কিসমিসের উপকারিতা ও অপকারিতা। কিসমিস খাওয়ার নিয়ম

কিসমিস আমাদের অনেকেরই পছন্দের একটি খাবার। রান্নায় মিষ্টি স্বাদযুক্ত খাবার তৈরিতে আমরা এটি ব্যবহার করে থাকি। এই কিসমিসের উপকারিতা রয়েছে অনেক। নিয়মিত সঠিক পরিমাণে কিসমিস খেলে কি কি উপকারিতা পাবেন জানতে পারবেন এই লেখাতে।

কিসমিসের উপকারিতা ও অপকারিতা, পুষ্টিগুণ, খাওয়ার নিয়ম ও কতটুকু খাবেন, কিসমিস এর উপকারিতা, কিসমিস ভিজিয়ে খাওয়ার উপকারিতা, প্রতিদিন কতটুকু কিসমিস খাওয়া উচিত তার বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরা হলো এই আলোচনায়।

কিসমিসের পুষ্টি উপাদান

মানবদেহের জন্য গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি উপাদান গুলো কিসমিসের মধ্যে বিদ্যমান রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে,

  • প্রতি ১০০ গ্রাম কিসমিসে রয়েছে-
  • এনার্জি ৩০৪ কিলোক্যালরি,
  • কার্বোহাইড্রেট ৭৪.৬ গ্রাম,
  • ডায়েটরি ফাইবার ১.১ গ্রাম,
  • ফ্যাট ০.৩ গ্রাম,
  • প্রোটিন ১.৮ গ্রাম,
  • ক্যালসিয়াম ৮৭ মিলিগ্রাম,
  • আয়রন ৭.৭ মিলিগ্রাম,
  • পটাসিয়াম ৭৮ মিলিগ্রাম
  • সোডিয়াম ২০.৪ মিলিগ্রাম।

এর প্রতিটি উপাদানই আমাদের দেহ ও স্বাস্থ্যরক্ষার জন্য প্রয়োজন এবং অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

কিসমিসের উপকারিতা 

কিসমিসে বিদ্যমান উপাদানগুলো আমাদের দেহের জন্য উপকারি। রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে, রক্ত স্বল্পতা দূর করতে, হজম শক্তির উন্নয়নে, রোগ প্রতিরোধে, যৌন স্বাস্থ্য রক্ষায়, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রনে এছাড়া আরও বিভিন্ন ভাবে কিসমিসের অনেক উপকারিতা রয়েছে।

নিচে এসকল বিষয়ে উপকারিতা এবং তার জন্য সঠিক পদ্ধতিতে কিসমিস খাওয়ার নিয়ম বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হলোঃ

(১) রক্ত স্বল্পতা দূর করে
রক্ত স্বল্পতা দূর করতে কিসমিস যথেষ্ট উপকারিতা বহন করে। নিয়মিত এবং পরিমানমতো কিসমিস সেবন করলে এর মধ্যে থাকা আয়রন রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বাড়াতে সাহায্য করে। এছাড়াও এর মধ্যে তামাজাতীয় উপাদান আছে। যা রক্তে লোহিত রক্তকণিকা তৈরিতে সাহায্য করে। এর জন্য নিয়মিত ৩০-৪০ গ্রাম কিসমিস খেতে পারেন।

(২) রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে
উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের প্রাকৃতিক খাদ্য উপাদান গুলোর মধ্যে কিসমিসের উপকারিতা অনেক। এর মধ্যে থাকা পটাসিয়াম উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে। রক্ত চলাচল সহজ করে এবং রক্তের উৎপাদন ক্ষমতা বাড়িয়ে ব্লাড প্রেসার অনেকাংশে হ্রাস করে। এর জন্য নিয়মিত ৩০-৪০ গ্রাম কিসমিস খেলে ভালো ফল পাবেন।

