সজনে পাতার উপকারিতা ও ঔষধি গুণাগুন

জিনাসজনে পাতা (Sajne pata) পৃথিবীর সবচেয়ে পুষ্টিকর হার্ব এর মধ্যে একটি। জেনে নিন সজনে পাতার উপকারিতা, পুষ্টি গুনাগুণ ও অপকারিতা সম্পর্কে।

প্রতি গ্রাম সজনে পাতায় একটি কমলার চেয়ে সাত গুণ বেশি ভিটামিন সি, গাজরের চেয়ে চার গুণ বেশি ভিটামিন এ, কলার চেয়ে তিনগুণ বেশি পটাশিয়াম থাকে। এছাড়াও দুধের চেয়ে চার গুণ বেশি ক্যালসিয়াম ও দুই গুণ বেশি প্রোটিন থাকে। ফলে মানবদেহের জন্য এর উপকারিতা রয়েছে অনেক। সজনে পাতার উপকারিতা ও এর সম্পর্কে সকল গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জেনে নিন এই আলোচনায়।

সজনে গাছের পাতা 

সজনের বৈজ্ঞানিক নাম হচ্ছে Moringa oleifera। সজনে গাছের পাতা অলৌকিক পাতা হিসেবেও বেশ পরিচিত। গবেষকরা একে বলে থাকেন, নিউট্রিশনস সুপার ফুড এবং সজনে গাছকে বলা হয় মিরাক্কেল ট্রি। বীজ ও ডালের মাধ্যমে বংশবিস্তার করলেও আমাদের দেশে সাধারণত ডালের মাধ্যমে বংশবিস্তার করানো হয়। 

সজিনার ডাল রোপণের উপযুক্ত সময় হচ্ছে গ্রীষ্মকালে এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি থেকে শেষ পর্যন্ত। সজনের কাচা লম্বা ফল সবজি হিসেবে খাওয়া হয় এবং পাতাকে শাক হিসেবে খাওয়া হয়। এটি গ্রীষ্ম প্রদান ও খরা সহিষ্ণু অঞ্চলের একটি উদ্ভিদ। মানবদেহের জন্য সজনে পাতার উপকারিতা রয়েছে অনেক বেশি।

সজনে পাতার ঔষধি গুণ

সজনে পাতার উপকারীতা
সজিনা পাতা

সজনে গাছের ডাটা, পাতা, বাকল, শিকড় ও সমস্ত গাছ জুড়েই রয়েছে বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান ও ভেষজ গুণাবলী। সজনে পাতার গাছকে মিরাক্কেল ট্রি (Miracle Tree) বলা হয়। অনেক মানুষের পরিপাকতন্ত্রের বিভিন্ন সমস্যা রয়েছে যেমন – কোষ্ঠকাঠিন্য, খাবার সহজে হজম না হওয়া, পেটে গ্যাস জমে থাকা, বুক জ্বালা করা ইত্যাদি সমস্যার সমাধানে সজনে পাতার গুড়া সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

স পাতার গুড়া ব্যবহার করলে রক্তে খারাপ কোলেস্টেরল কমায় এবং ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। সজনে পাতা হার্টের রোগীদের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ।

থাইরয়েড, ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ চলাকালে সজনে পাতা অথবা সজনে পাতার গুড়া খাওয়ার ব্যাপারে চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করে নিতে হবে। কারণ এই সমস্ত রোগের জন্য নির্দেশিত কিছু ওষুধের সাথে সজনে পাতার মিথস্ক্রিয়া হতে পারে। যার ফলে ওষুধের কার্যকারিতা কমে যাওয়া বা অন্য যেকোনো ধরনের শারীরিক সমস্যা হতে পারে। তাই চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সজনে পাতার উপকারিতা পেতে এর গুড়া ব্যবহার করতে পারেন।

সজনে পাতার পুষ্টিগুণ প্রতি ১০০ গ্রাম অনুপাতে

সজনে পাতার মধ্যে বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান রয়েছে যা শরীরের জন্য অত্যাবশ্যকীয় সেজন্য সজনে পাতাকে সুপার ফুড বলা হয়। প্রতি ১০০ গ্রাম সতেজ সজনে পাতা থেকে যে পরিমাণ পুষ্টি পাওয়া যেতে পারে তা নিম্নে উল্লেখ করা হলো:-

পুষ্টি উপাদান সমূহ ও পরিমাণ

  • শক্তি – ৬৪ ক্যালরি।
  • কার্বোহাইড্রেট – ৮.২৮ গ্রাম।
  • প্রোটিন – ৯.৪০ গ্রাম।
  • ফ্যাট – ১.৪০ গ্রাম।
  • পানি – ৭৮.৬৬ গ্রাম।
  • ফাইবার – ২.০ গ্রাম।

