ইসলামিক জীবনাদর্শের সমস্ত জীবন ব্যবস্থা-ই পবিত্র কোরআনে এবং বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর হাদিস শরীফে শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। খাবার খাওয়ার দোয়া ও সুন্নত সমূহ পালনের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা যায়।
খাবার খাওয়ার দোয়া ও সুন্নত রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর আদর্শ। মহান আল্লাহ তায়ালা রাসুলের সুন্নত সম্পর্কে বলেন- “সে (নবিজী সাঃ) নিজ থেকে মনগড়া কোন কথা বলেন না। (তিনি যা বলেন) তা তো ওহি, যা তার প্রতি প্রত্যাদেশ হয়।” (সুরা নাজম, আয়াত ৩-৪)
তাই খাবার খাওয়ার দোয়া ও সুন্নত সমূহ সম্পর্কে সকল তথ্য জেনে নিন এই আলোচনায়।
খাবার খাওয়ার সুন্নত ও আদব সমূহ
খাওয়ার সময় বেশ কিছু সুন্নত ও আদব সমূহ রয়েছে। খাবার খাওয়ায় সুন্নতের অনুসরণ করা অবশ্যই বরকতময় এবং ফজিলতপূর্ণ। খাবার খাওয়ার সময় নিম্নোক্ত কাজগুলো করা সুন্নত-
- খাবার খাওয়ার শুরুতে বিসমিল্লাহ বলা।
- বিসমিল্লাহ বলতে ভুলে গেলে, পরে মনে হলে দোয়া পড়া।
- হাত ধুয়ে খাওয়া শুরু ও শেষ করা।
- দস্তরখান বিছিয়ে খাবার খাওয়া।
- ডান হাত দিয়ে খাবার খাওয়া।
- হাত চেটে খাওয়া।
- আঙুল চেটে খাওয়া।
- পড়ে যাওয়া খাবার তুলে খাওয়া।
- হেলান দিয়ে না খাওয়া।
- হালাল খাবারের দোষ-ত্রুটি না ধরা।
- খাবারে ফুঁ না দেওয়া।
- খাওয়া শেষে দোয়া পড়া।
আল্লাহর রহমত পেতে প্রতিবার খাবারেই আমাদের খাবার খাওয়ার দোয়া ও সুন্নত মানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
খাবার সামনে এলে যে দোয়া পড়তে হয়
খাবার শুরুর পূর্বে খাবার সামনে এলে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) – এর সুন্নত অনুযায়ী নিম্নোক্ত দোয়াটি পাঠ করতে হয়-
আরবি: اللهم بارك لنا فيما راجكتانا واكينا إذا بالنار.
বাংলা উচ্চারণ: “আল্লাাহুম্মা বারিক-লানা ফিমা রাজাকতানা ওয়াক্বিনা আজা-বান্নার।”
বাংলা অর্থ: “হে আল্লাহ, আপনি আমাদের যে জীবিকা দান করেছেন, তাতে বরকত দিন এবং আমাদেরকে জাহান্নামের শাস্তি থেকে রক্ষা করুন।”
আরও পড়ুন: ঈমান টিকিয়ে রাখার দোয়া ও আমল। ঈমানের উপর অটল থাকার দোয়া
খাবারের আগে দোয়া / খাবারের শুরুতে দোয়া
সকল ভাল কাজই মহান আল্লাহ তায়ালার নামে শুরু করলে তা বরকতময় হয়। খাবার খাওয়ার দোয়া ও সুন্নত অনুসারে খাওয়ার পূর্বে মহানবী (সাঃ) শেখানো নিম্নোক্ত দোয়াটি পাঠ করতে হয়-
আরবি: بسم الله وعلى بركةالله بعالى
বাংলা উচ্চারণ: “বিস্-মিল্লাহি ওয়া আলা বারকাতিল্লা’হ।”
বাংলা অর্থ: “আল্লাহ তায়ালার নামে খাবার খাওয়া শুরু করছি এবং আল্লাহ তায়ালার বরকত প্রার্থনা করছি।” (সাআলাবী)
তবে কখনো খাবার শুরুতে বিসমিল্লাহ বলতে ভুলে গেলে, খাবার মাঝে যখনই মনে পড়বে, তখনই হাদিস শরীফে শিখানো নিম্নোক্ত দোয়াটি পাঠ করতে হবে-
আরবি: بسم الله اوله واخره
