মধু (Honey) অনেক বেশি পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ একটি খাদ্য উপাদান। বহুকাল ধরে আমাদের খাবারে ব্যবহারের পাশাপাশি মধু ঔষুধের বিকল্প হিসেবেও ব্যবহৃত হয়ে আসছে। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) – মধু খেতে পছন্দ করতেন। অনন্য এই মধুর উপকারিতা, খাওয়ার নিয়ম এবং পুষ্টিগুন সম্পর্কে জেনে নিন এখানে।
গুনাগুনের দিক বিবেচনা করে আমাদের খাদ্যের তালিকা করলে সেই তালিকায় প্রথম সারিতে থাকবে মধু। প্রাচীনকাল থেকে বিভিন্নভাবে সব দেশের সব স্তরের মানুষ মধুকে পুষ্টিকর ও শক্তিবর্ধক হিসেবে গ্রহণ করে আসছে। এটি আয়ুর্বেদ ও ইউনানী চিকিৎসা শাস্ত্রে মহা ঔষুধ হিসেবে বিবেচিত।
মৌমাছি ও অন্যান্য পতঙ্গ ফুলের নির্যাস হতে মধু তৈরি করে মৌচাকে সংরক্ষণ করে। এটি ঘন তরল মিষ্টি পদার্থ। আমাদের স্বাস্থ্য সম্পর্কে মধুর উপকারিতা ও খাওয়ার সঠিক নিয়ম নিচে তুলে ধরা হলোঃ
মধুর পুষ্টি উপাদান ও পরিমাণ
প্রকৃতিতে বিদ্যমান বিভিন্ন ফুল থেকে মৌমাছিরা মধু সংগ্রহ করে থাকে। এটি পুষ্টিগুনে সমৃদ্ধ এতে প্রায় ৪৫ টি উপাদান রয়েছে। ১০০ গ্রাম মধুতে যা থাকে নিম্নে তার কয়েকটি উপাদান ও পরিমাণ সম্পর্কে লেখা হলো:
- ক্যালোরি – ২৮৮ মিলিগ্রাম।
- গ্লুকোজ – ২৫-৩৭ শতাংশ।
- মল্টোজ – ৫-১২ শতাংশ।
- খনিজ লবন – ২৮ শতাংশ।
- এমাইনো এসিড – ২২ শতাংশ।
- প্রাকৃতিক এনজাইম – ১১ শতাংশ ।
- ফ্রুকটোজ – ৩৪-৪৩ শতাংশ।
- সুক্রোজ – ০.৫-৩.০ শতাংশ।
এতে আরো রয়েছে ভিটামিন বি১,ভিটামিন বি২, ভিটামিন বি৩, ভিটামিন বি৫, ভিটামিন বি৬, আয়োডিন, কপার,জিংক, ক্যালসিয়াম,এন্টি ব্যাকটেরিয়াল উপাদান সহ এটি আরো অন্যান্য উপাদানে ভরপুর। এটি চর্বি ও প্রোটিন মুক্ত। এতে যে উপাদান গুলো বিদ্যমান সেগুলো আমাদের শরীরে তৎক্ষণাৎ শক্তি যোগায়।
মধু খাওয়ার উপকারিতা ও অপকারিতা
মধুর গুনাগুন ও মধু খাওয়ার উপকারিতা ও অপকারিতা সম্পর্কে আমাদের সবারই কম বেশি ধারণা আছে। মধু আমাদের ছোট বড় সকলের স্বাস্থ্যের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান। এটি আমাদের রোগ প্রতিরোধ করতে সহায়তা করে এবং আমাদের রোগের প্রতিষেধক হিসেবে ও এটি কাজ করে। এর গুনাগুন অপরিসিম। মধু খাওয়ার উপকারিতা ও এর গুনাগুন সম্পর্কের নিচে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো :-
১. ওজন কমাতে
মধুতে যে শর্করা থাকে তা সহজেই হজম হয়। এতে কোন চর্বি নেই। এটি আমাদের পেট পরিষ্কার করে থাকে। এটি খাওয়ার ফলে আমাদের শরীরের চর্বি কমবে ও ওজন কমবে।
২. বুদ্ধি বাড়ে
প্রতিদিন রাতে ঘুমানোর আগে মধু খেলে আপনার বুদ্ধি ও মেধা বিকাশ বাড়তে সাহায্য করবে। এটি খেলে মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি পায় যার ফলে আপনার বুদ্ধি বাড়ে।
৩. রক্ত পরিষ্কার করে
