সাগরের মরূদ্যান- ওয়েসিস অফ দ্য সিস | বিশ্বের সবচেয়ে বড় জাহাজ

‘ওয়েসিস অফ দ্য সিস (Oasis of the Seas) এর অর্থ হলো ‘সাগরের মরূদ্যান’। ২০০৯ সালের বিশ্বের সবচেয়ে বড় ও বিলাসবহুল জাহাজ হিসেবে পরিচিত পেয়েছিলো। দৈত্যাকার এই জাহাজের সকল অবাক করা তথ্যগুলো জেনে নিন এই লেখা থেকে।

বলা হয় এটি ‘টাইটানিক’ এর চেয়ে ৫ গুণ বড়। এছাড়াও টাইটেনিকের পরে এতোদিন পৃথিবীতে সর্ববৃহৎ জাহাজ হিসেবে খ্যাত ছিলো ইনডিপেন্ডেন্স/ ফ্রিডম অফ দ্য সিস। সেই জাহাজটির তুলনায়ও ওয়েসিস অফ দ্য সিস ৭৫ ফুট বেশি লম্বা। এটি ৪ টা ফুটবল মাঠের চেয়েও বড়। বিশাল এই জাহাজের ইতিহাস, নামকরণ, নির্মাণ, সুবিধাসমূহ ও বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে জানতে পারবেন এখানে।

ওয়েসিস অফ দ্য সিস এর নামকরণ

জাহাজের নির্মাণ কাজ শুরুর আগে রয়্যাল ক্যারিবিয়ান ‘নেম দ্যাট শিপ’ নামের এক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছিল। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন জায়গা থেকে প্রায় ৯১ হাজার নাম সংগৃহীত হয়। বিপুল সংখ্যক নাম থেকে বেছে অবশেষে মিশিগানের ‘জর্জ ওয়েজার’ এর পাঠানো ‘ওয়েসিস অফ দ্যা সিস’ নামটি জাহাজের জন্য নির্বাচন করা হয়েছে।

ওয়েসিস অফ দ্য সিস নির্মাণ সংক্রান্ত তথ্য

২০০৬ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে “ওয়েসিস অফ দ্য সিস” নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। ফিনল্যান্ডে ২০০৭ সালের ১২ নভেম্বর এর নির্মাণ কাজ শুরু হয়। রয়্যাল ক্যারিবিয়ান ইন্টারন্যাশনালের মালিকানায় ‘এসটিএক্স ইউরোপ’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান এ জাহাজটি নির্মাণ করে।

প্রায় সাড়ে তিন বছর লেগেছিলো জাহাজটির নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করতে। সর্বশেষ ২০০৯ সালের ১ নভেম্বর জাহাজটির নির্মাণ কাজ পুরোপুরি সম্পন্ন হয় এবং রয়্যাল ক্যারিবিয়ানের কাছে ক্রুজ শিপটি হস্তান্তরিত হয়। এটি তৈরি করতে প্রায় দেড়শো মিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছিল।

গঠন ও ধারণক্ষমতা

ওয়েসিস অফ দ্য সিস জাহাজটির দৈর্ঘ্য ১১৮৭ ফুট ও প্রস্থ ২০৮ ফুট। এছাড়াও পানির নীচে প্রায় ৩০ ফুট পর্যন্ত জাহাজটির কাঠামো রয়েছে। এর ওজন ২ লক্ষ ২৫ হাজার ২৮২ গ্রস টন। ২০ তলা বিশিষ্ট বিলাসবহুল এই জাহাজটিতে রয়েছে ১৬টি ডেক এবং ২,৭০০ টি বিলাসবহুল রুম। জাহাজটি একসাথে ৬,৩০০ যাত্রী ধারণ করতে পারে। সেই সাথে জাহাজটিতে অবস্থান করে ২,১০০ ক্রু।

