দু’টি পাতা একটি কুঁড়ির দেশ সিলেটে এসে যারা খুব অল্প সময়ে খুব সুন্দর কোনো সবুজের সমারোহে হারিয়ে যেতে চান তাদের জন্য অনন্য স্থান প্রাচীন এই মালনীছড়া চা বাগান। এটি ভারত উপমহাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন চা বাগান।
১৮৫৪ সালে লর্ড হার্ডসন ১৫০০ একর জায়গার উপর এটি প্রতিষ্ঠা করেন। মালনীছড়া চা বাগান বাংলাদেশ তথা উপমহাদেশের বৃহত্তম এবং সর্বপ্রথম প্রতিষ্ঠিত চা বাগান। এই চা বাগানটি সিলেট আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছাকাছি অবস্থিত। মালনি ছড়া চা বাগানটি পর্যটতদের নিকট একটি বিস্ময়। আমাদের আজকের আলোচনা সিলেটে উপমহাদেশের প্রাচীন মালনীছড়া চা বাগান নিয়ে।
চা উৎপত্তির ইতিহাস
১৬৫০ সালে সর্ব প্রথম চীন দেশে চা উৎপাদন শুরু হয়। তার প্রায় ২০০ শত বছর পরে ১৮৫৪ সালে উপমহাদেশের সিলেট শহরে মালনীছড়া চা বাগান থেকেই প্রথম চা চাষের গোড়াপত্তন হয়। এরপর মালনীছড়া চা বাগানটি বহু বিট্রিশ, পাকিস্তানি ও বাংলাদেশি ব্যবস্থাপকের হাত ঘুরে এখনও ব্যক্তিগত মালিকানায় পরিচালনাধীন রয়েছে।
বর্তমানে মালনীছড়া চা বাগান ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অংশ। সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত কে টমাস সিলেট ভ্রমনে মালনীছড়া চা বাগানের রাস্তা দিয়ে যাওয়ার পথে বাগানের সৌন্দর্য দেখে বলেছিলেন, পৃথিবী এতো সুন্দর যে মালনীছড়া বাগান না দেখলে তা বোঝা যাবে না। শুধু হ্যারি টমাস নয়, সিলেটের চা বাগানের সবুজ মায়ায় নিজেকে জড়িয়ে প্রতিদিন জড়ো হন হাজার হাজার দেশি বিদেশি দর্শনার্থী।
বাগানের অবস্থান
সিলেট শহরের উপকণ্ঠে মালনীছড়া চা বাগানটি অবস্থিত। সিলেট শহরের কেন্দ্রস্থল জিন্দাবাজার পয়েন্ট হইতে যে কোন গাড়িতে মাত্র ১৫ মিনিটের রাস্তা। সিলেট শহর থেকে রিকশা, অটোরিকশা বা অন্যান্য গাড়িতে সিলেট হযরত শাহ জালাল বিমানবন্দর রোডে চা বাগানটির অবস্থান।
চা বাগানের বর্ণনা
সবুজ ঘেরা অনিন্দ্যসুন্দর এই চা বাগানটি সিলেট শহরের খুব কাছেই অবস্থিত । চা বাগানের দৈর্ঘ্য প্রায় আড়াই হাজার একর। রয়েছে এক হাজার দুইশ একর অন্যান্য ভূমি। রাবার বাগানের জন্য সাতশ একর জমি এবং কারখানা, আবাসন, বৃক্ষ, বনজঙ্গল জুড়ে বাকি জমিগুলো। দু’টি পাতা একটি কুঁড়ির দেশ সিলেটে এসে যারা খুব অল্প সময়ে খুব সুন্দর কোনো সবুজের গালিচায় হারিয়ে যেতে চান তাদের জন্য আকর্ষনীয় স্থান মালনীছড়া চা বাগান। দেশে উৎপাদিত মোট চা’য়ের ৯০ শতাংশই উৎপন্ন হয় সিলেটে। এজন্য সিলেটকে দুটি পাতা একটি কুঁড়ির দেশ ও বলা হয়।
বাগানে বড় বড় বৃক্ষের ছায়া । নিচে আধো আলো আধো ছায়ার সবুজ চাদর যেন এক শৈল্পিক কারুকাজ। চা-বাগানের এ প্রাকৃতিক দৃশ্য পর্যটকের মন ছুঁয়ে যায়। বর্তমানে বেসরকারি তত্ত্বাবধানে চা বাগানটি পরিচালিত হয়ে আসছে। বর্তমানে চা বাগানের পাশাপাশি কমলা ও রাবারের চাষ করা হচ্ছে।