নিয়মিত মধু খাওয়ার ফলে এটি আমাদের রক্ত ও রক্তনালী গুলোকেও পরিষ্কার করে। দৈনিক এক গ্লাস গরম পানির সাথে এক বা দুই চা চামচ মধু ও এক চা চামচ ও লেবুর রস মিশিয়ে পান করুন। এভাবে গ্রহণের ফলে আপনি উপকৃত হবেন।
৪. হার্টের সুস্থতায়
হার্টের সুস্থতার জন্য মধুর উপকারিতা রয়েছে অনেক। এক চামচ মৌরি গুড়া করে এক বা দুই চামচ মধু মিশিয়ে একটি মিশ্রণ তৈরি করে এটি পান করুন। এটি হৃদরোগের টনিক হিসেবে কাজ করে। এভাবে গ্রহণের ফলে এটি আপনার হৃদপেশিকে সবল করে ও এর কার্যক্ষমতা কে বৃদ্ধি করে।
৫. হাঁপানি প্রতিরোধে
হাঁপানি রোগীদের জন্য এটি একটি মহা ঔষধ হিসেবে কাজ করে। গোলমরিচের গুড়ো ১/২ গ্রামের সমপরিমাণ মধু ও আদা মিশিয়ে একটি মিশ্রণ তৈরি করুন। এই মিশ্রণটির দৈনিক তিনবার সেবন করুন। এটি গ্রহণের ফলে আপনার হাঁপানি রোগ প্রতিরোধ হবে।
৬. কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে
ভিটামিন বি কমপ্লেক্স এর একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস হচ্ছে মধু। মধু গ্রহণের ফলে আমাদের কোষ্ঠকাঠিন্য, অমলত্ত ও ডায়রিয়া দূর হয়। সকালে খালি পেটে এক চা চামচ মধু গ্রহণ করুন এতে আপনার এই সমস্যাগুলো দূর হয়ে যাবে।
৭. রক্তশূন্যতা পূরণ করতে
মধুর রক্তের হিমোগ্লোবিন তৈরি করতে সহায়তা করে। কারণ মধুতে রয়েছে কপার, লৌহ ও ম্যাঙ্গানিজ যা আমাদের রক্ত তৈরি করতে সাহায্য করে।
৮. যৌন দুর্বলতা দূর করতে
যৌন ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে মধুর উপকারিতা সম্পর্কে সকলেই অবগত। পুরুষদের মধ্যে যাদের যৌন দুর্বলতা রয়েছে, তারা প্রতিদিন মধু ও ছোলা মিশিয়ে গ্রহণ করুন। তাহলে আপনারা অনেক বেশি উপকৃত হবেন। সে ক্ষেত্রে পুরুষ ও নারী উভয়ই এভাবে গ্রহণ করলে তাদের যৌন ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে।
৯. হজম শক্তি বৃদ্ধিতে
মধু পেট রোগা মানুষের জন্য অনেক উপকারী। কারণ এতে যে শর্করা রয়েছে তা হজমে সহায়তা করে। আর এতে রয়েছে ডেক্সট্রিন তা সরাসরি রক্তে প্রবেশ করে তাৎক্ষণিকভাবে কাজ করা শুরু করে। যার ফলে এটা সহজে হজম হয়ে যায় এবং এতে উপকৃত হওয়া যায়।
১০. রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে
মধু খাওয়ার ফলে আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি হয়। মধুতে ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধকারী এক ধরনের উপাদান রয়েছে। যেগুলো আমাদের শরীরের বিভিন্ন অনাকাঙ্ক্ষিত সংক্রমণ থেকে রক্ষা করে। যার ফলে আমাদের শরীরের বিভিন্ন রোগকে প্রতিরোধ করতে সক্ষম হয়।
আরও পড়ুন: বাসর রাতের আমল – দোয়া ও বিশেষ নামাজ।
১১. ত্বকের যত্নে মধুর ব্যবহার