ওয়েসিস অফ দ্য সিস এর বৈশিষ্ট

জাহাজের বৈশিষ্টগুলোকে সর্বমোট ৭টি ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। যেমন – সেন্ট্রাল পার্ক, পুল, ফিটনেস সেন্টার, বিনোদন কেন্দ্র প্রভৃতি। বিশ্বের প্রথম ভাসমান উদ্যানটি এই জাহাজেই অবস্থিত। এখানে ১২ হাজার গাছের চারা এবং ৫৬টি গাছ রয়েছে।

২০ তলাবিশিষ্ট এই জাহাজটি যেকোনো নিচু ব্রিজের নিচ দিয়ে যাবার সময় প্রয়োজনে এর গতিবেগ বাড়িয়ে পানিতে পুরো জাহাজের অবস্থান আরো নিচু করে ফেলতে পারে। ডেনমার্কের দি গ্রেট বেল্ট ব্রিজের উচ্চতা এই জাহাজের চেয়ে মাত্র ১ ফুট বেশি। অথচ খুব সহজেই জাহাজটি তার গতি বাড়িয়ে অতিক্রম করেছে এই সেতুটি।

জাহাজের পেছনের অংশটিতে রয়েছে ৭৫০টি আসন সমৃদ্ধ থিয়েটার এবং যার মধ্যে রয়েছে সুইমিং পুল। তবে জাহাজের এই জায়গাটি দিনে সুইমিং পুল হিসেবে আর রাতে সাগরের একটি থিয়েটার হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

অন্যান্য তথ্য

এছাড়াও জাহাজের প্রায় প্রতিটি অংশেই রয়েছে অসংখ্য বার, পোশাক ও বিভিন্ন দ্রব্যাদির দোকান আর রেস্টুরেন্ট। আরো রয়েছে ভলিবল কোর্ট, বাস্কেটবল কোর্ট, চারটি বিশালাকৃতির সুইমিং পুল। শিশু – কিশোরদের জন্য জাহাজে ইয়থ জোন এবং সেখানে কম্পিউটার গেমিং ও সাইন্স ল্যাবরেটরিসহ নানান আকর্ষণীয় বিষয় রয়েছে। এছাড়াও থিম পার্ক এবং বাচ্চাদের জন্য বিশেষ নার্সারি ও খেলাধূলার স্থান আছে। জাহাজের ভিতর পায়ে হেঁটে বেড়ানোর জন্য রয়েছে সুদৃশ্য বিশাল জায়গা।

আরও পড়ুন: টাইটানিক জাহাজের ইতিহাস

দিন রাত ২৪ ঘন্টা পালা ক্রমে এখানে ক্রুরা নানা কাজ করছে। শুধু জানালার কাচে জমা নোনা জল পরিষ্কার করার জন্য ডজন খানিক ক্রু এবং ১৮টা রোবট কাজ করছে। এছাড়াও ২৪ ঘন্টা ধরে এর লন্ড্রিতে ৩৪ জন ক্রু কাজ করছে। ক্রুরা দিনে প্রায় ২০,০০০ টেবিল ক্লথ, তোয়ালে ধোয়া, ন্যাপকিন, বিছানার চাদর, ইস্ত্রি করা এবং ভাজ করতে হয়। তবে চাদর, টেবিল ক্লথ ও ন্যাপকি্ন ইস্ত্রি করে বিশাল আকারের মেশিন। কিন্তু টেবিল ন্যাপকিন ও তোয়ালে নানা ডিজাইন করে ভাজ করার জন্য এই কাজ হাতেই করতে হয়।

নয় রাতে বিলাসবহুল ইস্টার্ন ক্যারিবিয়ান জাহাজ ভ্রমণের জন্য সর্বনিন্ম ভাড়া হবে ১,২৯৯ ডলার থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ৪,৮২৯ ডলার পর্যন্ত। আর সি ফেসিং স্যুটগুলির ভাড়া ৩২০০ মার্কিন ডলার যা বাংলাদেশী টাকায় প্রায় ২ লক্ষ ৮ হাজার টাকা। জাহাজটিতে রুম বুকিং করতে হবে অন্তত দু’ বছর আগে।