এই চা বাগানের পাশেই বিশ্বের অন্যতম সুন্দর সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামটি অবস্থিত। মালনীছড়া চা বাগান ছাড়াও আলী বাহার চা বাগান, লাক্কাতুরা চা বাগান, লালাখান টি স্টেট, খাদিম আহমদ টি স্টেট, বরজান টি স্টেট উল্লেখযোগ্য। চা বাগানের বুক ভেদ করে চলে গেছে দৃষ্টিনন্দন সড়ক। এই সড়কে দিয়ে যতায়াত করলে সবাইকে মুগ্ধ করে চা বাগানটি।
আকাশ পথে যারা সিলেটে আগমন করেন তাদের প্রথমেই স্বাগত জানায় এই মানলীছড়া চা-বাগান। বাগানটির অতুল্য সুন্দরের মায়ায় পড়েছিলেন অনেক বিদেশি নাগরিকও। যাত্রাপথে গাড়ি থামিয়ে তারা দাঁড়িয়েছেন বাগানের পাশে। বাগানের ভিতর হাঁটলেই চোখে পড়বে কমলা বাগান, কাঁঠাল ও সুপারি সারি সারি গাছ পাশাপাশি অনেক ওষুধি গাছ সহ ফুল ফলের শোভাবর্ধক বৃক্ষ রয়েছে এই বাগানটিতে।
কিভাবে যাওয়া যায় মালনীছড়া চা বাগানে
গাড়িতে যেতে আম্বরখানা পয়েন্ট থেকে ১০-১৫ মিনিট এর পথ। রিকশায় চড়ে যেতে আধা ঘন্টা সময় লাগবে। ঢাকা শহরের গাবতলী এবং সায়েদাবাদ, মহাখালী, ফকিরাপুল বাস টার্মিনাল থেকে গ্রীন লাইন পরিবহন, হানিফ এন্টারপ্রাইজ, ইউনিক সার্ভিস, সৌদিয়া এস আলম পরিবহন, মামুন পরিবহন, রুপালী বাংলা, শ্যামলি পরিবহন ও এনা পরিবহনের এসি- নন এসি বাস সিলেটের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায় ৷
বাস গুলো সকাল থেকে রাত ১২.৪৫ পর্যন্ত নির্দিষ্ট সময় পরপর ঢাকা-সিলেট রোডে যাতায়াত করে ৷ । ঢাকা থেকে সিলেট যাতায়াত ভাড়া চার শত টাকা থেকে বারোশত টাকা। এনা পরিবহনের বাসগুলো ঢাকা মহাখালী থেকে ছেড়ে টঙ্গী ঘোড়াশাল হয়ে সিলেট পৌছায়।
ঢাকা থেকে ট্রেনে সিলেট
ঢাকা থেকে সিলেট শহরে ট্রেনে যেথে সময় লাগে ৭-৮ ঘন্টা। ঢাকার কমলাপুর ও বিমান বন্দর রেলওয়ে স্টেশন থেকে প্রতিদিন আন্তঃনগর ট্রেন পারাবত এক্সপ্রেস (মঙ্গলবার বন্ধ) জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস, উপবন এক্সপ্রেস, কালনী এক্সপ্রেস যাতায়াত করে। এসব ট্রেনের ভাড়া হয়ে থাকে ৩২০ টাকা থেকে ১০৯৯ টাকা পর্যন্ত। ট্রেনে ভ্রমণের ক্ষেত্রে রাতে গমন করাই ভালো। সকাল হতে হতে পৌঁছে যাওয়া যায় সিলেট।
আকাশপথে সিলেট
সিলেট ভ্রমণ এর জন্য ঢাকা থেকে সবচেয়ে দ্রুত সিলেট যেতে পারবেন বিমানে। ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ইউএস বাংলা, রিজেন্ট এয়ার, ইউনাইটেড এয়ার, নভোএয়ার, বিমান বাংলাদেশে করে সিলেটে যেতে পারবেন স্বল্প সময়ে। এক্ষেত্রে প্রতি সিটের জন্য বিমানের ক্লাস অনুযায়ী টিকেটের মূল্য হতে পারে ৩৫০০ থেকে ১০০০০ টাকা পর্যন্ত।
সিলেট শহরে থাকার ব্যবস্থা
আপনি যদি সিলেট শহরে কয়েকদিন ভ্রমনের উদ্দেশ্যে আসনে তাহলে রাত্রি যাপনের চিন্তা অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে। এক্ষেত্রে সিলেট শহরে বেশ কয়েকটি ভালো মানের আবাসিক হোটেল রয়েছে তার মধ্যে নিম্নে কয়েকটির তালিকা প্রদান করা হলো:
সিলেট শহরে থাকার আবাসিক হোটেল:
১। হোটেল নির্ভানা ইন (রামের দিঘির পাড়, মির্জা জাঙ্গাল, সিলেট): +৮৮০৮২১২৮৩০৫৭৬, ০১৭৩০০৮৩৭৯০, ২। হোটেল মেট্রো ইন্টারন্যাশনাল (বন্দর, শিশুপার্কের কাছে): ০১৭৩১৫৩৩৭৩৩, +৮৮০৮২১২৮৩৩৪০৪