(৩) কিসমিস হজমশক্তি বাড়ায়
সুস্থ থাকার জন্য ভালো ডাইজেস্ট প্রক্রিয়া ভালো থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে কিসমিস আমাদের হজমশক্তি বাড়াতে সাহায্য করে। প্রতিদিন রাতে এক গ্লাস পানিতে কিছু কিসমিস ভিজিয়ে রাখুন। পরের দিন ভোরে সেই কিসমিস খেয়ে নিন। তারপর কিছুদিনের নিয়মিত ব্যবহারে এর তফাত লক্ষ করতে পারবেন। পনেরো দিনের মধ্যেই আপনার হজমশক্তি বাড়তে থাকবে এবং এর ফলাফল বুঝতে পারবেন।

আরও পড়ুন: সজনে পাতার উপকারিতা ও ঔষধি গুণাগুন

(৪) কোষ্ঠকাঠিন্য কমায়
নিয়মিত কিসমিস খেলে কোষ্ঠকাঠিন্য জনিত সমস্যা দূর হয়। আপনি যদি পেটের সমস্যায় ভোগেন। তাহলে প্রতিদিন সকালে খালিপেটে ভেজানো কিসমিস খেতে পারেন। এটি প্যাকেটজাত বিভিন্ন ওষুধ থেকে অনেক বেশি কার্যকর হতে পারে। তাছাড়া এর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া না থাকায় নিশ্চিন্তে ব্যবহার করতে পারেন।

(৫) রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে
নিয়মিত কিসমিস খেলে কিসমিসের উপকারিতা আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। এর জন্য ভেজা কিসমিস ও কিসমিস ভেজানো পানি নিয়মিত খান। এর মধ্যে রয়েছে অনেক বেশি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। যা দেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী করে।

(৬) শরীর ডি-টক্সিফাই
শরীরকে টক্সিকমুক্ত রাখতে নিয়মিত কিসমিস খান। সকালে খালি পেটে ভেজানো কিসমিস খেলে শরীরে থাকা বর্জ্য পদার্থগুলো বা বিষাক্ত পদার্থগুলো বের করতে সহযোগিতা করবে। ভেজানো কিসমিসের পাশাপাশি কিসমিস ভেজানো পানিও খেলে বাড়তি সুবিধা পাবেন।

(৭) যৌন স্বাস্থ্যের উন্নয়নে
নিয়মিত কিসমিস খাওয়া যৌন স্বাস্থ্যের উন্নতিতেও উপকারি। কিসমিসে বোরন নামক খনিজ থাকে। গবেষণায় থেকে জানা যায়, বোরন নারী ও পুরুষ উভয়ের যৌন স্বাস্থ্যজনিত হরমোন বাড়াতে সাহায্য করে। কিসমিস খাওয়ার ফলে শরীরে সেই গুরুত্বপূর্ণ হরমোনের আধিক্য হয়। ফলে যৌন স্বাস্থ্যের উন্নয়ন ঘটে।

(৮) চুলের স্বাস্থ্যরক্ষায়
ফ্রি র‍্যাডিক্যাল চুলের ক্ষতি করতে পারে। কিসমিসের উপকারিতায় বা এতে থাকা পুষ্টি উপাদান গুলো এই ফ্রি র‍্যাডিক্যাল থেকে চুলকে রক্ষা করতে সাহায্য করে। NCBI দ্বারা প্রকাশিত একটি গবেষণায় পাওয়া যায়, কিসমিসে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এটি ফ্রি র‍্যাডিক্যালের প্রভাব কমায় এবং চুলের যত্নে সহায়ক।

(৯) ডায়াবেটিসে নিয়ন্ত্রণে
স্বল্প পরিমানে কিসমিস খেলে, তা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রনে সহায়তা করে। কিসমিসের কম গ্লাইসেমিক সূচক রয়েছে বলে এটি ইনসুলিনের প্রতিক্রিয়া উন্নত করতে সহায়তা করে। গ্লাইসেমিক ইনডেক্স হলো একটি বিশেষ খাদ্য উপাদান। এতে প্রচুর পরিমাণে কার্বোহাইড্রেট রয়েছে। যা রক্তে শর্করার পরিমাণ বৃদ্ধির বিপরীতে কাজ করে।