ওয়েসিস অফ দ্য সিস এর যাত্রা

ফিনল্যান্ডে জাহাজটির নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হওয়ার পর ২০০৯ সালের ১৩ই নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার ফোর্ট লডারডেলে এসে পৌঁছায়। এখানে আসার পরে জাহাজে ১২,০০০ টি বিভিন্ন প্রজাতির গাছের চারা রোপন করা হয় এবং আরো কিছু কাজকর্ম সম্পন্ন করা হয়। ৫ই ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার ফোর্ট লডারডেল থেকে জাহাজটি প্রথম যাত্রা শুরু করেছিলো। অনেক ধুমধাম ও আনন্দের সঙ্গে ওয়েসিস অফ দ্য সিস যাত্রা শুরু করেছিল।
জাহাজের অভ্যন্তরীন সুবিধাসমূহ

খাবার – দাবার

৮৭০০ মানুষের খাবার ব্যবস্থার জন্য ২৬টা রান্নাঘরে যাত্রীদের সকালে ঘুম ভাঙ্গার আগে থেকেই রান্নার কাজ চলতে থাকে। এই সবধরণের মালামাল জাহাজের মাতৃভুমি Fort Lauderdale শহরের Port Everglades বন্দর থেকে প্রতি শনিবার প্রায় সকাল ৬টা থেকে জাহাজের ডেকে এসে পৌঁছতে থাকে।

সকাল সাড়ে সাতটা থেকে সেগুলো বাছাই করে ভাঙ্গা প্যাকেট, পচা ইত্যাদি সরিয়ে ফেলে ফর্ক লিফটে করে স্টোরিং হতে থাকে। এখানে চা, কফি, দুধ, মাছ, মাংস, চাউল, ময়দা, বিস্কুট, সব্জী, সস, কেচাপ, মাখন, পনীর, রুটি, নানা ধরনের পানীয় ইত্যাদি রাখা হয়। বিভিন্ন গ্যালিতে বিভিন্ন রকমের খাবার রান্না হয়।

চিকিৎসা সেবায়

ইন্টেন্সিভ কেয়ার ইউনিট সহ ৩ জন ডাক্তার আছে, ইন্টেন্সিভ কেয়ার ইউনিটে এক জন মানুষের যাবতীয় চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে। তবে ক্ষেত্র বিশেষে জাহাজের ডাক্তার এবং ক্যাপটেন পরামর্শ করে জাহাজের দিক পরিবর্তন করে নিকটস্থ বন্দরে ভেড়াবার ক্ষমতা দেয়া আছে, মাঝে মাঝে রোগীকে হেলিকপ্টারে করে স্থানান্তর করার ব্যবস্থাও রয়েছে।

জাহাজে যে ধরনের চিকিৎসা দেয়া হয় তার মধ্যে খাদ্য সংক্রান্ত পেটের অসুখ, পিঠে ব্যাথা, গলায় ইনফ্যাকশন, সাইনোসাইটিসের চিকিৎসাই বেশি।

বৈদ্যুতিক সুবিধা

ভাসমান এই জাহাজ নগরীতে একটি পুরোদস্তুর ইলেকট্রিক কোম্পানি রয়েছে। ইঞ্জিন থেকে আইস কিউব পর্যন্ত সবকিছুর প্রাণই হলো ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র। জাহাজের এই বিদ্যুৎ দিয়ে এক লাখ বাড়ির চাহিদা মেটানো সম্ভব। এর ভিতরে থাকা ইলেকট্রিক তারগুলো আমেরিকার এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত টানা সম্ভব। তাই এখানে বিদ্যুৎ জনিত কোনো সমস্যা পোহাতে হবেনা।

শেষকথা

বর্তমানে ওয়েসিস অফ দ্য সিস পৃথিবীর বৃহত্তম জাহাজের তালিকায় নিজেকে প্রথম স্থানে রাখতে পারেনি। প্রতি দশকেই এর থেকেও আরও বিশাল জাহাজ পৃথিবীর সমুদ্র গুলোতে যাত্রা করে। তবে মানব ইতিহাসের বড় একটি অংশ হয়ে থাকবে এই জাহাজটি।