বাংলা উচ্চারণ: “বিস্-মিল্লাহি আওয়া-লাহু ওয়া আখেরাহ।”
বাংলা অর্থ: “আল্লাহ তায়ালার নামে খাবার খাওয়া শুরু করছি। প্রথমেও আল্লাহর নাম, পরিশেষেও আল্লাহর নাম।” (আবু দাউদ, দারেমী, আহমদ)
খাওয়ার পরের দোয়া আরবি
মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে যেকোনো নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করলে, তিনি তা বৃদ্ধি করেন। খাবারে বরকতের পাশাপাশি বান্দার গুনাহ মাফ হয়।
খাবার খাওয়ার দোয়া ও সুন্নত অনুসারে খাওয়ার পরে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বিভিন্ন দোয়া পড়তেন। তার মধ্যে যেকোনো একটি দোয়া পাঠ করলেই হবে। খাওয়ার পরের দোয়াটি হলো:
(১) আরবি: الحمد لله الذى اطعمنا وسقانا وكفانا واواناوارواناوجعلنا من المسلمين
বাংলা উচ্চারণ: “আলহামদু লিল্লাহিল্লাজি আত্বআমানা, ওয়া সাক্বানা, ওয়াকাফানা, ওয়া-আয়ানা, ওয়া আর-ওয়ানা, ওয়া ঝা-আলানা মিনাল মুসলিমীন।”
বাংলা অর্থ: “সকল প্রশংসা আল্লাহ তায়ালার, যিনি আমাদের খাইয়েছেন, পান করিয়েছেন, যথেষ্ট পরিমাণ খাবার দিয়েছেন, বাসস্থান এর ব্যবস্থা করেছেন, সকল প্রকার নেয়ামত দিয়েছেন এবং আমাদেরকে মুসলমানদের অন্তর্ভূক্ত করেছেন।”
অথবা, সংক্ষিপ্ত এই দোয়াটিও পাঠ করা যায়-
(২) বাংলা উচ্চারণ: “আলহামদু লিল্লাহিল্লাজি আত্বআমানা, ওয়া সাক্বানা, ওয়া ঝা-আলানা মিনাল মুসলিমীন।” (আবু দাউদ, মিশকাত)
বাংলা অর্থ: “সকল প্রশংসা আল্লাহর তায়ালার, যিনি আমাদের খাইয়েছেন, পান করিয়েছেন এবং মুসলমানদের অন্তর্ভূক্ত করছেন।”
(৩) হযরত মুয়াজ ইবনু আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত- রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, “কোন মুসলমান খাবার ও পানীয় পান করার পর এই দোয়াটি পড়লে, তার পূর্বের গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়।” দোয়াটি হলো-
বাংলা উচ্চারণ: “আলহামদু লিল্লাহিল্লাজি আত্বআমানি, হাজাত্ ত্বা-আমা ওয়া রাযাক্বা-নিহি মিন গাইরি হাওলিম্ মিন্নি ওয়ালা কুউ ওয়াতিন।” (তিরমিজি, মিশকাত, আবু দাউদ)
বাংলা অর্থ: “সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি আমাকে পরিশ্রম ও প্রচেষ্টা ছাড়াই খাইয়েছেন এবং রুজি দান করেছেন।”
(৪) হজরত আবু আইয়ুব (রাঃ) হতে বর্ণিত- রাসুলুল্লাহ (সাঃ)- পান করার পর বলতেন-
বাংলা উচ্চারণ: “আলহামদু লিল্লাহিল্লাজি আত্বআমা, ওয়া সাক্বা, ওয়া সাউ ওয়াগাহু, ওয়া ঝা-আলা লাহু মাখ্-রাঝা।” (আবু দাউদ ও মিশকাত)
বাংলা অর্থ: “সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি খাওয়ালেন, পান করালেন এবং সহজভাবে প্রবেশ করালেন ও তা বের হওয়ার ব্যবস্থা করলেন।”
দাওয়াত খাওয়ার পর দোয়া
কেউ দাওয়াত করে খাবার খাওয়ালে, খাবার খাবার পর তার জন্য দোয়া করতে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) উৎসাহিত করেছেন। খাবার খাওয়ার দোয়া ও সুন্নত অনুসারে, যে ব্যক্তি খাবার খাওয়াবে তার জন্য দাওয়াত খাওয়ার পর নিম্নোক্ত দোয়াটি পাঠ করতে হয়-
