বাংলাদেশের সিলেট শহরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে সুরমা নদী। আর সুরমা নদীর ওপর স্থাপন করা হয়েছে লৌহ নির্মিত ক্বীন ব্রীজ (Keane Bridge)। সুরমা নদীর ওপর নির্মিত এই ব্রিজটি একটি ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসেবে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এই ব্রিজটিকে সিলেট শহরের প্রবেশদ্বারও বলা হয়। ব্রিটিশ গভর্নর মাইকেল ক্কিন এর নামে এই ব্রিজটির নামকরণ করা হয়েছিল ক্বীন ব্রীজ।
এই ব্রিজটি সিলেটের অন্যতম দর্শনীয় স্থান। এই ব্রিজটি ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবেও সবার কাছে অনেক পরিচিত। এই ব্রীজটির দৈর্ঘ্য ১১৫০ ফুট ও ৩৫০.৫২ মিটার এবং প্রস্থ ১৮ ফুট ও ৫.৪ মিটার। ক্বীন ব্রীজটি লোহা দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। এই ব্রিজটির আকৃতি ধনুকের ছিলার মত বাঁকানো। তৎকালীন সময়ে এই ব্রিজটিকে নির্মাণ করতে প্রায় ৫৬ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছিল।
ক্বীন ব্রীজের অবস্থান
বাংলাদেশের সিলেট শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত এই ক্বীন ব্রীজটি। এই ব্রিজটির একদিকে বন্দর বাজার ও অন্যদিকে দক্ষিণ সুরমা নদী। এই ব্রিজটি সিলেট রেলওয়ে স্টেশন থেকে মাত্র আধা কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত। এটি সিলেট শহরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত সুরমা নদীর উপরে অবস্থিত।
ক্বীন ব্রীজ তৈরির ইতিহাস
আসাম প্রদেশের গভর্নর মাইকেল ক্কিন যখন সিলেট সফরে আসেন তখন সুরমা নদীর উপরে ব্রিজ স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। কারণ সে সময় আসামের সাথে সিলেটের একমাত্র যোগাযোগের মাধ্যম ছিল ট্রেন। ১৯৩৩ সালে সুরমা নদীর ওপর ব্রিজ নির্মাণের রেলওয়ে বিভাগ উদ্যোগ নেন। ১৯৩৬ সালে ব্রিজটির নির্মাণ কাজ শেষে আনুষ্ঠানিকভাবে এই ক্বীন ব্রীজটি উদ্বোধন করা হয় ও খুলে দেয়া হয়।
ক্বীন ব্রীজের নামকরণ
গত শতকের তিরিশের দশকের দিকে মাইকেল ক্কিন আসাম প্রদেশের গভর্নর ছিলেন। ১৯৩২ সাল থেকে ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত মাইকেল ক্কিন আসামের একজন ইংরেজ গভর্নর ছিলেন। তিনি সিলেটে সফরে আসেন এবং এখানে এসে তিনি এই ব্রিজটি নির্মাণ করেন তার স্মৃতিকে অম্লান করে রাখতে। পরবর্তীতে গভর্নর মাইকেল ক্কিনের নামানুসারে এই ব্রিজের নামকরণ করা হয়।
ক্বীন ব্রীজের সংস্কার
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ডায়নামাইট দিয়ে ব্রীজের উত্তর পাশের একটি অংশ উড়িয়ে দেয়। পরবর্তীতে স্বাধীনতার পর ব্রিজটিকে হালকা যান চলাচলের জন্য কাঠ ও বেইলী পার্টস দিয়ে মেরামত করা হয়।
১৯৭৭ সালে আবার বাংলাদেশ রেলওয়েরর সহযোগিতায় ব্রীজের সেই বিধ্বস্ত অংশটিকে কংক্রীট দিয়ে পুনঃনির্মাণ করা হয়।
আরও পড়ুন: আলী আমজদের ঘড়ি
ব্রিজটি প্রায় ৮৫ বছরের পুরনো হওয়ায় খুব নড়বড়ে ও ঝরাজীর্ণ হয়ে গেছে। তাই কয়েক বছর ধরে এই ব্রিজটি দিয়ে ভাড়ি যান চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে ও হালকা যান চলাচল করার অনুমতি দেয়া হয়েছে। অবশেষে ১৭ই আগস্ট ২০২৩ সালে বাংলাদেশ রেলওয়ে সিলেটের ঐতিহ্যবাহী ক্বীন ব্রীজের সংস্কার কাজ শুরু করেছেন।
কিভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে সড়ক পথে ক্বীন ব্রিজের দূরত্ব প্রায় ২৪৬ কিলোমিটার এবং রেলপথে দূরত্ব প্রায় ৩১৯ কিলোমিটার। সিলেট শহরের প্রবেশদ্বরে ক্বীন ব্রিজ অবস্থিত। দেশের যে কোনো স্থান থেকে ট্রেন অথবা বাসে করে সহজেই ক্বীন ব্রিজ যাওয়া যায়। সিলেট রেলওয়ে ও বাস স্টেশন হতে ক্বীন ব্রিজের দূরত্ব মাত্র আধ কিলোমিটার। হেঁটেও ব্রীজে যেথে পারেন।
ঢাকা থেকে বাসে সিলেট