৩। হোটেল স্টার প্যাসিফিক (দক্ষিণ দরগাহ গেইট): ০১৭১৩৬৭৪০০৯, ০১৯৩৭৭৭৬৬৩৩,
৪। সুরমা ভ্যালি গেস্ট হাউস (জেলা প্রশাসক/পুলিশ সুপারের কার্যালয়ের পাশে): ০১৭১৬০৯৫৮৩৬
৫। হোটেল অনুরাগ (ধোপা দীঘি নর্থ): ৭১৫৭১৭, ০১৭১২০৯৩০৩৯
৬। হোটেল উর্মি: হযরত শাহজালাল (র: ) মাজার শরীফ পূর্ব দরগাহ্ হেইট, সিলেট, ফোন: ০৮২১-৭১৪৫৬৩, ০১৭৩৩১৫৩৮০৫
খাবার
সিলেট ভ্রমনে আসলে খাবার নিয়ে আপনাকে কোন চিন্তা করতে হবে না। সিলেট শহরে খাবারের মান অত্যান্ত উন্নতমানের। আপনি চাইলে জিন্দাবাদ এলাকায় বেশ কিছু জনপ্রিয় রেস্টুরেন্ট রয়েছে যেমন রয়েল শেফ, পানসি, স্পাইসি, পাঁচ ভাই, ভোজন বাড়ি ও প্রীতি রাজ রেস্টুরেন্ট এ খাবার খেতে পারেন। সিলেটের জনপ্রিয় সাতকরা বা হাত করা এবং আখনি, পোলাও,বিরিয়ানি খেতে পারেন ।
বাগানের আশ-পাশের আকর্ষণ
বাগানের পূর্বদিকে প্রবেশ করলে দেখা যাবে হারং হুরং গুহা। মালনীছড়া মেইন বাংলোর পাশের রাস্তা দিয়ে প্রায় তিন কিলোমিটার পূর্বদিকে গেলেই এই গুহার দেখা পাওয়া যায়। এখানে রয়েছে আলী বাহার টি এস্টেট, লাক্কাতুরা চা বাগান, এবং পশ্চিম দিকে ভেতরে তারাপুর চা বাগান। পূর্বদিকে কালাগুল চা বাগান, আরও পূর্বে চিকনাগুল চা বাগান। পাশেই রয়েছে সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম, সিলেট আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর।
বাগান ভ্রমণ টিপস
- সিলেট গ্রুপ করে একসাথে ভ্রমণ করলে স্বল্প খরচে অধিক আনন্দ পাবেন।
- চা বাগানের এর পাশাপাশি আশেপাশের দর্শনীয় স্থানগুলো উপভোগ করুন।
- সিলেট থেকে মালনীছড়া চা বাগানে যেতে গাড়ি ঠিক করতে দরদাম করে নিন।
- বাগানের ভিতরে প্রবেশের পূর্বে সতর্ক থাকুন। অনেক স্থানে বেশ গহীন।
- স্থানীয়দের সাথে সুন্দর ব্যবহার করুন তবে বেশি ঘনিষ্ঠ না হওয়াই ভালো।
আরও পড়ুন
রাতারগুল জলাবন সিলেট- ভ্রমন টিপস্
মালনীছড়া চা বাগান নিয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন Faq’s
বাংলাদেশের চায়ের জন্য বিখ্যাত স্থান কোনটি?
চা উৎপাদনের জন্য এর বিখ্যাত অঞ্চল/স্থান হলো সিলেট এবং শ্রীমঙ্গল , শ্রীমঙ্গলকে বাংলাদেশের চা রাজধানী হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
মালনীছড়া কেন বিখ্যাত?
মালনীছড়া উপমহাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন চা বাগান। মালনীছড়া চা বাগান বাংলাদেশ তথা ভারত উপমহাদেশের বৃহত্তম এবং সর্বপ্রথম প্রতিষ্ঠিত চা বাগান।
বাংলাদেশে প্রথম চায়ের বাণিজ্যিক বাগান প্রতিষ্ঠিত হয় কত সালে?
বাংলাদেশে চায়ের প্রথম চাষাবাদ শুরু হয় ১৮৪০ সালে।
ভারতের কোথায় প্রথম চা চাষ শুরু হয়?
১৮৩৭ সালে, উজান আসামের চাবুয়ায় প্রথম ইংরেজ মালিকানাধীন চা বাগান প্রতিষ্ঠিত হয়; ১৮৪০ সালে, আসাম টি কোম্পানি এই অঞ্চলে বাণিজ্যিকভাবে চায়ের উৎপাদন শুরু করে।
শেষকথা
সিলেট, এ যেন সবুজ প্রকৃতির অভয়াশ্রম! আর সবসময় প্রকৃতির কাছাকাছি থাকা মানুষের জন্য সেরা স্থান। যখন প্রকৃতির সব বিচিত্র সৌন্দর্য মিশে আছে চা গাছের সবুজ পাতায় পাতায়। তো এই অপরূপ মালনীছড়া চা বাগানের দেশে আপনাকে স্বাগতম…। ধন্যবাদ