লাক্কাতুরা চা বাগান (Lakkatura Tea Garden) সিলেট শহরের চৌকিঢেঁকি উপজেলায় ওসমানি বিমান বন্দরের নিকটে অবস্থিত অনন্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা চা বাগান। এই চা বাগানটি ন্যাশনাল টি বোর্ড অধীনস্থ সরকারি একটি বাগান। এটি বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ একটি চা বাগান। এই চা বাগান থেকে বছরের প্রায় ৫ লক্ষ কেজি চা উৎপাদিত হয়। এই চা বাগানটির অবস্থান প্রায় ১২৯৩ হেক্টর ৩২০০ একর জায়গা জুড়ে।
লাক্কাতুরা চা বাগানের ইতিহাস
১৮৪৯ সালে ইংরেজ সাহেব হার্ডসনের হাত ধরে এই চা বাগানটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এই চা বাগান থেকেই সিলেটে চা চাষের গোড়াপত্তন হয়। আর বাংলাদেশে ব্রিটিশদের মাধ্যমে চায়ের উৎপত্তি ঘটে। এগুলো এখন ইতিহাস ও আমাদের ঐতিহ্যের অংশ। বর্তমানে এই চা বাগানটি ন্যাশনাল টি কোম্পানি লিমিটেডের অধীনে চলে পরিচালিত। সিলেটের এই চায়ের রং, গ্রাণ ও স্বাদে অতুলনীয়।
লাক্কাতুরা চা বাগানের অবস্থান ও বর্ণনা
লাক্কাতুরা সিলেটের বিমান বন্দরের নিকটে অবস্থিত একটি চা বাগান। এটি সিলেট শহরের উত্তর প্রান্তকে ঘিরে রাখা সবুজ চা বাগান। এই বাগানের সকল পথের ধারে উঁচু নিচু টিলার মধ্যে দিয়ে মাটির রাস্তা রয়েছে। বাগানের ভেতরের একেকটি রাস্তা হেঁটে অতিক্রম করতে প্রায় দুই ঘণ্টা সময় লাগে।
বাগানের সাথে রয়েছে স্টেডিয়াম। চারপাশে শুধু সবুজ আর সবুজ চা বাগান আর মাঝে স্টেডিয়াম। সবুজ চা বাগানে মনোরম পরিবেশে বেষ্টিত এই স্টেডিয়ামটি আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর থেকে কিছুটা দূরত্ব অবস্থিত। এখানে ২০১৪ সালে টি-টোয়েন্টি মহিলা বিশ্বকাপ হয়েছিল। এরকম সবুজ প্রকৃতির ভেতর স্টেডিয়াম হয়তো পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি খুঁজে পাওয়া যাবে না।
সিলেট চায়ের জন্য কেন বিখ্যাত?
বাংলাদেশের যে কয়টি অঞ্চলে চা বাগান রয়েছে তার মধ্যে সিলেট অন্যতম। বাংলাদেশের মোট ১৬৩ টি চায়ের বাগান থেকে ১৩৫ টি চা বাগানের অবস্থান সিলেটে। সারা বিশ্বজুড়ে চায়ের বাগানের জন্য সিলেটের খ্যাতি রয়েছে। আমাদের দেশের মোট ৯০ শতাংশ চা উৎপন্ন হয় সিলেটে। এজন্য সিলেটকে দুটি পাতা ও একটি কুঁড়ির দেশ বলা হয়। এখানে যেমন রয়েছে পাহাড়, ঝর্ণা, ঝর্ণার পানি বয়ে চলা অপরূপ নদী তেমনি হয়েছে ছোট বড় অনেক চা বাগান।