ঢাকার সায়েদাবাদ এবং গাবতলী বাস টার্মিনাল থেকে সিলেটের বাস যাথায়াত করে ৷ ফকিরাপুল, সায়দাবাদ ও মহাখালী বাস স্টেশন থেকে গ্রীন লাইন, এস আলম, সৌদিয়া, শ্যামলি ও এনা পরিবহনের এসি বাস যাতায়াত করে। জনপ্রতি ভাড়া ৮০০ থেকে ১১০০ টাকার মধ্যে। এ ছাড়া আছে ঢাকা থেকে সিলেট যেতে শ্যামলী, হানিফ, ইউনিক, এনা পরিবহনের নন এসি বাস চলাচল করে। জনপ্রতি ভাড়া ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকা।
ট্রেনে সিলেট
ট্রেনে ঢাকা থেকে সিলেট যেতে কমলাপুর কিংবা বিমান বন্দর রেলওয়ে স্টেশন হতে উপবন এক্সপ্রেস, জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস, পারাবত এক্সপ্রেস অথবা কালনী এক্সপ্রেসে সিলেট যেতে পারবেন।
এ ছাড়া ঢাকা থেকে সবচেয়ে দ্রুত সময়ে ও স্বাচ্ছন্দ্যে সিলেট যেতে চাইলে বিমানে গমন করতে পারেন। ঢাকা হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বিমান বাংলাদেশ, নভোএয়ার এবং ইউএস বাংলায় সিলেট আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে নেমে ক্বীন ব্রিজে যেথে পারবেন।
চট্টগ্রাম থেকে সিলেট
চট্টগ্রাম থেকেও বাস, ট্রেন ও আকাশপথে সিলেট যাওয়া যায়। ট্রেনে যেতে পাহাড়িকা ও উদয়ন এক্সপ্রেস, এ-দুটি ট্রেন সপ্তাহে ৬ দিন চলাচল করে।
থাকবেন কোথায়
সিলেট শহরের লালা বাজার ও দরগা গেইট রোডে কম মূল্যের অনেক মানসম্মত আবাসিক হোটেল ও রেস্ট হাউস আছে ৷ যেখানে ৪০০ থেকে ১০০০ টাকায় বিভিন্ন ধরনের রুম ভাড়া পাওয়া যায়। এ ছাড়া হোটেল হিল টাউন, গুলশান হোটেল, দরগা গেইট, সুরমা আবাসিক হোটেল, কায়কোবাদ ইত্যাদি হোটেলে আপনার প্রয়োজন ও সামর্থ্যানুযায়ী থাকতে পারবেন।
খাবার
ভ্রমনে বের হলে আপনার খাবারের চিন্তা অবশ্যই করতে হবে। খাবারের জন্য সিলেট শহরের জিন্দাবাজার এলাকার পানসী রেস্টুরেন্ট, পাঁচ ভাই কিংবা পালকি রেস্টুরেন্টে সুলভ মূল্যে পছন্দমতো ভর্তা বাজিসহ নানারকম দেশি খাবার খেতে পারেন। এসব রেস্টুরেন্টের বাহারি খাবার ভ্রমণপিপাসুদের অন্যতম আকর্ষণ। এ ছাড়া সিলেট শহরে চইনিজ বাংলা বিভিন্ন মানের রেস্টুরেন্ট আছে। সেখানেও আপনার পছন্দমতো খাবার খেয়ে নিতে পারবেন।
সিলেট শহরের আশপাশে আরো দর্শনীয় স্থান দেখুন
সিলেট শহর ও এর আশপাশে আরো যে সকল স্থানে ভ্রমণ করতে পারেন, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য—হযরত শাহজালাল (র.)-এর মাজার, হযরত শাহপরাণ (র.)-এর মাজার, মালনীছড়া চা বাগান, জাফলং, বিছনাকান্দি, রাতারগুল, লোভাছড়া, লালাখাল, পান্থুমাই ঝর্ণা, সংগ্রামপুঞ্জি ঝর্ণা, আলী আমজাদের ঘড়ি, জিতু মিয়ার বাড়ি, হাকালুকি হাওর, ভোলাগঞ্জ, ড্রিমল্যান্ড পার্ক, জাকারিয়া সিটি ইত্যাদি।
ক্বীন ব্রিজ সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রশ্ন Faq’s
সিলেটের প্রাচীনতম সেতু কোনটি?
সিলেটের প্রাচীনতম সেতু হলো ক্বীন ব্রীজ যা বাংলাদেশের সিলেট শহরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত সুরমা নদীর উপর ব্রিটিশ আমলে স্থাপিত একটি লৌহ নির্মিত সেতু।
সিলেট কেন এত বিখ্যাত?
সিলেট তার চা বাগান এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত।
সিলেটের পুরাতন নাম কি?
সিলেটের পুরাতন নাম হলো শ্রীহট্ট।
ক্বীন ব্রিজ কত সালে প্রতিষ্ঠিত হয়?
রেলওয়ে বিভাগ ১৯৩৩ সালে সুরমা নদীর ওপর ব্রীজ নির্মাণের উদ্যোগ নেয় এবং নির্মাণ শেষে ১৯৩৬ সালে ব্রীজটি আনুষ্ঠানিকভাবে যাতায়াতের জন্য খুলে দেওয়া হয়।
শেষকথা
দেশ ও বিদেশী পর্যটকেরা সিলেটের চা বাগান, রাবার বাগান ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের প্রেমে পড়ে বারবার সিলেটে ছুটে আসেন, এখানে থাকেন এবং সিলেটের সৌন্দর্য উপভোগ করেন। এসব সৌন্দর্যের মধ্যে শহরের প্রবেশদ্বারে অবস্থিত ক্বীন ব্রীজ সবার নজর কাড়ে।