মিনারেলস সমূহ ও পরিমাণ

সজনে পাতা মিনারেলসে সমৃদ্ধ। যা মানবদেহে সজনে পাতার উপকারিতা অনেক বেশি বৃদ্ধি করেছে। নিচে এর মিনারেলস গুলো এবং তার পরিমান তুলে ধরা হলো: 

  • আয়রন – ৪ মিলিগ্রাম।
  • সোডিয়াম – ৯ মিলিগ্রাম।
  • জিঙ্ক – ০.৬ মিলিগ্রাম।
  • ম্যাঙ্গানিজ – ০.৩৬ মিলিগ্রাম।
  • ক্যালসিয়াম – ১৮৫ মিলিগ্রাম।
  • পটাশিয়াম – ৩৩৭ মিলিগ্রাম।
  • ফসফরাস – ১১২ মিলিগ্রাম।
  • ম্যাগনেসিয়াম – ১৪৭ মিলিগ্রাম।

ভিটামিন সমূহ ও পরিমান

  • ভিটামিন এ – ৩৭৮ মাইক্রোগ্রাম।
  • ভিটামিন বি১ (থায়ামিন) – ০.২৫৭ মিলিগ্রাম
  • ভিটামিন বি২ (রিবোফ্লেবিন) – ০.৬৬০ মিলিগ্রাম।
  • ভিটামিন বি৩ (নিয়াসিন) – ২.২২০ মিলিগ্রাম।
  • ভিটামিন বি৫ (প্যানটোথেনিক এসিড) – ০.১২৫ মিলিগ্রাম
  • ভিটামিন বি৬ (পাইরিডস্কিন) – ১.২ মিলিগ্রাম।
  • ভিটামিন বি৯ (ফলেট) – ৪০ মাইক্রোগ্রাম।
  • ভিটামিন সি – ৫১.৭ মিলিগ্রাম।

আরও পড়ুন: ড্রাগন ফলের উপকারিতা – Dragon fruit benefits

সজনে পাতার উপকারিতা

সজিনা পাতার উপকারীতা
সজিনা পাতা

সজনে পাতার নানাবিধ উপকারিতা রয়েছে নিম্নে সেগুলো নিয়ে আলোচনা করা হলো :-

১. রক্তে সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ রাখে

ডায়াবেটিসের প্রধান সমস্যা হলো রক্তে অতিরিক্ত মাত্রায় সুগারের উপস্থিতি যার কারনে শরীরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ যেমন – চোখ,হার্ট, কিডনি,স্নায়ুতন্ত্র ইত্যাদি কার্যক্ষমতা এবং যৌন সক্ষমতা কমে যায়। বিভিন্ন গবেষণার মাধ্যমে দেখা গেছে যে সজনে পাতা অথবা গুড়া করে নিয়মিত খাওয়ার ফলে রক্তে সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ থাকে। বিজ্ঞানীরা বলেন isothiocyanates নামক একটি উপাদান রয়েছে যার ফলে এমনটি হয়ে থাকে। ওষুধ সেবন এর পাশাপাশি চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সহায়ক উপাদান হিসেবে সজনে পাতা খাওয়া যেতে পারে।

২. রক্তে কোলেস্টেরল কমায়

রক্তে খারাপ কোলেস্টেরল বা LDL (Low Density lipoprotein) বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে হার্টের রোগ যেমন- উচ্চ রক্তচাপ,হার্ট অ্যাটাক,স্ট্রোক ইত্যাদি ঝুঁকি বাড়তে পারে। অন্যান্য উদ্ভিদ উৎসের মতো সজনে পাতা ও রক্তে খারাপ কোলেস্টেরল কমাতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেন। বিভিন্ন গবেষণা করে দেখা গেছে যে সজনে পাতা খারাপ কোলেস্টেরল কমানোর সক্ষমতা রয়েছে।

৩. রাতকানা রোগ প্রতিরোধ করে

রাতকানা প্রতিরোধে সজনে পাতার উপকারিতা রয়েছে অনেক। প্রতিদিন ১০০ গ্রাম সজনে পাতা খাওয়ার মাধ্যমে যে পরিমাণ ভিটামিন এ পাওয়া যায় তাতে শরীরের অর্ধেক চাহিদা পূরণ হয়ে থাকে। ভিটামিন এ রাতকানা রোগ প্রতিরোধ করা সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ গুলোর (হার্ট, ফুসফুস ও কিডনি) স্বাভাবিক কার্যক্রমের সহায়তা করে থাকে।

