতে থাকার ইচ্ছা থাকলে আগে থেকেই কাপ্তাইয়ের সরকারি রেস্ট হাউসের কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করে আসা উত্তম হবে। আপনি চাইলে লেক প্যারাডাইস পিকনিক স্পটে ও রাত্রি যাপন করতে পারবেন সেখানে রুম ভাড়া নিয়ে। এছাড়াও রয়েছে সরকারি অফিসের অনুমতি সাপেক্ষে পানি উন্নয়ন বোর্ড, সেনাবাহিনী, পিডিবি ও বন বিভাগের রেস্ট হাউসগুলোতে কম খরচের মাধ্যমে আপনি রাত্রি যাপন করতে পারবেন।
আপনার ট্যুর প্ল্যান যদি থাকে কাপ্তাই লেক এর পাশাপাশি রাঙ্গামাটিও ভ্রমণ করা তাহলে আপনি রাঙ্গামাটি থাকতে পারেন। রাঙ্গামাটিতে ভালো মানের অনেক আবাসিক হোটেল রয়েছে। আপনাদের প্রয়োজনে সেখানকার কিছু হোটেলের নাম্বার ও ঠিকানা নিম্নে দেয়া হলো –
★ হোটেল লেক ভিউ : রিজার্ভ বাজার, রাঙ্গামাটি,
ফোন :- 62063।
★হোটেল গোল্ডেন হিল : রিজার্ভ বাজার, রাঙ্গামাটি। ফোন :-01820 – 304714।
★হোটেল সুফিয়া : কাঁঠালতলী, রাঙ্গামাটি, ফোন:- 62145।
★ হোটেল গ্রীন ক্যাসেল : রিজার্ভ বাজার, রাঙ্গামাটি, ফোন :-61200।
কোথায় খাবেন
কাপ্তাই এর কাছে আছে বেড়াইন্যের লেক শোর ক্যাফে, প্যারাডাইস ক্যাফে,জুম রেস্তোরাঁ ইত্যাদি। কাপ্তাই লেকের মাঝখানে রয়েছে ছোট ছোট দ্বীপ, দ্বীপের মাঝখানে রয়েছে কিছু রেস্টুরেন্ট চাইলে সেখান থেকে আপনি দুপুরের খাবার খেয়ে নিতে পারেন। অথবা নিজের পছন্দের খাবার খেতে যেতে পারেন নৌবাহিনীর ঘাঁটি সংলগ্ন ভাসমান রেস্টুরেন্টে। প্রতিদিন সকাল ১০ টা থেকে সন্ধ্যা ৭ টা পর্যন্ত খোলা থাকে। এছাড়া আপনি যে আবাসিক হোটেলে উঠবেন সেখানে ও খাবারের ব্যবস্থা থাকে চাইলে সেখান থেকেও খাবার খেয়ে নিতে পারবেন।
কাপ্তাই হ্রদ সম্পর্কে সচরাচর জিজ্ঞাসিত প্রশ্নোত্তর (FAQ’s)
কাপ্তাই হ্রদ কোথায় অবস্থিত?
কাপ্তাই হ্রদ/লেক বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের রাঙ্গামাটি জেলায় অবস্থিত।
কাপ্তাই লেক কিভাবে তৈরি হয়েছে?
১৯৫৬ সালে কর্ণফুলী পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য কর্ণফুলী নদীর উপর কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ করা হয়। পরবর্তীতে এই বাঁধ নির্মাণের ফলে রাঙ্গামাটি জেলার ৫৪ হাজার একর কৃষি জমি পানিতে ডুবে যায় এবং এই হ্রদের সৃষ্টি হয়।
কাপ্তাই হ্রদে দেখার মতো কি আছে?
কাপ্তাই হ্রদের পাশে আঁকাবাঁকা পাহাড়ের রাস্তা, ছোট বড় বিভিন্ন পাহাড়, ঝরনা আর জলের সাথে সবুজের মিতালী। জলকেন্দ্রিক মানুষের জীবনযাত্রা, ছোট ছোট দ্বীপ, লেকের চারপাশের পরিবেশ ও বিভিন্ন রকমের পাখির কলকাকলিতে ঘেরা, যা পর্যটকদের মন মুগ্ধ করে তোলে। কৃত্রিম হলেও এটি প্রকৃতির এক অনন্য সৌন্দর্য।
ইতিকথা
কাপ্তাই লেক সম্পর্কে বিষদ কিছু জানার থাকলে আমাদের কমেন্ট করে জানিয়ে দিন। আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব সঠিত তথ্য দিয়ে আপনাদের সাহায্য করতে।