বাংলাদেশের রংপুর জেলার বদরগঞ্জ উপজেলা শহর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার পশ্চিমে গোপীনাথপুর ইউনিয়নের লালদিঘী এলাকায় ঐতিহাসিক লালদীঘি নয় গম্বুজ মসজিদ বা লালদীঘি মসজিদ অবস্থিত। বাংলাদেশের একটি অন্যতম প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হলো লাল দিঘি নয় গম্বুজ মসজিদ। এই মসজিদটি বদরগঞ্জ উপজেলার লালদিঘী নামক স্থানে অবস্থিত বলে একে স্থানের নামে নামকরণ করা হয়েছে। তাই মসজিদটি লালদিঘী মসজিদ বা লালদীঘি নয় গম্বুজ মসজিদ নামে পরিচিত । শত শত বছর আগের পুরাতন এই মসজিদটি। লালদীঘি মসজিদটি দর্শন করতে সেখানে প্রতিদিন অনেক অনেক দর্শনার্থী যাতায়াত করে।
লালদীঘি নয় গম্বুজ মসজিদের সাধারণ কিছু তথ্য
- ধরন – প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন।
- স্থানীয় নাম – লালদীঘি মসজিদ।
- অবস্থান – বদরগঞ্জ উপজেলা।
- অঞ্চল – রংপুর জেলা।
- মালিক – বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর।
- পরিচালক বর্গ – বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর।
- সুত্র নং – BD- F- 55-9।
লালদীঘি নয় গম্বুজ মসজিদের ইতিহাস
সর্বপ্রথম ভারতীয় উপ-মহাদেশে ব্রিটিশ শাসন আমলে এই মসজিদটি আবিষ্কৃত হয়। পরবর্তীতে স্থানীয় বাসিন্দারা স্থানটিকে পরিষ্কার করে ও মসজিদ টিকে সংস্কার করে এই মসজিদটি ব্যবহার করতে থাকে। এই মসজিদটির মূল দরজার উপরের অংশ একটি দাগ ছিল যা দেখে ধারণা করা হয় সেখানে যতটুকু সম্ভব মসজিদ টির নাম অথবা নির্মাণ ফলক ছিল। তবে সেখানে এরকম কোন কিছুই পাওয়া যায়নি। মসজিদের গায়ে কোন শিলালিপি না থাকায় লালদীঘি মসজিদের নির্মাণকাল সম্পর্কে কোন কিছু জানা যায়নি।
তবে প্রত্নতাত্ত্বিক দের মতে ব্রিটিশ শাসন আমলে এই মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছে। আবার অনেকে মনে করেন শেষ মোঘল যুগের স্থাপত্য শৈলীর সাথে মিল থাকায় ১২১২ সালে লালদীঘি মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছিল। স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে প্রচলিত আছে যে, এক রাতের মধ্যেই লালদীঘি নয় গম্বুজ মসজিদ ও মসজিদের পুকুরটি খনন করা হয়েছে। তবে কিংবদন্তী অনুসারে জনৈক দেলোয়ার খান লালদীঘি নয় গম্বুজ মসজিদটি নির্মাণ করেন। এই দেলোয়ার খানের পরিচয় এখনো জানা যায়নি।
এই মসজিদের অনেক স্থাপত্যের বৈশিষ্ট্য মোঘল আমলে নির্মিত কিশোরগঞ্জের গোড়ায় মসজিদ (আনুমানিক ১৩৮০), বগুড়ার ফররুখ সিয়ার মসজিদ (১৭১৮ সাল) ও বাঘের হাটের চাকশ্রী মসজিদ (আনুমানিক ১৭ শতকের শেষ ভাগ) প্রভৃতির সঙ্গে সাদৃশ্য পূর্ণ। তাই এ মসজিদের নির্মাণকাল স্থাপত্যিক বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে ১৭ শতকের শেষ ভাগ অথবা ১৮ শতকের প্রথম ভাগে নির্ধারণ করা যায়।
