মেথি (Fenugreek) বাংলাদেশে ইউনানী, আয়ুর্বেদিক ও লোকজ ব্যবহারে বহুল প্রচলিত। মেথির পুষ্টিগুণে বিবেচনায় মানব দেহের জন্য মেথির উপকারিতা অনেক আছে। একইসাথে কিছু ক্ষতিকর দিকও রয়েছে। এখানে জেনে নিন মেথি কি, মেথির পুষ্টিগুণ, মেথির উপকারিতা, অপকারিতা ও খাওয়ার নিয়ম।
মেথির (Fenugreek) পাতা ও বীজ উভয়ই খাওয়া যায়। গ্রাম বাংলার মানুষ মেথিপাতা কে শাক হিসেবেও খায়। মেথিকে খাবার পথ্য ও মসলা হিসেবেও খাওয়া যায়। মেথি থেকে স্টেরয়েডের উপাদান তৈরি হয়। মেথির তিতা স্বাদের জন্য অনেকের কাছে এটি একটি অপছন্দীয় খাবার। তবে গুনাগুনের কারনে এবং মেথির উপকারিতার জন্য একে সুপারফুড বলা যায়।
একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, প্রতিদিন মেথি খেলে দূষিত পরিবেশ ও ভেজাল খাবারের মধ্যেও সুস্থভাবে বাঁচা যাবে। তাই উপকারী এই উপাদানটির বিভিন্ন স্বাস্থ্য উপকারিতা যেমন: পুরুষের জন্য মেথির উপকারিতা, মেথি খাওয়ার নিয়ম, মেথির উপকারিতাসহ বিস্তারিত তথ্য নিয়ে আজকের আলোচনা।
মেথি কি?
মেথি (Fenugreek) একটি মৌসুমী গাছ। মেথির বৈজ্ঞানিক নাম Trigonella foenumgraecum। মেথি গাছে মাত্র একবার ফুল ও ফল হয়। ফুলে তিনটি করে পাপড়ি থাকে এবং তিনটি করে পাতা গাছে একসাথে জন্মায়। এই গাছ সাধারণত সাদা ও হলুদ রঙের হয়ে থাকে। মেথি একটি বর্ষজীবী গাছ। মেথির পুরুষ ও স্ত্রী ফুল দুই ধরনের হয়ে থাকে।
মেথির পুষ্টিগুণ
প্রতি ১০০ গ্রাম মেথিতে যা যা থাকে তা নিচে তুলে ধরা হলো:
- ফাইবার – ২৪.৬ গ্রাম
- প্রোটিন – ২৩.০০ গ্রাম
- কার্বোহাইড্রেট – ৫৭.৩৫ গ্রাম
- চর্বি – ১ গ্রাম
- পানি – ৮.৮৪ গ্রাম
- লিপিড – ৬.৪১ গ্রাম
- আয়রন – ৩৩.৫৩ গ্রাম
- ম্যাগনেসিয়াম – দৈনিক যতটুকু প্রয়োজন ৫%
- ম্যাঙ্গানিজ – দৈনিক যতটুকু প্রয়োজন ৭%
মেথি খাওয়ার নিয়ম
মেথির উপকারিতা পেতে আমরা সবচেয়ে বেশি মেথি খেয়ে থাকি মসলা হিসেবে। রান্নায় ব্যবহার করার আগে তিন থেকে চার ঘন্টা ভিজিয়ে রাখতে হবে। এতে করে মেথির সঠিক উপাদান ও পুষ্টিগণ পাওয়া যাবে। আবার যে কোন রান্নাতেই যেমন রুটি, পরোটা, সালাদ ও মাছ ভাজাতে দুটি মেথি পাতা দিলেও খাবারের স্বাদ বাড়বে।
অন্যভাবে, এক গ্লাস গরম পানিতে মেথি ভিজিয়ে রেখে ১০ মিনিট থেথিয়ে/ বেটে নিন। এবার মধু ও লেবুর রস মিশিয়ে তরল পানীয়টি পান করতে পারবেন। এতে শরীরের বিভিন্ন প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান পাবেন।
মেথির উপকারিতা
মেথি আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য অনেক উপকারী। যেহেতু মেথি একটি ভেষজ উপাদান তাই মেথির কোন পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া নেই। মেথির উপকারি দিকগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরা হলো:
১. ডায়বেটিসে নিয়ন্ত্রণে মেথি
মেথি আমাদের শরীরের হজম শক্তি বৃদ্ধি করে। মেথিতে বিভিন্ন রকমের উপাদান ও প্রচুর পরিমাণে ফাইবার থাকে যা রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা কমাতে সাহায্য করে। শরীরের কার্বোহাইড্রেট ও সুগার শোষণ করে নেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে। এজন্য মেথি খাওয়ার ফলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ থাকে।