(১০) জ্বর নিয়ন্ত্রণে
শরীরে যেকোনো ধরনের ইনফেকশন জনিত কারনে জ্বর হতে পারে। জ্বরের সেই ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাসকে নির্মূল করার জন্য আমাদের শরীর সচেষ্ট থাকে। এমন পরিস্থিতিতে কিসমিস সেই ব্যাকটেরিয়া দূর করতে এবং শরীরে নতুন এন্টিবডি তৈরি করতে সাহায্য করে। কিসমিসের অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা এই ব্যাকটেরিয়া দূর করতে সাহায্য করে।

(১১) ত্বকের যত্নে কিসমিস
ত্বকের উন্ন্যনের জন্যও কিসমিসের উপকারিতা রয়েছে। NCBI- এর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত একটি গবেষণা অনুসারে, আঙ্গুর ফল ও আঙ্গুরফল ভিত্তিক পণ্যগুলিতে কেমোপ্রোটেক্টিভ বৈশিষ্ট্য থাকে। যা ত্বকের ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়ক। অন্য একটি গবেষণায় আরও জানা যায় কিসমিস ত্বকের একটি কার্যকর টোনার হিসাবেও কাজ করে। নিয়মিত কিসমিস খেলে ত্বকের নানান মৃত কোষ বের করতে সহায়তা করে এবং চেহারার উজ্জ্বলতাও বৃদ্ধি করে।

আমরা যে সকল চিনি জাতীয় খাবার খাই, সেখানে কিসমিস ব্যবহার করলে, একইসাথে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ হবে ও খাবারের স্বাদও পাবেন। তবে যাদের ডায়াবেটিস হয়েছে তাদের অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী কিসমিস খাওয়া উচিত।

আরও পড়ুন: সজনে পাতার উপকারিতা ও ঔষধি গুণাগুন

কিসমিস খাওয়ার নিয়ম

কিসমিসের উপকারিতা
কিসমিস

কিসমিসের উপকারিতা সবচেয়ে বেশি পেতে নিয়ম মেনে এবং পরিবার মত কিসমিস খেতে হবে। দৈনন্দিন খালেদার বিভিন্ন উপায়ে কিসমিসকে অন্তর্ভুক্ত করতে পারবেন। যেমন-

  • শুকনা কিসমিস সরাসরি খেতে পারেন।
  • পানিতে ভেজানো কিসমিস ও তার পানি।
  • পিনার বাটার এর সাথে মিশিয়ে।
  • ফ্রুট সালাদের সাথে।
  • কিসমিসের সাথে ব্রকলি, গাজর ইত্যাদি সবজি মিশিয়ে, সালাদ হিসেবে খাওয়া যেতে পারে।
  • সকালের নাস্তায় ওটসে চিনির পরিবর্তে কিসমিস ব্যবহার করতে পারেন।
  • বিভিন্ন মিষ্টি সাদযুক্ত খাবার তৈরীর ক্ষেত্রে চিনির পরিবর্তে কিসমিস ব্যবহার ইত্যাদি।

এছাড়াও আপনার প্রয়োজনীয়তা অনুযায়ী যেকোনো ভাবেই খাদ্য তালিকায় কিসমিস অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন।

কিসমিস ভিজিয়ে খাওয়ার উপকারিতা

নিয়মিত ভেজানো কিসমিস খেলে –

  • রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে;
  • হজমশক্তি বাড়ে;
  • কোষ্ঠকাঠিন্য কমায়;
  • রক্ত স্বল্পতা দূর হয়;
  • রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে;
  • শরীর ডি-টক্সিফাই হয়;
  • যৌন স্বাস্থ্যের উন্নতি হয়;
  • ত্বকের যত্নে;
  • চুলের উন্নয়নে সহায়তা করে।

সর্বোচ্চ ফলাফল পেতে রাতে এক গ্লাস পানিতে কিছু কিসমিস ভিজিয়ে রাখুন। সকালে খালি পেটে সেই ভেজানো কিসমিস খান এবং গ্লাসে থাকা পানিগুলো পান করতে পারেন।

সকালে খালি পেটে কিসমিস খাওয়ার নিয়ম ও উপকারিতা

মানবদেহের জন্য কিসমিসের উপকারিতা উপরোক্ত আলোচনা থেকে আমরা জেনেছি। তবে এই উপকারিতা গুলোর সর্বোচ্চ ফলাফল পেতে সবচেয়ে বেশি কার্যকর সকালে খালি পেটে ভেজানো কিসমিস খাওয়া।

এর জন্য রাতে এক গ্লাস পানিতে কিছু কিসমিস ভিজিয়ে রাখুন। সকালে খালি পেটে সেই ভেজানো কিসমিস খান এবং গ্লাসে থাকা পানিগুলো পান করুন। এভাবে নিয়মিত খেলে আপনার স্বাস্থ্যের উপর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব দেখতে পাবেন।

প্রতিদিন কতটুকু কিসমিস খাওয়া উচিত

কিসমিসের অনেক বেশি স্বাস্থ্য উপকারিতা থাকলেও একটি পরিমিত পরিমাণে খাওয়া উচিত। কিসমিসে থাকা প্রোটিন, আয়রন, ফাইবার, কপার, পটাসিয়াম এবং ভিটামিন বি৬ সহ অন্যান্য উপাদান স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। তবে এ সকল উপাদানের আধিক্য স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। তাই বিশেষজ্ঞদের মতে, দিনে ৪০ থেকে ৫০ গ্রাম কিসমিস খাওয়া উচিত।

কিসমিসের ক্ষতিকর দিক

সাধারণভাবেই স্বাস্থ্যের জন্য কিসমিসের উপকারিতা অনেক। পরিমাণের বেশি খেলে উপকারের চেয়ে ক্ষতির সম্ভাবনাই বেশি থাকে। কিসমিস বেশি খাওয়ার কিছু ক্ষতিকর দিকগুলো হলোঃ

ওজন বৃদ্ধি পায়ঃ কিসমিসে উচ্চ মাত্রায় ক্যালোরি রয়েছে। তাই বেশি পরিমাণে কিসমিস খেলে ওজন বৃদ্ধি পেতে পারে। যারা পূর্বেই অতিরিক্ত ওজন ধারন করেছেন, তাদের জন্য কিসমিস স্বল্প পরিমাণে খাওয়া উচিত।

রক্তে শর্করার মাত্রা বাড়িয়ে দেয়ঃ কিসমিস ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করলেও প্রাকৃতিকভাবে এত চিনি ও ক্যালোরি রয়েছে অনেক। তাই এটি অল্প খেলে উপকারিতা পেলেও, মাত্রাতিরিক্ত কিসমিস খেলে রক্তে শর্করার পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। যা বিভিন্ন স্বাস্থ্য ঝুঁকি সৃষ্টি করে।

পরিপাকতন্ত্রে সমস্যাঃ কিসমিসে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার বা আঁশ থাকে। মানবদেহের পরিপাকতন্ত্রের জন্য এটি খুবই উপকারি। তবে কিসমিস খাওয়ার পরিমাণ বেশি হলে এর ফাইবার গুলো বদহজমের সৃষ্টি করতে পারে। ডায়েটারি ফাইবার আমাদের শরীরের অতিরিক্ত তরল শুষে নেয়। এটি ডায়রিয়ার প্রতিকারে সহায়ক। তবে অতিরিক্ত কিসমিস খেলে পানি শূন্যতা দেখা দিতে পারে এবং বদহজমের কারণ হতে পারে।

ত্বকের অ্যালার্জিঃ কিছু মানুষের দেহে কিসমিসে সংবেদনশীলতা/ এলার্জি থাকতে পারে। তাই কিসমিস খেলে অনেকের ত্বকে ফুসকুড়ি বা চুলকানি হয়।

তাই কিসমিস খেলে আপনার কোন সমস্যা হলে ডাক্তারের পরামর্শ নিন। এবং স্বল্প পরিমাণে কিসমিস সেবন করুন।

শেষকথা

উপরোক্ত আলোচনা থেকে কিসমিসের উপকারিতা ও ব্যবহার বিধির বিস্তারিত জানা যায়। কিসমিসের কিছু ক্ষতিকর দিক থাকলেও স্বল্পমাত্রায় নিয়মিত খেলে এর সর্বোচ্চ উপকারিতা পাবেন। তবে আপনার স্বাস্থ্যে কিসমিস খাওয়ার কোন নেতিবাচক প্রভাব পড়লে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ীই তা সেবন করুন।