তবে বর্তমানে লালদীঘি মসজিদের ইমাম হাফেজ মাওলানা মনজুরুল ইসলাম বলেন, ১২০৪ বঙ্গাব্দে জমিদার আসালাত খাঁ ও তার স্ত্রী দিলারা খাঁ ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে রংপুরে এসে এই নয় গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদটি নির্মাণ করেন। মসজিদের ভিতরে তাদের মাজার ও রয়েছে।
আরও পড়ুন: ঢাকার দর্শনীয় মসজিদ সমূহ
লালদীঘি নয় গম্বুজ মসজিদের অবকাঠামো
লালদিঘী নয় গম্বুজ মসজিদটি পুরোটাই একটি বেদীর উপর বসানো। মঞ্চটি বা বেদীর উচ্চতা এক মিটার। ধারণা করা হয় যে এক মিটার বেদীর অর্ধেকটা জুড়ে মসজিদ ও বাকি অর্ধেকটা আজান দেওয়ার কাজে ব্যবহৃত হতো। এই মসজিদটি তৈরির সময় এতে ইট, চুন ও সুরকি ব্যবহার করা হয়েছে। লালদীঘি নয় গম্বুজ মসজিদটির ভিতরে গরম কালে ঠান্ডা ও শীত কালে গরম লাগে। মসজিদের কাছেই রয়েছে ছোট একটি ঘাট বাঁধানো পুকুর।
মসজিদের সামনে রয়েছে বড় একটি প্রবেশ পথ। লালদীঘি মসজিদটিতে মোট ৯টি গম্বুজ রয়েছে। যার প্রতি বাহুর দৈর্ঘ্য ৯.৪৫ মিটার। মসজিদটির উত্তর, দক্ষিণ ও পূর্ব দেয়ালে ৩টি করে মোট ৯টি প্রবেশ পথ রয়েছে। প্রত্যেক দেয়ালের মাঝের যে প্রবেশ পথটি রয়েছে সেটি অপর দুটি থেকে কিছুটা বড় আকৃতির পথ। উচ্চতায় প্রশস্ততায় উত্তর ও দক্ষিণ পাশের মধ্যবর্তী দরজায় দুটি পূর্ব দিকের কেন্দ্রীয় প্রবেশ পথটির সমান। দু পাশের উন্মুক্ত দুটি অংশ জানালা ও ইটের তৈরি জালি দিয়ে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
এই মসজিদের ৩টি অর্ধ অষ্টকোনা আকৃতির মেহরাব রয়েছে পশ্চিম দেয়ালে। মেহরাবের কুলুঙ্গির উপরে অর্ধ গম্বুজ খিলান ছাদে এখনও রয়েছে পূর্ণ প্রস্ফুটিত পদ্ম নকশার অর্ধাংশ আর মেহরাবের উপরে স্থাপিত ব্যান্ডে রয়েছে বদ্ধ পদ্ম পাপড়ি নকশার সাড়ি। অপর দুটি মেহরাবের চেয়ে কেন্দ্রীয় মেহরাবটি সবচেয়ে বড় আকৃতির। লালদীঘি নয় গম্বুজ মসজিদ এর অংশ থেকে বেদীর অপর অংশে পৌঁছানোর জন্য রয়েছে একটি সিঁড়ি।
পুরো ইমারতটির ভিতরের ও বাইরের দেয়াল চুন ও সুরকির পলেস্তার দিয়ে মসৃণ ভাবে আবৃত। পশ্চিম দিকের দেয়াল ব্যতীত বাকি তিন দেয়ালের বাইরের অংশ পলেস্তার দিয়ে তৈরি ছোট ছোট খোপ নকশা দিয়ে অলংকৃত। পলেস্তারার প্যাচানো নকশা অলংকৃত ইমারতের পুরো বিস্তার জুরে রয়েছে একটি অনুভূমিক কার্নিশের ব্যান্ড। আর এর পুরোটা জুড়ে রয়েছে বদ্ধ পদ্ম পাপড়ির নকশার সারি ।
লালদীঘি নয় গম্বুজ মসজিদ এর বর্তমান অবস্থা
লালদিঘি নয় গম্বুজ মসজিদকে ঘিরে বর্তমানে অনেক কিছু সেখানে গড়ে উঠেছে। ১৪ একর বিশাল সম্পত্তিতে দাঁড়িয়ে থাকা ছোট এই লাল দিঘী মসজিদের বর্ধিত অংশসহ বর্তমান আয়তন প্রায় ৩৫ শতাংশ। বাকি জমি গুলোতে একটি ফোরকানিয়া মাদ্রাসা, লালদিঘি জান্নাত বাগ হাফিজিয়া এতিমখানা, ঘাট বাঁধানো ছোট একটি পুকুর, মাদ্রাসা মাঠ, কবরস্থান ও সাপ্তাহিক হাট বসানোর জায়গা রয়েছে।
কিভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে ট্রেনে রংপুর : ঢাকা থেকে ট্রেনে করে ও রংপুরে যাওয়া যায়। ঢাকার কমলাপুর রেল স্টেশন থেকে রংপুর এক্সপ্রেস ট্রেন সপ্তাহে একদিন সোমবার ছাড়া সপ্তাহের বাকি ৬ দিন সকাল ৯ টা ১০ মিনিটে ছেড়ে যায় ও কুড়িগ্রাম ট্রেন বুধবার ছাড়া সপ্তাহের বাকি ছয় দিন ৮ টা ৪৫ মিনিটে ছেড়ে যায়। ট্রেনের জনপ্রতি টিকেট ভাড়া শোভন চেয়ার ৪৭০ – ৫৫০ টাকা, স্নিগ্ধা ভাড়া ৯০৩ থেকে ৯৬৬ টাকা, এসি কেভিন ভাড়া ১৬৭২ টাকা ও এসি সিট ভাড়া ১১৬২ টাকা।
ঢাকা থেকে বাসে রংপুর : রাজধানী ঢাকার কল্যাণপুর, মোহাম্মদপুর, গাবতলী এবং মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে রংপুর যাওয়ার এসি ও নন এসি বাস এই রোডে চলাচল করে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য বাস গুলো হলো – আগমনী এক্সপ্রেস, নাবিল, হক এন্টারপ্রাইজ, গ্রীন লাইন, এস আর ট্রাভেলস, এনা, আলহামরা, হানিফ, মিম পরিবহন ইত্যাদি। ঢাকা থেকে রংপুর যেতে ও নন ও এসি বাসের মান ভেদে ভাড়া লাগে প্রায় ৭০০ থেকে ১৩০০ টাকা। তারপর সেখানে লালদীঘি নয় গম্বুজ মসজিদ পরিদর্শন করতে পারবেন।
কোথায় থাকবেন
রাত যাপন করার জন্য রংপুরে বিভিন্ন মানের বিভিন্ন আবাসিক হোটেল রয়েছে। রংপুরের বিভিন্ন আবাসিক হোটেল গুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু হোটেল গুলো হলো – পর্যটন মোটেল, হোটেল গোল্ডেন টাওয়ার, দি পার্ক হোটেল, হোটেল নর্থ ভিউ, হোটেল কাশপিয়া ও হোটেল তিলোত্তমা ইত্যাদি। সুতরাং লাল দিঘী নয় গম্বুজ মসজিদে ঘুরতে গেলে থাকতে কোন সমস্যা হবে না।
কোথায় খাবেন
বিভাগীয় শহর রংপুরে বিভিন্ন মানের খাবারের হোটেল ও রেস্টুরেন্ট রয়েছে চাইলে সেখান থেকে নিজের উদরপূর্তিটুকু সেরে নিতে পারবেন। অথবা যে আবাসিক হোটেলে থাকবেন সেখানেও খাবারের ব্যবস্থা থাকে। আমের সিজনে রংপুরে গেলে রংপুরের বিখ্যাত হাড়ি ভাঙ্গা আম ও খেয়ে দেখতে পারেন।
রংপুর জেলার অন্যান্য দর্শনীয় স্থান সমূহ
পায়রাবন্দ,
দেবী চৌধুরাণীর রাজবাড়ি,
প্রয়াস সেনা বিনোদন পার্ক,
ভিন্নজগত পার্ক,
তাজহাট জমিদার বাড়ি।
লালদীঘি নয় গম্বুজ মসজিদ সম্পর্কিত সচরাচর জিজ্ঞাসিত প্রশ্নোত্তর (FAQ’s)
লালদীঘি নয় গম্বুজ মসজিদ কোথায় অবস্থিত?
লালদীঘির ঐতিহাসিক নয় গম্বুজ মসজিদটি রংপুর জেলার বদরগঞ্জ উপজেলা শহর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার পশ্চিমে গোপীনাথপুর ইউনিয়নের লালদিঘী এলাকায় অবস্থিত।
লালদীঘি মসজিদটি কে নির্মাণ করেন?
কিংবদন্তী অনুসারে জনৈক দেলোয়ার খান লালদীঘি নয় গম্বুজ মসজিদটি নির্মাণ করেন। তবে সেই দেলোয়ার খানের পরিচয় এখনো জানা যায়নি।
লালদীঘির ঐতিহাসিক নয় গম্বুজ মসজিদ কবে নির্মাণ হয়েছিল?
স্থাপত্যিক বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে ১৭ শতকের শেষ ভাগ অথবা ১৮ শতকের প্রথম ভাগে লালদীঘির ঐতিহাসিক নয় গম্বুজ মসজিদ নির্মাণ হয়েছিল বলে নির্ধারণ করা যায়।
শেষ কথা: লাল দীঘি নয় গম্বুজ মসজিদ ভ্রমণের মাধ্যমে অনেকেই ইসলামের ঐতিহ্য ও প্রাচীন স্থাপনা সম্পর্কে জানতে পারবেন। এজন্য আগ্রহী হয়ে হাজার হাজার দর্শনার্থী মসজিদটি ভ্রমন করে থাকেন।