রাতারগুল জলাবন সিলেট- ভ্রমন টিপস্

রাতারগুল ভ্রমণ গাইড: হযরত শাহ জালালের পূর্ণভূমি সিলেট বিভাগ সূজলা-সুফলা প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যে ভরপুর। সিলেট বিভাগে রয়েছে হাওড় বাওড়, বন, ঝর্ণা, বিল, লেক, পশু পাখির অভয়ারন্য সহ অনেক চোঁখ জুড়োনো দর্শনীয় স্থান। তার মধ্যে রাতারগুল জলাবন একটি।

রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্ট

আমাদের আজকের আলোচনা সিলেটের রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্ট (Ratargul Swamp Forest) নিয়ে যা বাংলাদেশের একমাত্র জলাবন এবং বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য এলাকা। রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্ট ভ্রমন পিপাসুদের অন্যতম পছন্দের এক জায়গার নাম যার সৌন্দর্য উপভোগের জন্য এখানে আসার কোন বিকল্প নাই।

চারদিকে পানি এবং সবুজের সমারোহ দর্শনার্থীদের এক মন জুড়ানো আবেশে জড়িয়ে নেয়। পানিতে অর্ধেক ভাসমান গাছগুলো দেখলে মনে হবে যেন পানির বুক চিরে উঠে এসেছে এর শাখা প্রশাখা। এসব গাছে আবর দেখা মিলে বিভিন্ন প্রজাতির পাখি। সব মিলিয়ে এক মনোমুগ্ধকর দৃশ্য পরিলক্ষিত হয়। নৌকায় বসে আপনি এর সৌন্দর্য উপভোগ করলে তৈরি হয় ভিন্ন এক ভালোলাগার।

রাতারগুল জলাবন পরিচিতি

রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্ট সিলেট
রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্ট

বাংলাদেশের আমাজন বা রাতারগুল জলাবনের আয়তনের দিক দিয়ে ৩,৩২৫.৬১ একর, এর মধ্যে ৫০৪ একর বনকে ১৯৭৩ সালে বন্যপ্রাণীদের আশ্রয়স্থল বা অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এ বন বছরে ৬-৭ মাস পানিতে ডুবে থাকে। রাতারগুল শীতকালে ভিন্ন রুপ ধারণ করে। হাজার হাজার অথিতি পাখির মেলা বসে। পানি চলে যাওয়ার সাথে সাথে জালি ও মুর্তা বেতের বাগান জেগে উঠে।

রাতারগুল বনটিতে উদ্ভিদের ২টি স্তর পরিলক্ষিত হয়। উপরের স্তরটি মূলত বৃক্ষজাতীয় উদ্ভিদ নিয়ে গঠিত। এবং নিচের স্তরটি বিভিন্ন প্রকার জলজ উদ্ভিদে নিয়ে গঠিত। এছাড়াও অরণ্যের ৮০ শতাংশ এলাকাই উদ্ভিদের আচ্ছাদনে আবৃত । বনের পরিবেশ ও স্বাস্থ্য সন্তোষজনক । এখানে সর্বমোট ৭৩ প্রজাতির উদ্ভিদের সন্ধান পাওয়া গেছে ।

এই বন মূলত প্রাকৃতিক বন হলেও পরবর্তিতে বাংলাদেশ বন বিভাগ, বেত, কদম, হিজল, মুর্তাসহ নানা জাতের জলসহিষ্ণু গাছ লাগিয়েছে। এছাড়া জলমগ্ন এই বনে রয়েছে হিজল, করচ আর বরুণ গাছ, আছে পিঠালি, অর্জুন, ছাতিম, গুটিজাম, তার সাথে আছে বটবৃক্ষও। ডিঙি নৌকায় চড়ে বনের ভিতর ঘুরতে ঘুরতে দেখা যায় প্রকৃতির রূপসুধা।

সোয়াম্প বনে প্রবেশ করবেন যেভাবে

এই বনের ভিতরে প্রবেশ করার জন্য তিনটি ঘাট রয়েছে। ক.মটর ঘাট,  খ.মাঝর ঘাট,  গ. শেষের ঘাট।

এই ৩টি ঘাটের মধ্যে মাঝের ঘাটের মাধ্যমে প্রবেশ করাই উত্তম। কারন এ ঘাটের মাধ্যমে সহজ ও তাড়াতাড়ি রাতারগুল বনে প্রবেশ করা যায়। এতে কম সময় লাগে। এ ঘাটের নৌকার মাঝিরা দর্শনার্থীদের নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনা করে সবাইকে লাইফ জ্যাকেট সরবরাহ করে।

যেভাবে রাতারগুল যাবেন

ঢাকা সহ সারাদেশ থেকে সিলেট যাওয়া অত্যান্ত সহজ আপনি বাস, ট্রেন, বাইক কিংবা আকাশ পথে সিলেট আসতে পারেন।