৪. শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে

সজনে পাতার মধ্যে Quercetin এবং Chlorogenic acid দুটি বিশেষ উপাদান রয়েছে যা শরীরের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে। অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট,বিটা কেরোটিন এবং প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন সি এর উপস্থিতি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে।

৫. লিভারকে সুস্থ রাখে

লিভার মানুষের শরীরের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। লিভারে শরীরের নানাবিধ রাসায়নিক কার্যক্রম ঘটে থাকে। আমরা প্রতিনিয়ত যে সমস্ত ওষুধ খেয়ে থাকি তার বেশিরভাগই লিভার ও কিডনির উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে থাকে। বিশেষ করে টিভি রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ওষুধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ায় লিভারের কোষ মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে। সজনে পাতা খাওয়ার ফলে লিভারের ক্ষতিগ্রস্ত তা কমানো সম্ভব এবং লিভারকে ভালো রাখতে সহায়তা করে।

৬. খুশকি দূর করে এবং চুল পড়া কমায়

চুলের খুশকি দূর করতে সজনে পাতার উপকারিতা রয়েছে। সজনে পাতা বেটে অথবা ব্লেন্ডারে পিষে ঘন পেস্ট করে মাথায় লাগালে খুশকি সমস্যা দূর হয়ে যায় এবং সেই সাথে চুল পড়া ও কমে যায়। চুলের গোড়া মজবুত হয় এবং চুল পড়া বন্ধ হয়ে যায়।

৭. প্রোটিনের ঘাটতি পূরণ করা

আমাদের দেশের দরিদ্র পরিবার গুলোর ছেলেমেয়েরা প্রোটিনের অভাবে ভোগে যার ফলে তাদের শরীরে যথাযথ বৃদ্ধি হয় না। সজনে পাতার মধ্যে ১৮ ধরনের অ্যামাইনো এসিড রয়েছে যা প্রোটিন গঠনের মূল উপাদান। সেই সাথে সজনে পাতা খুব সহজলভ্য একটি খাবার। প্রোটিনের ঘাটতি পূরণ করার জন্য সজনে পাতা পরিমানমতো খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।

সজনে পাতার ক্ষতিকর দিক 

সজনে পাতার উপকারিতার পাশাপাশি কিছু ক্ষতিকর বা বিরূপ দিকও রয়েছে সেগুলো নিম্নে দেয়া হলো :-

(১) সজনে পাতার গুড়ো তে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিনস মিনারেলস এবং এন্টিঅক্সিডেন্ট থাকে তাই খুব বেশি পরিমাণে সজনে পাতার গুঁড়ো গ্রহন করলে ডায়রিয়া,পেটে গ্যাস ও খিদে কম হতে পারে।

(২) সজনে গাছের পাতা ও ডাটা আমরা খেতে পারি, গাছের পাতা সংলগ্ন ডাল একদমই খাওয়া উচিত না। কারণ ওই ডালে কিছু ক্ষতিকারক পদার্থ থাকে যা আমাদের শরীরের ইমিউনিটি সিস্টেমকে ক্ষতি করতে পারে।

(৩) সজনে পাতাতে কিছু প্লানেট কেমিক্যাল থাকে সেজন্য সজনে পাতা ছোট বাচ্চা এবং গর্ভবতী মায়েদের জন্য না খাওয়াই উচিত।

(৪) ব্লাড প্রেসার কমাতে সজনে পাতার গুড়ো বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। তবে আপনি যদি প্রথম থেকে ব্লাড প্রেসার কমানোর ওষুধ খেয়ে থাকেন সে ক্ষেত্রে সজনে পাতার গুড়ো না খাওয়াই ভালো। কারণ সজনে পাতার গুড়ো খাওয়ার পরে ব্লাড প্রেসার এর লেভেল আরো কমে যাবে যা আপনার শরীরের জন্য খুবই ক্ষতিকর।

সজনে পাতার গুড়ো বা  মরিঙ্গা পাউডার খাওয়ার আগে অবশ্যই ডক্টরের সাথে কথা বলে নিবেন।

শেষকথা

সজনে পাতার (Sajne pata)  উপকারিতা রয়েছে অনেক। এটি রক্তস্বল্পতা, অন্ধত্বসহ বিভিন্ন ভিটামিন ঘাটতি জনিত রোগের বিরুদ্ধে বিশেষ ভাবে কার্যকরী একটি উপাদান। সজনে পাতা সহজলভ্য হওয়ার কারণে সর্বস্তরের মানুষই এটিকে খেতে পারে। তাই সম্ভব হলে নিয়মিত সেবন করুন সজনে পাতা।