২. চুলে স্বাস্থ্যরক্ষায় মেথি
চুলের গোড়া মজবুত করতে, চুলের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি করতে, চুল পড়া কমাতে, খুশকি দূর করতে ও চুল কালো রাখতে মেথি অনেক উপকারী। মেথিতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এ, ভিটামিন সি, ভিটামিন ই ও মেলানিন থাকে যা চুলের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
৩. যৌন সমস্যা দূর করতে মেথির উপকারিতা
মেথি পুরুষদের টেস্টোস্টেরন হরমোনের পরিমান বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। মেথির রসে ‘সাপোনিস’ বা ‘ডাইওসজেনিন’ নামে এক ধরনের পদার্থ থাকে যা মানব দেহের হরমোন স্তর বা এর পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। পুরুষদের পাশাপাশি নারীরাও এই যৌন সমস্যায় ভোগে থাকেন তাই উভয়েরই উচিত মেথির ব্যবহার করা।
৪. মেথি ক্যান্সার দূরে রাখে
রক্তে টক্সিক উপাদানের মাত্রা বাড়তে থাকলে শরীরের ভেতরে ক্যান্সার সেলের জন্ম নেওয়ার শংকা থাকে। মেথি রক্তে ভেসে থাকা টক্সিক উপাদান গুলোকে বের করে দেয়। এতে ক্যান্সার হওয়ার আশঙ্কা কমে। ব্রেস্ট ক্যান্সার সৃষ্টিকারী কোষগুলোকে উদ্দীপিত করে এক সময় পুরোপুরি নষ্ট করে ফেলে মেথিতে থাকা ট্রাইগ্লিসেরাইড।
৫. বাতের ব্যথা কমায়
৪০ বছরের উপরে যাদের বয়স তাদের বেশিরভাগই বাতের সমস্যা রয়েছে। মেথি এই তীব্র ব্যথা বেদনা দূর করতে কার্যকরী ভূমিকা রাখে।
৬. কিডনির কার্যক্ষমতা বৃদ্ধিতে মেথির উপকারিতা
মেথি দিয়ে তৈরি চা বা রস পান করলে কিডনি পরিষ্কার থাকে ও মূত্রথলি সুস্থ থাকে। ‘Phytotherapy research’ এর তথ্য অনুযায়ী ক্যালসিয়াম অক্সালেট এর মত কিডনির পাথর প্রতিরোধ করতে মেথিই যথেষ্ট।
৭. কোলেস্টেরল কমায়
কোলেস্টেরলের পরিমাণ বেড়ে গেলে মেথি হার্টের আর্টারি ব্লক করে স্ট্রোক বন্ধ করে দিতে পারে। মেথি খাওয়ার ফলে শরীরে স্টেরিওডাল সাপোনিনস নামক উপাদান তৈরী হয়ে শরীরে কোলেস্টেরলের মাত্রা কমাতে সাহায্য করে। এছাড়াও মেথিতে রয়েছে “Glektomenan” নামে আরেকটি উপকারী উপাদান যা যন্ত্রের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
৮. মাতৃদুগ্ধের উৎপাদন বাড়ায়
মেথিতে ভিটামিন ও মিনারেল থাকায় মাতৃদুধের পুষ্টিগুণ বেড়ে যায়। মেথিতে রয়েছে ডায়সজেনিন নামে এক ধরনের পদার্থ যা মাতৃদুগ্ধের উৎপাদন বাড়ায়। তবে গর্ভাবস্থায় ও বাচ্চাকে দুগ্ধ পান করানোর সময় মেথি খাওয়ার আগে অবশ্যই ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করে নিতে হবে।
৯. ওজন কমাতে মেথির উপকারিতা
মেথিতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার যা আমাদের শরীরে খিদে লাগতে দেয় না। এতে স্বাভাবিকভাবে খাওয়ার পরিমাণ কমে যায় ও শরীরের ওজন কমতে থাকে।
আরও পড়ুন: চিয়া সিড এর উপকারিতা ও অপকারিতা
১০. শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখে
শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখতে মেথি সহায়ক ভূমিকা পালন করে। আমাদের শরীরে সোডিয়াম পটাশিয়ামের মত কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপাদান রয়েছে যেগুলো একটা নির্দিষ্ট মাত্র থাকা প্রয়োজন কিন্তু বয়সের সাথে সাথে এগুলোর মাত্রা ও বদলে যেতে পারে। তবে মেথি ব্যবহারের ফলে এগুলো নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
১১. উজ্জ্বল ত্বকের জন্য মেথির ব্যবহার
ত্বকের কালচে ভাব,চোখের নিচে কালো দাগ ও ব্রণের দাগ ইত্যাদি থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য মেথি খুবই কার্যকরি একটি উপাদান। মেথিতে এন্টি ব্যাকটেরিয়াল পদার্থ থাকে,যা ত্বকের গভীর স্তর পর্যন্ত পৌঁছায়। মেথি দীর্ঘদিন ব্যবহারের ফলে এগুলো থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
এছাড়াও আরো নানাভাবে মানবদেহের জন্য মেথির উপকারিতা বহন করে।
মেথির অপকারিতা | মেথির ক্ষতিকর দিক
মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে প্রতিটি ভেষজ উপাদানই ক্ষতিকর হতে পারে। মেথি বেশি পরিমানে খেলে রক্তে শর্করার পরিমাণ কমে যায়। ডায়রিয়া, গ্যাস ও এলার্জির সমস্যা দেখা দিতে পারে। এছাড়া মেথির অন্যান্য ক্ষতিকর দিকগুলো হলো:
- গর্ভবতী মায়েরা বেশিদিন এটি খেলে সময়ের আগেই শিশু ভূমিষ্ঠ হতে পারে, এমনকি গর্ভপাতও হতে পারে।
- মেথি ব্যবহারে রক্তে চিনির পরিমাণ হঠাৎ কমে যেতে পারে যা ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য বিপজ্জনক।
- মেথি মুখের ভিতরে তিতা স্বাদের প্রদাহ তৈরি করে, যার ফলে অনেকের মাথা ঘুরানো ও বমি বমি ভাবের সমস্যা দেখা দিতে পারে।
- মেথি রক্তে জমাট বাধা প্রতিরোধ করে। তাই যাদের রক্ত পাতলা তাদের চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী এটি ব্যবহার করা উচিত।
মেথি সম্পর্কে প্রয়োজনীয় পশ্নের উত্তর Faq’s
মেথি উপকারিতা কি কি?
রান্নার স্বাদ বাড়ানোর পাশাপাশি স্বাস্থ্যের জন্য ও উপকারী মেথি। চুলের বৃদ্ধি থেকে শুরু করে বদহজম জটিলতা, অতিরিক্ত ওজন নিয়ন্ত্রণ ও ডায়বেটিস রোগীদের ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে মেথি সহায়ক ভূমিকা পালন করে। বেশি মাত্রায় মেথি খাওয়া রক্তের শর্করার মাত্রা হ্রাস করে।
মেথির ক্ষতিকর দিক কি?
মেথি মুখের ভেতরে তিতা স্বাদের প্রদাহ তৈরি করে। যার ফলে অনেকেরই বমি বমি ভাব বা মাথা ঘোরার মত সমস্যা দেখা দিতে পারে। মেথির ব্যবহারে রক্তে চিনির পরিমাণ হঠাৎ কমে যেতে পারে যা ডায়বেটিস রোগীদের বিপদজ্জনক। গর্ভবতী মহিলারা বেশিদিন মেথি খেলে সময়ের আগেই বাচ্চার জন্ম হতে পারে।
খালি পেটে মেথি জল খেলে কি হয়?
মথির মধ্যে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে, যা হজম ক্ষমতা বাড়ায়। সকালে খালি পেটে মেথি ভিজানো পানি খেলে কোষ্টকাঠিন্যে সমস্যা ও দূর হয়। ডায়েবিটিস নিয়ন্ত্রনে সাহায্য করে মেথি ভেজানো পানি। কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ করতেও মেথির উপকারী প্রমাণিত।
শেষকথা
মেথি (Fenugreek) অতিরিক্ত সেবন করা ক্ষতিকর। তাই সঠিক উপায়ে মেথি খান। পুষ্টিবিদদের মতে একদিনে এক থেকে দেড় চা চামচের বেশি মেথির বীজ খাওয়া উচিত নয়। তাই মেথির উপকারিতা সঠিকভাবে পেতে সেবনের পূর্বে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া প্রয়োজন।