সড়কপথে: ঢাকা ফকিরাপুল, সায়েদাবাদ অথবা গাবতলী বাস টার্মিনাল থেকে সিলেটগামী বাসে যেমন গ্রীন লাইন, এনা, সৌদিয়া, শ্যামলী, হানিফ, এস আলম, ইউনিক, সিলকম, মামুন সহ অনেক এসি, নন এসি বাস চলাচল করে আপনি চাইলে এসব বাসে সিলেট আসতে পারেন। ঢাকা থেকে সিলেটের দূরত্ব প্রায় ২৪০ কি.মি। যেথে সময় লাগতে পারে ৬-৭ ঘন্টা।

ভাড়া: এসি বাসের ভাড়া জনপ্রতি আসন ভেদে ১,৪০০ থেকে ১,৫০০ টাকা। আর নন-এসি ভাড়া জনপ্রতি আসন ভেদে ৬৮০ থেকে ৭০০ টাকা লাগতে পারে। সিলেট কদমতলী নিউ বাস টার্মিনালে এসব বাস এসে থামে।

রেলপথে: ঢাকা থেকে ট্রেনে সিলেট যেতে কমলাপুর অথবা বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশন থেকে পারাবত, উপবন, জয়ন্তিকা, কালনী এক্সপ্রেসে সিলেট আসতে পারেন।

চট্রগ্রাম থেকে: উদয়ন ও পাহাড়িকা ট্রেন সপ্তাহে ৬ দিন চলাচল করে। আপনি চাইলে চট্রগ্রাম থেকে এসব ট্রেনে সিলেট আসতে পারেন।

আকাশপথে: বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স, ইউএস বাংলা, নভোএয়ার ইত্যাদি বিমান ঢাকা -সিলেট রুটে চলাচল করে। আপনি চাইলে এসব বিমানে সিলেট আসতে পারেন।

সিলেট শহর থেকে রাতারগুল যাওয়ার উপায়

সিলেট শহর থেকে প্রায় ২৬ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে গোয়াইঘাট উপজেলার ফতেহপুর ইউনিয়নে অবস্থিত রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্ট। সিলেট শহর থেকে কয়েকটি রাস্তা দিয়ে বনে যাওয়া যায়।

ক. সিলেট আম্বরখানা পয়েন্ট থেকে সিএনজির মাধ্যমে গোয়াইনঘাট যাওয়া যায়। সিএনজি রিজার্ভ নিতে খরচ হবে প্রায় ৫০০-৬০০ টাকা। পরিবার নিয়ে গেলে সিএনজি রিজার্ভ নেওয়াই ভালো তবে ভাড়া পূর্বেই কনফার্ম করে নিবেন। গোয়াইনঘাট পৌছে চৌরঙ্গি ঘাট বা মাঝের ঘাট থেকে নৌকা ভাড়া করে রাতারগুল যেথে হবে। একটি নৌকায় ৪-৫ জন যাওয়া সম্ভব। নৌকা ভাড়া ৮০০ টাকা থেকে ১৫০০ টাকার মত হবে (ভাড়া পরিবর্তনযোগ্য)।

খ. সিলেটের বন্দর বাজার পয়েন্ট থেকে সিএনজি করে সাহেব বাজার হয়ে মটরঘাট পৌছে ছোট নৌকা রিজার্ভ করে রাতারগুল জলাবনে যেতে পারেন।

গ. সিলেট থেকে বিমানবন্দর গামী গাড়িতে গিয়ে সারিঘাট বাজারে নামতে হবে। লোকাল ভাড়া হবে ৪০-৫০ টাকা। সারিঘাট থেকে সি এন জির মাধ্যমে গোয়াইনঘাট বাজারে এসে নৌকা ভাড়া করে রাতারগুল যেতে হবে।

সি এন জি বা নৌকা ভাড়ার ক্ষেত্রে পূর্বে দরদাম করে নেওয়া ভালো।

রাতারগুল ভ্রমন পরিকল্পনা

মাত্র কয়েক ঘন্টার মধ্যে রাতারগুল জলাবন ভ্রমন করতে পারেন। রাতারগুল ভ্রমনের পাশাপাশি আপনি এক দিনে ভোলাগঞ্জের সাদা পাথর ও বিছনাকান্দি দেখে আসতে পারেন। সেক্ষেত্রে ভোরের দিকে আপনাকে রওয়ানা দিতে হবে। যাত্রাপথে শিল্পপতি রাগিব আলীর মালিকানাধীন দেশের প্রাচীন চা বাগান “মানরীছড়া” ঘুরে দেখতে পারেন। এই রোড়ে রয়েছে সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম ও সিলেট আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্ট। এই স্থানগুলোতে যেতে সারাদিনের জন্য সিএনজি রিজার্ভ করতে পারেন সেক্ষেত্রে ১২০০-১৫০০ টাকা ভাড়া গুনতে হবে এবং লেগুনা রিজার্ভ করলে গুনতে হবে ২২০০-২৫০০ টাকা। বাস এবং ইজি বাইকেও যেতে পারেন সেক্ষেত্রে সময় বেশি লাগবে।