সিলেটে থাকা ১৩৫টি চা বাগানের মধ্যে কিছু উল্লেখযোগ্য চা বাগান হলো: লাক্কাতুরা চা বাগান, মালনি ছড়া চা বাগান, খাদিম চা বাগান, দল দলি চা বাগান, বড়জান চা বাগান, তারাপুর চা বাগান, আলী বাহার চা বাগান, হাবিব নগর চা বাগান, খান চা বাগান ইত্যাদি। তাই ভ্রমণ পিপাসুদের জন্য এটি অন্যতম মনোরম পরিবেশ সমৃদ্ধ অঞ্চল।
লাক্কাতুরা চা বাগান এর সৌন্দর্য
লাক্কাতুরা চায়ের বাগানটি বাংলাদেশের প্রাচীন চা বাগান গুলোর মধ্যে একটি। চারপাশে শুধু সবুজ আর সবুজ। পাহাড়ের গা ঘেঁষে ছুটে গেছে আঁকাবাঁকা মেঠো পথ। কোথাও আবার রয়েছে স্বচ্ছ পানির স্রোত ও ঝর্ণার গর্জন। সেখানে কোনো যান্ত্রিক দূষণ নেই। যেন প্রকৃতির সকল সৌন্দর্যই এখানে সম্মিলিত হয়েছে। সিলেটের প্রতিটি স্থান দেখতে অসাধারণ ও মনোমুগ্ধকর। যেন প্রকৃতি তার অপার সৌন্দর্য ঢেলে দিয়েছে এই সিলেট জেলাতে। তাই এর সৌন্দর্য থেকে মুখ ফেরাতে পারেনা দর্শনার্থীরা ও ভ্রমণ পিপাসুরা।
বাগানটির পাশেই রয়েছে চা ফ্যাক্টরি ও রাবার ফ্যাক্টরি। এই চা বাগানটির মূল প্রবেশ পথ পাওয়া যাবে বিমানবন্দর রোড থেকে ডান দিকে গেলে। প্রবেশ পথ দিয়ে ভিতরে ঢোকার পর কিছুটা সামনে গেলেই দেখা যাবে চা ফ্যাক্টরি ও রাবার ফ্যাক্টরি। তবে সেখানে যে কেউ চাইলেই ঢুকতে পারে না। সেখানকার কর্তৃপক্ষ থেকে আগে অনুমতি নিতে হবে। সেখানে ঢুকে আপনারা চা তৈরি ও রাবার তৈরি দেখতে পারবেন। এগুলো দেখেও আপনারা আনন্দ উপভোগ করতে পারবেন। ফ্যাক্টরি থেকে সামনে চলে গেছে কিছু আঁকাবাঁকা রাস্তা। সেখানে রয়েছে সেখানকার কর্তৃপক্ষদের কিছু অসাধারণ দৃশ্যমান বাংলো।
লাক্কাতুরা চা বাগান এর পাশেই রয়েছে বাংলাদেশের সর্ব প্রথম বাণিজ্যিক ভাবে প্রতিষ্ঠিত মালনি ছড়া চা বাগান। এ দুটো বৃহত্তম চা বাগানের মধ্যে দূরত্ব শুধু রাস্তার এপাশ আর ওপাশ। আপনারা চাইলে সেখানে একসাথে দুটো চা বাগান পরিদর্শন করে আসতে পারবেন। শ্রেষ্টত্বের দিক থেকে কখনো কখনো লক্কাতুরা চা বাগানটি মালনি ছড়া চা বাগান থেকে এগিয়ে যায়। বাগানের ভিতর দিয়ে হাঁটলেই চোখে পড়বে কমলা, কাঁঠাল ও সুপারি বাগান। এছাড়াও সেখানে রয়েছে আগর, রাবার, ট্যাং ফল, চন্দনসহ অনেক শোভাবর্ধক বৃক্ষ।
চা বাগানের মধ্য দিয়ে হেটে সেই জায়গার সৌন্দর্য উপভোগ করা সত্যিই খুবই আকর্ষণীয়। এখান থেকেই দেখতে পারেন রাবার বাগান থেকে শ্রমিকদের চা পাতা সংগ্রহ করা। প্রকৃতি প্রেমীদের কাছে অন্য এক ভালো লাগার ধারক হয়ে আছে সিলেটের চা বাগান।
