জিয়ারতের দোয়া: কবর জিয়ারত রাসুলুল্লাহ (সাঃ)- এর একটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নত। কবর জিয়ারত কিভাবে করবো, কবর জিয়ারতের দোয়া ও নিয়ম সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিন এখানে।
কবর জিয়ারতে মূলত মৃত ব্যক্তির মাগফেরাতের জন্য মহান আল্লাহর কাছে দোয়া করা হয়। তবে এর পাশাপাশি কবর জিয়ারতকারী ব্যক্তির অন্তরের মৃত্যু ও পরকালের ভয় জাগ্রত হয়। বান্দা আল্লাহ সন্তুষ্টির পথে এবং নেক আমলের দিকে অগ্রগামী হয়।
ইসলামের প্রথমদিকে কবর জিয়ারতের উপর নিষেধাজ্ঞা ছিল। পরে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কবর জিয়ারতের অনুমতি দিয়ে বলেন- “আমি তোমাদের কবর জিয়ারাতে নিষেধ করেছিলাম এখন থেকে (তোমরা) কবর জিয়ারত করো। কেননা, তা দুনিয়া বিমুখতা এনে দেয় এবং আখেরাতের কথা স্মরণ করায়।” (ইবনে মাজাহ: ১৫৭১)
জিয়ারতের সময় করা আপনজনদের দোয়া মৃত ব্যক্তির নাজাতের অন্যতম উপায়। তাই কবর জিয়ারতের দোয়া ও নিয়ম মেনে সঠিকভাবে কবর জিয়ারত করুন।
কবর জিয়ারতের দোয়া। কবরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় দোয়া
কবর জিয়ারতের জন্য আল্লাহর রাসূল (সাঃ) আমাদের দোয়া শিক্ষা দিয়েছেন। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) মদিনার কবরবাসীর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় এই দোয়া পাঠ করেন –
আরবি: السَّلاَمُ عَلَيْكُمْ يَا أَهْلَ الْقُبُورِ يَغْفِرُ اللَّهُ لَنَا وَلَكُمْ أَنْتُمْ سَلَفُنَا وَنَحْنُ بِالأَثَرِ
বাংলা উচ্চারণ: “আসসালামু আলাইকুম, ইয়া আহলাল কুবুর; ইয়াগফিরুল্লা হু-লানা ওয়ালাকুম, আনতুম সালা-ফুনা, ওয়া নাহনু বিল আ’সার।”
বাংলা অর্থ: “হে কবরবাসী, তোমাদের ওপর শান্তি বর্ষিত হোক। আল্লাহ আমাদের ও তোমাদের ক্ষমা করুন। তোমরা আমাদের অগ্রে কবরে গিয়েছ এবং আমরা পরে আসছি।” (সুনানে তিরমিজি- ১০৫৩)
কবর জিয়ারত করার দোয়া
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) মুসলিম উম্মাহ কে কবর জিয়ারত করতে উৎসাহিত করেছেন। তিনি আমাদের কবর জিয়ারতের দোয়া ও নিয়ম শিক্ষা দিয়েছেন। হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, একবার রাসুলুল্লাহ (সাঃ) একটি কবর জিয়ারতে গিয়ে বলেন-
আরবি: السَّلامُ عَلَيْكُمْ دَارَ قَوْمٍ مُؤمِنينَ وإِنَّا إِنْ شَاءَ اللَّهُ بِكُمْ لاحِقُونَ
বাংলা উচ্চারণ: “আসসালামু আলাইকুম, দারা ক্বাওমিম্ মু’মিনিন, ওয়া ইন্না ইন-শা-আল্লাহ বিকুম লা-হিকুন।”
বাংলা অর্থ: “এই মুমিন ঘরবাসীদের ওপর শান্তি বর্ষিত হোক। ইন-শা-আল্লাহ আমরা আপনাদের সঙ্গে মিলিত হবো।” (সহিহ মুসলিম- ২৪৯)
আরও পড়ুন: নামাজের সকল দোয়া সমূহ। নামাজের তাসবীহ ও দোয়া সমূহের অর্থ
জিয়ারতের নিয়ম
কবরস্থানে পাশে উপস্থিত হয়ে সর্বপ্রথম কবর জিয়ারতের দোয়া পড়বেন। এরপর কবরবাসীর মাগফিরাতের জন্য সওয়াবের নিয়তে দরুদ শরিফ, ইস্তেগফার শরিফ ও বিভিন্ন সুরা ইত্যাদি পড়বেন। কবরবাসীর মাগফিরাতের জন্য দোয়া করবেন।
হাদিস শরিফে কবর জিয়ারতের ক্ষেত্রে কিছু সুরার বিশেষ ফজিলতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। পাশাপাশি দরুদ শরিফের ফজিলতের কথা ও এসেছে। তাই দরুদ শরিফ, সুরা ফাতিহা, সুরা ইখলাস, আয়াতুল কুরসি ও অন্য যেসব সুরা সহজ মনে হয়— সেগুলো পড়ে সওয়াব বখশিয়ে দেবেন।
নিম্নে কবর জিয়ারতের নিয়ম সম্পর্কে আরো বিস্তারিত আলোচনা করা হলো: কবরস্থানে উপস্থিত হয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি জ্ঞাপন করে মৃত ব্যক্তির জন্য দোয়া করতে হয়। এক্ষেত্রে কবর জিয়ারতের কিছু সুন্নত ও সাহাবায়ে কেরামের আমার অনুসরণ করতে পারেন। যেমন-
- কবরস্থানে উপস্থিত হয়ে, প্রথমেই কবর জিয়ারতের দোয়া পড়া।