রাতারগুল যাওয়ার উপযুক্ত সময় 

বিভিন্ন মৌসুমে রাতারগুল বিভিন্ন ধরনের রুপ ধারণ করে। বর্ষা মৌসুমে রাতারগুলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সবার মাঝে মুগ্ধতা ছড়ায়। বৃষ্টি ও আশপাশের পানি রাতারগুলবনের সর্বত্র এনে দেয় মনজোড়ানো সজীবতার ছোঁয়া। অন্যদিকে শীত মৌসুমে কুয়াশাচ্ছন্ন প্রকৃতিক পরিবেশের মাঝে বসে হাজার হাজার অতিথি পাখির মেলা। পানি শুকিয়ে গিয়ে ছোট ছোট নালায় পরিণত হয়, যা দিয়ে আপনি পায়ে হেঁটেই পুরো বন ঘুরে দেখতে পারেন।

রাতারগুল বর্ষাকালে যাওয়ার উপযুক্ত সময়। বর্ষাকালের (জুলাই থেকে অক্টোবর) রাতারগুল যাওয়া উত্তম। এই সময়ে পানির উচ্চতা সাধারণত খুব বেশি বা কম না থাকায় সহজেই নৌকায় চড়ে চারিদিক ঘুরে দেখা যায়।

আরও পড়ুন জাফলং ভ্রমণের আদ্যোপান্ত

রাতারগুল প্রবেশ ও অন্যান্য ফি সমূহ

প্রবেশ ফি: বয়স্কদের জন্য ৫০ টাকা, ১২ বছরের নিছে এবং শিক্ষার্থীদের জন্য ২৫ টাকা এবং বিদেশী পর্যটকদের জন্য প্রবেশ ফি ৫০০ টাকা।

পার্কিং ফি: মোটরসাইকেল, সি এন জি পার্কিং ফি ২৫ টাকা। প্রাইভেট কার, জিপ, মাইক্রোবাস ১০০ টাকা এবং বাস পার্কিং ফি ২০০ টাকা।

শুটিং ফি: বনে প্রফেশনাল গ্রেড শুটিং করতে প্রতিদিন ১০ হাজার টাকা ফি প্রদান করতে হবে।

গাইড ফি: প্রথমবার রাতারগুল ভ্রমনে গেলে গাইড নেওয়া ভালো। ঘন্টাপ্রতি গাইডকে ১৫০ টাকা ফি প্রদান করতে হবে।

কোথায় থাকবেন

রাতারগুল থাকার জন্য ভালো কোন ব্যবস্থা নাই। তাই ভ্রমন শেষে থাকতে হলে সিলেট শহরে আসতে হবে। সিলেটে ভালো মানের বেশ কিছু হোটেল, রিসোর্ট ও আবাসিক হোটেল রয়েছে।
সিলেট লামা বাজার ও দরগা গেইটে কম ভাড়ায় অনেক মানসম্মত আবাসিক হোটেল ও রেস্ট হাউস রয়েছে। যেখানে ৫০০-১০০০ টাকায় বিভিন্ন ধরণের থাকার রুম পাওয়া যাবে।

কোথায় খাবেন

রাতারগুলে খাবার জন্য ভালো হোটেল না থাকায় সিলেট শহরে খাওয়া-দাওয়া করতে হবে। সিলেট হোটেলগুলোর খাবারের মান অনেক ভালো। যার মধ্যে পানসি, পাঁচভাই, পালকি, উঠান রেস্টরেন্ট, পেসিডিন্ট হোটেল, বেশ জনপ্রিয়। আপনি চাইলে এখান থেকে খাবার পার্সেল করে নিতে পারেন। এসব হোটেলে হরেক রকমের ভর্তার স্বাদ নিতে ভুলবেন না।

সতর্কতা

  • বর্ষায় বন ডুবে যাওয়ায় বিভিন্ন ধরনের সাপ গাছের ডালে আশ্রয় নেয় এই বিষয়ে সতর্ক থাকুন।
  • বনে জোঁকে উপদ্রব আছে, জোঁকের বিষয়ে সতর্ক থাকুন।
  • সাঁতার জানা না থাকলে লাইফ জ্যাকেট সাথে রাখুন।
  • ছাতা ও রেইনকোট সাথে রাখুন।
  • সাথে থাকা মোবাইল,মানি ব্যাগ সাবধানে রাখুন। এসব পানিতে হারিয়ে গেলে নাও পেতে পারেন।
  • বনের পরিবেশ নষ্ট হয় এমন কাজ করা থেকে বিরত থাকুন।

Faq’s

রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্ট কোথায় অবস্থিত?

সিলেট গোয়াইনঘাট উপজেলায় অবস্থিত।

রাতারগুল জলাবন ভ্রমনের উপযুক্ত সময় কখন?

(জুলাই থেকে অক্টোবর) মাসে রাতারগুল যাওয়াই উত্তম।

সিলেট থেকে রাতারগুলোর দূরত্ব কত কি.মি?

সিলেট শহর থেকে রাতারগুলের দূরত্ব প্রায় ২৬ কি.মি.।

রাতারগুল ভ্রমণ গাইডসহ বাংলাদেশের সকল ভ্রমণ টিপস পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিন।