সিলেট বিভাগের দর্শনীয় স্থান গুলোর মধ্যে আলী আমজদের বাড়ী তথা পৃথিমপাশা নবাব বাড়ি অন্যতম। সারা বাংলাদেশ তথা বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রতিনিয়ত এই জমিদার বাড়িতে পর্যটক আসেন। এই বাড়িতে সারাদেশ তথা পাকিস্থান, ইরাক, ইরান, ভারত সহ বিশ্বের অনেক দেশ থেকে গুনীজন ভ্রমন করেছেন।
কেউ কেউ আসেন এই বাড়ি দেখতে, কেউ নান্দনিক সৌন্দর্যের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে একটি ফ্রেমে বেঁধে রাখতে। কেউবা আসেন নবাব বাড়ীর ইতিহাস ঐতিহ্য সম্পর্কে জানতে। মসজিদের ফুলেল নকশা, ইমামবাড়া, দিঘি মানুষকে আকৃষ্ট করে। ইমামবাড়াই বেশি আকর্ষণীয়। এই বাড়িতে যদি কেউ আসতে চায় তাহলে একসাথে অনেক লোক না আসাই ভালো। কারন পর্যটকদের জন্য অনেক বাঁধা নিষেধ মেনে চলতে হয়।
পৃথিমপাশা নবাব বাড়ির অবস্থান
নবাবী আমলের স্মৃতি বিজড়িত এক ইতিহাস ঐতিহ্য এবং বিট্রিশ আমলের অপূর্ব স্থাপনা সহ নিরিবিলি পরিবেশে এখনও দাড়িয়ে আছে পৃত্থিমপাশা জমিদার বাড়িটি। বাংলার জীবন্ত সাজানো-গোছানো পৃথিমপাশা জমিদার বাড়ির অবস্থান মৌলভীবাজার জেলা সদর থেকে ৪৭ কিলোমিটার পূর্বে কুলাউড়া উপজেলা হতে ১০কিমি দুরে পৃথিমপাশা ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ডে নবাব বাড়ী অবস্থিত। এই জমিদার বাড়ির মতো জীবন্ত জমিদার বাড়ি বাংলাদেশে আর দ্বিতীয়টি নেই।
নবাবদের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
মোগল সম্রাট আকবরের সময়কালে ইরান থেকে ধর্ম প্রচারের জন্য ভারতবর্ষে আসেন সাকি সালামত খান। ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যেই তাঁর ছেলে ইসমাইল খান কুলাউড়া উপজেলার পৃথিমপাশায় আসেন। এখানে আসার পর তারা এলাকায় নানা প্রকার সামাজিক কার্যক্রম শুরু করেণ করেন। এলাকার মানুষের শিক্ষা বিস্তার লাভের জন্য পৃথিমপাশায় আলী আমজদ উচ্চ বিদ্যালয়, নারী শিক্ষার প্রসারে মৌলভীবাজারে ১৯০৫ সালে ‘মৌলভীবাজার আলী আমজাদ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৭৪ সালে সিলেটের কিন ব্রিজের ডান পাশে সুরমা নদীর তীরে ঘড়িঘরটি নির্মাণ করেন আলী আহমদ খান, নাম রাখেন ছেলে আলী আমজাদের নামে। যা এখন সিলেটির ঐতিহাসিক আলী আমজদের ঘড়ি নামে পরিচিত। এটি এখন সিলেট শহরের একটি উল্লেখযোগ্য স্থাপনা।
আলী আমজদের বাড়ীটি দুইভাগে ভিবক্ত। আমজাদ খানের দুই উত্তরাধিকারী হলেন—আলী হায়দার খান ও আলী আজগর খান। তাঁদের আমলেই বাড়িটি দুই ভাগ হয়ে যায়। আলী হায়দার খানের দুই পুত্র আলী ছফদর খান ওরফে রাজা সাহেব ও আলী সারওয়ার খান ওরফে ‘চুন্নু নবাব’। আলী ছফদর খান ভাসানী ন্যাপের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। অন্যজন আলী সারওয়ার খান ১৯৭০ সালের প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে বিজয়ী হন। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ১৯৭৩ সালের উপনির্বাচনে কুলাউড়া আসনের প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
জমিদার বাড়ির স্থাপনা
পুরোনো কয়েকটি স্থাপনার সঙ্গে রয়েছে জমিদারদের নির্মিত শিয়া সম্প্রদায়ের একটি চমৎকার নকশা খচিত ইমামবাড়া, যেখান থেকে শিয়া সম্প্রদায়ের মহরম মাসের যাবতীয় কর্যক্রম পরিচালিত হয়। রয়েছে বিট্রিশ আমলের তৈরি করা চোঁখ জুড়ানো নকশা খচিত একটি মসজিদ, যে মসজিদে শিয়া, সুন্নি উভয় সম্প্রদায়ের লোক জামাতে নামায আদায় করতে পারেন। রয়েছে স্মৃতি স্বরুপ বাঘের খাঁচা এবং আবাসিক ভবন, প্রতিটি স্থাপনাতে নকশা খচিত আভিজাত্যের ছাপ স্পষ্ট। পৃথিমপাশা নবাব বাড়ীর সামনেই রয়েছে তিনদিকে চমৎকার শান বাঁধানো ঘাটসহ কয়েক একর জায়গা নিয়ে বিশাল দীঘি এবং দিঘীর পূর্ব পাড়েই রয়েছে নবাবদের কবরস্থান, যেখানে নাবব বাড়ীর পূর্ব পূরুষদের কবর রয়েছে।
জমিদার বাড়ীর বর্তমান অবস্থা
জমিদারদের ব্যবহার করা অনেক আসবাবপত্র রয়েছে এ বাড়িতে। বাড়ির ভেতর সবকিছু পুরানো আমলের কারুকাজ খচিত হলেও সেগুলো এখনো পরিষ্কার ঝকঝকেই আছে। রক্ষণাবেক্ষণ করার জন্য কয়েকজন লোক রয়েছে। জাতীয় সংসদ সদস্য নবাব আলী আব্বাছ খান, নবাব আলী ওয়াজেদ খান বাবু সহ নবাব আলী আমজাদ খাঁনের উত্তসুরিরাই দেখাশুনা করেন পৃথিমপাশা নবাব বাড়িটি।
কিভাবে যাবেন
বাংলাদেশের যেকোন স্থান হতে ট্রেন, বাস, কিংবা মাইক্রোবাসে মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়ায় এসে কুলাউড়া থেকে সি.এন. জি, কিংবা বাসে করে রবিরবাজার পৌছে পৃথিমপাশা নবাব বাড়ীতে আসা যায়। কুলাউড়া আসার জন্য ভালো মানের এসি বাস এবং ঢাকা, চট্রগ্রাম থেকে আন্তঃনগর ট্রেনও রয়েছে। তবে, বিমান পথে আসতে হলে সিলেট আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর নেমে সেখান থেকে সড়ক পথে সরাসরি কুলাউড়া আসা যায়।
খাওয়া-দাওয়া
কুলাউড়ায় স্থানীয় ভাবে বিশেষ কোনো বিখ্যাত খাদ্য নেই, কেবল ভিরিয়ানি, পোলাও ও সাতকরা (হাতকরা) দিয়ে মাংসের তরকারী ব্যতীত। তবে স্থানীয় অনেক ফলমূল যেমন- আনারস, কমলা, খাসিয়া পান, লেবু , আম, জাম, লিচু, এবং কাঠালের বেশ সুখ্যাতি রয়েছে। হাওড় এলাকার প্রচুর মাছ পাওয়া যায় এবং দেশীয় হাস, মরগী সহ খামার ভিত্তিক হাঁস, মুরগ পালন করা হয়। এখানে খাওয়া-দাওয়ার জন্য স্থানীয় রবিরবাজারে হোটেল ও এবং কুলাউড়া রেস্তোরাঁগুলোতে সুস্বাদু খাবার পাওয়া যায়। খাওয়া দাওয়ার জন্য যেতে পারেনঃ
ফুড কেয়ার রেস্টুরেন্ট, রবিরবাজার | ০১৭২৫-৬৮২৮৩৮ |
ছামী ইয়ামী রেস্তোরাঁ, কুলাউড়া | ০১৭১২-৯৭৮ ৮৬৫ |
ইস্টান রেস্তোরাঁ : কুলাউড়া | ০১৭১৯-২৩০ ২৪১ |
থাকা/রাত্রি যাপন
স্থানীয় রবিরবাজরে থাকা কিংবা রাত্রি যাপনের কোন সু-ব্যবস্থা নাই। কিন্তু কুলাউড়া ও এর আশেপাশে থাকার জন্য সরকারি-বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় স্থানীয় পর্যায়ের বেশ কিছু মানসম্মত আবাসিক হোটেল এবং রেস্ট হাউস রয়েছে, যেখানে ৪০০ থেকে ২০০০ টাকায় বিভিন্ন ধরণের রুম পাওয়া যায়। এসব আবাসিক হোটেল এবং রেস্ট হাউসের মধ্যে রয়েছেঃ
- উপেজলা পরিষদ ডাকবাংলো : কুলাউড়া থানার সম্মুখে;
- ফাল্গুনী রেস্ট হাউজ : মিলি প্লাজা, কুলাউড়া, মৌলভীবাজার;
- বাদশাহী হোটেল, কুলাউড়া-, 01760138391
- খাজা রেস্ট হাউস: শমশেরনগর।
কুলাউড়া উপজেলার অন্যান্য আকর্ষনীয় স্থান
মানুষের চিত্ত বিনোদনের জন্য দোলনচাঁপা ইকোপার্ক, রুকনটিলা ইকোপার্ক, আমানিপুর পার্ক, মুরইছড়া ইকোপার্ক, চা বাগান, পালেরমোড়া, কুলাউড়া জং রেলওয়ে স্টেশন সহ নানা স্থাপনা রয়েছে। তবে পর্যটকদের প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য প্রধান আকর্ষণ হয়ে থাকে। আর কুলাউড়া উপজেলায় রয়েছে প্রকৃতির নানা মেলা- হাকালুকি হাওর, কালো পাহাড়সহ পুরো উপজেলা জুড়ে রয়েছে সৌন্দর্য্যরে নিখুঁত আধিপত্য। এরকম প্রকৃতিসৃষ্ট নয়নাভিরাম দৃশ্যের সব রকম উপমা আছে কুলাউড়ায়। তাই পর্যটকদের নতুন এবং প্রথম আকর্ষণ কুলাউড়ার। চারপাশে হাওরের অথই জলরাশি। জলের ওপর ছলাৎ ছলাৎ ঢেউ যা পর্যটকদের প্রধান আকর্ষণ।
শেষকথা
আপনি যদি ইতিহাস ঐতিহ্য সম্পর্কে জানতে বা দেখতে চান তাহলে অবশ্যই পৃথিমপাশা নবাব বাড়িটি ভ্রমন করতে পারেন।