- কবরবাসীদের ইসালে সওয়াবের নিয়তে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর উপর দুরুদ পড়া।
- আল্লাহর শুকরিয়া জ্ঞাপন করে তাসবিহ পাঠ করা।
- কবর জিয়ারতের সময় বিশেষ ফজিলতপূর্ণ সূরা পড়া।
- মৃত ব্যক্তি বা কবরবাসীদের জন্য মন খুলে মহান আল্লাহর কাছে মাগফিরাতের দোয়া করা।
- হাত উঠিয়ে বা হাত নামিয়ে এবং মনে মনেও জিয়ারতের দোয়া করা যায়।
হাদিস শরীফে কবর জিয়ারতের দোয়া ও নিয়ম অনুযায়ী কিছু বিশেষ সূরার উল্লেখ রয়েছে। এগুলো হলো-
- সূরা ফাতিহা;
- সূরা ইখলাস;
- আয়াতুল কুরসি;
- সূরা আত-তাকাছুর।
এছাড়াও সূরা বাকারার শেষ ২ আয়াত, সূরা কাহাফ- এর প্রথম ১০ আয়াত, সূরা তওবার শেষ দুই আয়াত সহ সুবিধা মতো আরো কিছু সূরা পাঠ করতে পারেন। এতে কবরবাসীদের ইসালে সওয়াবের পাশাপাশি আপনার জন্য নেকি পাবেন।
কবর জিয়ারতের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ হচ্ছে দুরুদ পড়া। তাই সেখানে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর উপর বেশি বেশি দরুদ পাঠ করুন।
মুর্দেগানের জন্য কবর জিয়ারতের ফজিলত
মুসলমানদের জন্য কবর জিয়ারতের অনেক ফজিলত রয়েছে। কোন সন্তান তার পিতা মাতার জন্য দোয়া করলে মহান আল্লাহ তা’আলা পিতা-মাতার কবরের আজাব ক্ষমা করে দেন। পাশাপাশি অন্যান্য কবরবাসীদের জন্য দোয়া পৌঁছায়। এছাড়াও কবর জিয়ারতের অন্যান্য ফজিলত গুলো হলো-
মহান আল্লাহ তায়ালা হাশরের দিন ওই সকল পিতা মাতার মর্যাদা বাড়িয়ে দিবেন যাদের সন্তান তাদের জন্য ক্ষমা চেয়েছে। কবর জিয়ারতকারী ব্যক্তির মনে মৃত্যুর ভয় জাগ্রত হয়।
কবর জিয়ারতের দোয়া ও নিয়ম মেনে জিয়ারত করলে অনেক সওয়াব হয়। দুনিয়ার আসক্তি কমে যায়। আখিরাতে সফলতা অর্জনের আকাঙ্ক্ষা বাড়ে। গুনাহ পাপাচার থেকে মুক্ত থাকে।
হাদিস শরীফে জুমার দিন কবর জিয়ারতে উৎসাহিত করা হয়েছে। আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বলেন- “যে ব্যক্তি প্রতি জুমায় তার পিতা-মাতা বা তাদের একজনের কবর জিয়ারত করবে, তাকে ক্ষমা করে দেওয়া হবে এবং পিতা মাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার কারীদের মধ্যে গণ্য করা হবে।” (আল মুজামুল আউসাত- ৬১১৪)
জিয়ারতের সময় নিষিদ্ধ বিষয়
কবর জিয়ারতের ক্ষেত্রে এমন কিছু করা যাবে না যা শিরক কিংবা বিদআতের অন্তর্ভুক্ত। কবর জিয়ারতের নিষিদ্ধ বিষয়গুলো হলো-
- কবরবাসীর কাছে কোন কিছু পাবার আশা।
- কবরের মাঠে ছুঁয়ে সালাম বা সেজদা করা।
- কবরের উদ্দেশ্যে মানত করা। দান-খয়রাত, গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগি ইত্যাদি দেওয়া।
- লোক দেখানো, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বা দুনিয়ার স্বার্থে কবর জিয়ারত করা।
- কবরবাসীর উছিলায় নিজের মুক্তি কামনা করা।
- কবরের পাশে হায়-হুতাশ করে কান্না করা। কবরের পাশে হায়-হুতাশ করার আশঙ্কায় নারীদের কবর জিয়ারত করতে নিষেধ করা হয়েছে।
হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন- “রাসুল (সাঃ)- মহিলা কবর জিয়ারতকারী, কবরের ওপর মসজিদ নির্মাণকারী ও তাতে বাতি প্রজ্বালন কারীদের অভিশাপ দিয়েছেন।” (আবু দাউদ- ৩২৩৬)
এছাড়াও কবর সামনে রেখে দুই হাত তুলে মোনাজাত করা উচিত নয়। কবরের দিকে পিঠ দিয়ে কেবলামুখী হয়ে দোয়া করা উচিত। সঠিকভাবে কবর জিয়ারতের দোয়া ও নিয়ম আদায় করতে হবে।
শেষকথা
কবরে চলে যাওয়া ব্যক্তিদের দোয়া করার কোন সুযোগ নেই। তাই পরিবারের মৃত সদস্য ও অন্যান্য কবরবাসীদের জন্য নিয়মিত কবর জিয়ারতের মাধ্যমে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। একইসাথে নিজের আমল বৃদ্ধির জন্য কবর জিয়ারতের দোয়া ও নিয়ম মেনে প্রার্থনা করতে হবে।