কিভাবে যাবেন
লাক্কাতুরা চা বাগান যেথে হলে প্রথমে সিলেট শহরে আসতে হবে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত হতে সিলেট আসা যায়। বাস, ট্রেন কিংবা আকাশ পথে সিলেট যাথায়াত করতে পারেন। ঢাকা-চট্টগ্রামের সাথেও রেল সংযোগ আছে।
সিলেট পৌছে আম্বরখানা মূল পয়েন্ট থেকে লাক্কাতুরা চা বাগানে যেতে পারবেন। সময় লাগবে মাত্র ১০ মিনিটের মতো। সিএনজিতে গেলে ভাড়া লাগবে জনপ্রতি ৫-১০ টাকা আর অটো রিক্সায় গেলে ভাড়া লাগবে ১৫-২০ টাকা মাত্র।
কোথায় থাকবেন
সিলেট শহরে ভালো মানের থাকার যায়গা রয়েছে, আপনি আপনার প্রয়োজন ও সামর্থ্য অনুযায়ী যে কোন ধরনের ছোট বড় হোটেলে থাকতে পারবেন। রাত যাপনের জন্য বিভিন্ন মানের আবাসিক হোটেল রয়েছে। রুম ভাড়া ৫০০/- টাকা থেকে ৫০০০/- টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে।
কয়েকটি পরিচিত আবাসিক হোটেলের নাম ও যোগাযোগ নাম্বার দেওয়া হলো:
- শহরের শাহজালাল উপশহরে হোটেল রোজ ভিউ (০৮২১-৭২১৪৩৯)।
- বন্দরবাজারে হোটেল মেট্রো ইন্টারন্যাশনাল (০৮২১-৭২১১৪৩)।
- জেল সড়কে হোটেল ডালাস (০৮২১-৭২০৯৪৫)।
- দরগা গেইটে হোটেল স্টার প্যাসিফিক (০৮২১-৭২৭৯৪৫)।
- ভিআইপি রোডে হোটেল হিলটাউন (০৮২১-৭১৬০৭৭)।
- আম্বরখানায় হোটেল পলাশ (০৮২১-৭১৮৩০৯)।
- নাইওরপুলে হোটেল ফরচুন গার্ডেন (০৮২১-৭১৫৫৯০)।
- লিঙ্ক রোডে হোটেল গার্ডেন ইন (০৮২১-৮১৪৫০৭)।
- হোটেল উর্মি (০৮২১-৭১৪৫৬৩)৷
- দরগা এলাকায় হোটেল দরগাগেইট (০৮২১-৭১৭০৬৬)।
কোথায় খাবেন
খাবারের জন্য সিলেট সেরা, এখানে যা মনে চায় তাই খেতে পারেন। খাবার নিয়ে আপনার কোন চিন্তা করতে হবে না। সিলেটের সেরা হোটেলগুলোর মধ্যে আপনি পাঁচ ভাই রেস্টুরেন্ট, পানশি রেস্টুরেন্ট, উঠান রেস্টুরেন্ট, প্রেসিডেন্ট রেস্টুরেন্ট সহ অনেক উন্নতমানের খাবার রেস্টুরেন্ট রয়েছে। মাছ, মাংস, সুটকি ভর্তা সহ বিভিন্ন ধরনের খাবার এসব হোটেলে পাবেন। রয়েছে উন্নত মানের চাইনিজ রেস্টুরেন্ট ও অসংখ্য ছোট বড় খাবার হোটেল এসব হোটেলে আপনি সূলভ মূল্যে বিরিয়ানি সহ নানা প্রকার খাবার খেতে পারবেন। সিলেটের সাত করা/হাত করার স্বাদও নিতে পারেন।
আশপাশের দর্শনীয় স্থান
হযরত শাহ জালাল (র:) মাজার, সিলেট
শেষকথা
সিলেট যেখানেই যাবেন সেখানের সুন্দরতা আপনাকে মুগ্ধ করবেই। তাদের মধ্যে লাক্কাতুরা চা বাগান একটি। চা প্রেমি মানুষেরা প্রতিদিন এই বাগান পরিদর্শনে আসেন এবং বাগানের সুন্দরতা দেখে মুগ্ধ হন।