আরবি: اَللّهُمَّ اَطْعِمْ مَنْ اَطْعَمَنِيْ وَ اَسْقِ مَنْ سَقَانِيْ
বাংলা উচ্চারণ: “আল্লা-হুম্মা আত্বইম্ মান আত্বা-আমানি, ওয়াসক্বি মান সাক্বানি।”
বাংলা অর্থ: “হে আল্লাহ! তুমি তাকে খেতে দাও, যে আমাকে খাবার দিয়েছে। তুমি তাকে পান করাও, যে আমাকে পান করিয়েছে।”
পানি খাওয়ার দোয়া
খাবার গ্রহণের মত পানি পান করার শুরুতে নিম্নোক্ত দোয়াটি পাঠ করতে হয়-
আরবি: بِسْمِ اللّه الرَّحْمنِ الرَّحِيْمِ
বাংলা উচ্চারণ: “বিস্-মিল্লাহির রাহমানির রাহীম।”
বাংলা অর্থ: “পরম করুনাময় ও দয়ালু আল্লাহ তায়ালার নামে শুরু করছি।”
পানি পান শেষে এই দোয়া পাঠ করতে হয়-
আরবি: اَلْحَمْدُ لِلّهِ الَّذِيْ جَعَلَه عَذْبًا فُرَاطًا بِرَحْمَتِه وَ لَمْ يَجْعَلْه مِلْحًا اُجَاجًا
বাংলা উচ্চারণ: “আল-হামদুলিল্লা হিল্লাজি জা‘আলাহু আ‘জবান ফুরা-তান, বি রহমাতি ওয়া লাম ইয়াজ আ’ল্লাহু মিলহান উজাজান।”
দুধ খাওয়ার দোয়া
দুধ একটি পুষ্টি সমৃদ্ধ খাবার। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলছেন, “একইসাথে পান ও আহারের জন্য যথেষ্ট হওয়ার মতো দুধের বিকল্প কোনো খাবার নেই।” (তিরমিজি, ইবনে মাজাহ, মুসনাদে আহমাদ)
খাবার খাওয়ার দোয়া ও সুন্নত অনুসারে, দুধ খাওয়ার আলাদা দোয়া রয়েছে।। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেন- আল্লাহ তাআলা যাকে দুধ পান করাবে সে যেন বলে-
আরবি: اللَّهُمَّ بَارِكْ لَنَا فِيهِ وَزِدْنَا مِنْهُ
বাংলা উচ্চারণ: “আল্লা-হুম্মা বারিকলানা ফিহি ওয়া জ্বিদনা মিনহু।”
বাংলা অর্থ: “হে আল্লাহ! এ দুধে আমাদেরকে বারকত দিন এবং এর চেয়েও বেশি আমাদেরকে দান করুন।”
দস্তরখানা উঠানোর দোয়া
খাবার নষ্ট হওয়া বা অপচয় থেকে বাঁচতে দস্তরখানা বিছিয়ে খাবার খাওয়া সুন্নত। খাওয়া শেষে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) দস্তরখানা উঠানোর সময় কল্যাণময় দোয়া করতেন। দোয়াটি হলো-
আরবি: اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ حَمْدًا كَثِيْرًا طَيِّبًا مُبَارَكًا فِيْهِ غَيْرَ مَكْفِىٍّ وَلَا مُوَدَّعٍ وَلَا مُسْتَغْنًى عَنْهُ رَبَّنَا
বাংলা উচ্চারণ: “আলহামদু-লিল্লাহি হামদান কাছি’রান ত্বাইয়্যিবান মুবা-রাকান ফি’হি গায়রা মাকফিয়্যিন ওয়া-লা মুওয়াদ্দাই’ন অলা মুস্তাগনান আ’নহু রাব্বানা।”
বাংলা অর্থ: “সমস্ত প্রশংসা পবিত্র ও বরকতময় আল্লাহর জন্য। হে প্রভু! এ খানাকে যথেষ্ট মনে করা যায় না, আর একে সম্পূর্ণ বিদায় দেওয়া যায় না, না এর থেকে অমুখাপেক্ষী হওয়া যায়।”
শেষকথা
হালাল বস্তু আহার করা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি খাবার খাওয়ার দোয়া ও সুন্নত সমূহ আদায় করাও গুরুত্বপূর্ণ। মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে উপরোক্ত আমল করার তৌফিক দান করুক, আমিন।