মধুতে রয়েছে প্রোবায়োটিক আন্টি এন্টিঅক্সিডেন্ট, অ্যান্টিসেপটিক, পুষ্টি উপাদান এবং প্রাকৃতিক নির্যাস। এইসব উপাদান গুলো আমাদের ত্বককে মসৃণ, টানটান এবং ত্বকের সৌন্দর্য ধরে রাখতে অনেক কার্যকরি। যাদের মুখে ব্রণ আছে তাদের ব্রণ দূর করতে মধুর উপকারিতা রয়েছে। এটি মুখের অস্থিরতা এবং জ্বালা ভাব দূর করতেও সক্ষম।
১২. চুলের যত্নে
মধু চুলের ন্যাচারাল ময়শ্চারাইজার হিসেবে কাজ করে। চুল শুষ্ক হয়ে যাওয়া এবং চুলের অন্যান্য সমস্যায় এটাকে ব্যবহার করা যাবে। এতে এমন কিছু উপাদান রয়েছে যে এটি ব্যবহারের ফলে চুলের রঙ ধীরে ধীরে হাইলাইট করতে সাহায্য করে।
এছাড়াও নিয়মিত পরিমান মত মধু সেবনের ফলে আমরা বিভিন্নভাবে উপকৃত হই। এটি আমাদের বিভিন্ন রোগের ওষুধ হিসেবে অনেক কাজ করে এবং আমরা অনেক উপকৃত এর মাধ্যমে।
মধুর অপকারিতা
সাধারণত মধুর উপকারিতাই বেশি। এর তেমন কোন অপকারিতা বা পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া নেই। তবে আমাদের সবারই উচিত এটি পরিমাণ মতো গ্রহণ করা। অধিক মাত্রায় বা পরিমানের চেয়ে বেশি সেবন করলে শরীরে অস্থিরতা বা জ্বালাভাব লাগতে পারে। এছাড়াও যাদের এলার্জি রয়েছে তারা বেশি গ্রহণ না করাই ভালো।
মধু খাওয়ার সঠিক নিয়ম
পরিমাণ মতো ও সঠিকভাবে মধু খেলে আপনি যেমন উপকৃত হবেন তেমনি পরিমানের বেশি বা অধিক মাত্রায় গ্রহণ করলে দেখা দিতে পারে নানা সমস্যা। মধু খাওয়ার সঠিক নিয়ম নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো :-
(১) মধু কখনো গরম অথবা রান্না করে খাবেন না।
(২) সংগ্রহ করা নতুন মধু থেকে পুরাতন মধু বেশি কার্যকর।
(৩) গরম পানি ও গরম দুধের সাথে মধু মিশিয়ে খাবেন না।
(৪) খালি পেটে মধু খাওয়া হচ্ছে সবচেয়ে ভালো সময়।
(৫) মধুর সাথে লেবুর রস মিশিয়ে খেলে এসিডিটির সমস্যা কমে।
(৬) লেবুর রস ও মধু মিশিয়ে খেলে মধুর উপকারিতা বৃদ্ধি পায়। এতে ওজন কমে এবং লিভার পরিষ্কার থাকে।
(৭) হজমের সমস্যা দূর করতে যেকোনো ভারী খাবারের আগে এক চামচ মধু খেয়ে নিন।
(৮) দারুচিনির গুঁড়ো ও মধু মিশিয়ে নিয়মিত খেলে রক্তনালীর সমস্যা দূর করে এবং হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি কমে।
(৯) এক চা চামচ আদার রস ও সমপরিমাণ মধু মিশিয়ে সকাল ও সন্ধ্যায় খেলে সর্দির সমস্যা দূর হয়ে যায়।
(১০) যৌন দুর্বলতা দূর করতে প্রতিদিন ছোলার সঙ্গে মধু মিশিয়ে সেবন করুন।
(১১) গুড়ের রসের সঙ্গে মধু মিশিয়ে খেলে বমি বন্ধ হয়ে যায়।
(১২) তুলসি পাতার রস এক চা চামচ ও সমপরিমাণ মধু মিশিয়ে খেলে সহজেই কাশি দূর হয়ে যায়।
(১৩) আম গাছের কচি চামড়া বাটা ও কচি বেলের সঙ্গে গুড় ও মধু মিশিয়ে খেলে আমাশয় ভাল হয়ে যায়।
শেষকথা
শরীরের প্রতিটি অঙ্গের জন্যই মধুর উপকারিতা অনেক। এটি একইসাথে স্বাস্থ্যকর এবং মুখরোচক খাবার। আপনার প্রিয় খাবার হিসেবে প্রতিদিন পরিমান মতো মধু খেতে পারেন। এতে শারীরিক সুস্থতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে অনেক।