হযরত শাহ জালাল (র:) মাজার: সিলেট নামটি শুনলেই মনে হয় ৩৬০ আউলিয়ার কথা। কারণ সিলেটকে বলা হয় ৩৬০ আউলিয়ার দেশ, কেউ কেউ সিলেটকে পূণ্যভূমি হিসাবে অভিধায়নও করেন।
এই সিলেটের মাটিতে শুয়ে আছেন ওলিকুল শিরোমণি সম্রাট হযরত শাহজালাল (র.)। আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় হযরত শাহ জালাল (র:) মাজার ভ্রমন নিয়ে।
হযরত শাহ জালাল (র:) সিলেট আগমনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
পূর্ণ ভূমি সিলেট (পূর্ব নাম শ্রীহট্ট) একসময় গৌড় গোবিন্দের আওতাধীন ছিল। গৌড় গোবিন্দ ছিল সেখানকার রাজা, তার অধীনে সকল প্রকার কুসংস্কার ও যাদু বিদ্যায় আচ্ছাদিত ছিল সিলেট শহর। সেখানে শেখ বুরহান উদ্দিন ছিলেন একমাত্র মুসলমান। গৌড় গোবিন্দ শেখ বুরহান উদ্দিনের উপর সকল প্রকার অত্যাচার নিপিড়ন চালায়। এমনকি ছেলের আকিকা উপলক্ষে গরু জবাই করার অপরাধে রাজা শেখ বুরহান উদ্দিনের হাতের কব্জি পর্যন্ত কেটে দিল এবং শেখ বুরহান উদ্দিনের নিষ্পাপ শিশুকে জবাই করে হত্যা করে।
এমন ঘোর অন্ধকারাচন্ন সিলেটে আলোর মশাল নিয়ে ১৩০৩ খ্রিস্টাব্দে আর্ভিবাব ঘটে হযরত শাহ জালার (র:) ও তার ৩৬০ জন সঙ্গী সাথীর। হযরত শাহজালাল সিলেট আগেমনের সাথে সাথে গৌড় গোবিন্দের সৈন্যরা শাহজালাল (র:) ও তাঁর সঙ্গীদের উপর অগ্নিবাণ ছুঁড়তে থাকে, হযরত শাহজালাল (র:) অলৌকিক ক্ষমতায় তা প্রতিহত করলেন।
এর পর থেকে গৌড় গোবিন্দ হযরত শাহ জালাল (র:) কে প্রতিহত করার জন্য নানা ধরনের কৌশল অবলম্বন করতে থাকে কিন্তু তার সকল কৌশল শাহজালাল (র:) এর কাছে বিফলে যায়। আযানের ধ্বনিতে রাজা গৌড় গোবিন্দের রাজ প্রাসাদ ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে মাটিতে পড়ে যায়, হযরত শাহজালালের এসব কর্মকান্ডে রাজা গৌড় গোবিন্দ ভয় পেয়ে যায় এবং রাজ্য ছেড়ে পালিয়ে যায়। আজ পর্যন্ত গৌড় গোবিন্দের কোন খবর পাওয়া যায় নাই।
এর পর হযরত শাহ জালাল (র:) সিলেটের দরগা মহল্লার একটি ছোট টিলায় আস্তানা করে স্থায়ীভাবে সববাস করতে শুরু করেন এবং ইসলামের দাওয়াতে নিজেকে মশগুল করেন। তার সফর সঙ্গীদের সিলেটের বিভিন্ন অঞ্চলে দাওয়াতি কাজের জন্য পাঠিয়ে দেন। তিনি ছিলেন অবিবাহিত তাই তাঁকে মুজররদ বলা হয়।
১৩৪০ খ্রিস্টাব্দে ৬৯ বছর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেন ইন্তেকালের পর ঐ টিলায় চির নিদ্রায় শায়িত হন। আজ পর্যন্ত প্রতিদিন ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে হাজার হাজার মানুষ হযরত শাহ জালাল (র:) মাজার জিয়ারত করতে আসেন।
আরও পড়ুন: হযরত শাহ পরান (রঃ) এর মাজার
হযরত শাহ জালাল (র:) মাজারে কি কি দেখবেন
গজার মাছের পুকুর:
শাহ জালাল (র:) মাজার চত্বরের উত্তরদিকে রয়েছে একটি বড় পুকুর। এই পুকুরে শোভা বর্ধন করে আছে অসংখ্য গজার মাছ। এসব মাছকে পুকুরে ভেসে বেড়াতে দেখে দর্শনার্থীরা আনন্দ উপভোগ করেন এবং ছোট ছোট মাছ খেতে দেন।
সোনালী মাছের কূপ:
শাহজালাল (র:) এর মাজারের পশ্চিম পাশেই রয়েছে একটি গভীর কূপ। এই কূপে সোনালী ও রুপালী রঙের মাছ দেখা যায়। চারপাশ পাকা এই কূপে দিনরাত পানি প্রবাহিত হয়। মাছ গুলো দেখতে দর্শনার্থীরা ভিড় করেন।
জালালী কবুতর
হযরত শাহজালাল (র:) এর সিলেট আগমনের সময় ভারতের হযরত নিজামুদ্দিন আউলিয়া (র:) তাঁকে সাদরে গ্রহণ করেন। প্রীতির নিদর্শন স্বরূপ তাঁকে এক জোড়া সুরমা রঙের কবুতর বা জালালী কবুতর উপহার দেন। সিলেট ও এর আশ-পাশের অঞ্চলে বর্তমানে যে সুরমা রঙের কবুতর দেখা যায় তা ওই কবুতরের বংশধর এবং জালালী কবুতর নামে খ্যাত। শাহ জালালের মাজার এলাকায় প্রতিদিন হাজার হাজার কবুতর উড়তে দেখা যায়। মাজারে আগত দর্শনার্থীরা এইসব কবুতরের জন্য বাড়ি থেকে ধান ও অন্যান্য খাবার নিয়ে যান।
শাহ জালালের ডেগচি
মাজারের পূর্ব পার্শে একতলা ঘরের ভেতরে বড় ৩টি পিতলের তৈরি ডেকচি রয়েছে। এগুলো ঢাকার মীর মুরাদ হযরত শাহ জালার (র:) কে দান করেছেন। ডেকচিগুলোতে এখন রান্না বান্না হয় না। পূণ্যের উদ্দেশ্যে প্রতিদিন আগত দর্শনার্থীরা ডেকচিগুলোতে প্রচুর টাকা পয়সা দান করেন।
শাহজালালের চিল্লাখানা
মাজারের দক্ষিণদিকে গ্রীলঘেরা তারকা খচিত ছোট্ট ঘরটি শাহজালালের চিল্লাখানা। স্থানটি মাত্র ২ফুট চওড়া। কথিত আছে- হযরত শাহজালাল এই চিল্লাখানায় জীবনের ২৩টি বছর আল্লাহর ইবাদতে কাটিয়েছেন।
হযরত শাহ জালালের ব্যবহৃত জিনিস
মাজারের সংলগ্ন নাজিমুদ্দিন আহমদের বাড়িতে হযরত শাহ জালাল (র:) এর ব্যবহৃত তলোয়ার, খড়ম, প্লেট, বাটি ইত্যাদি সংরক্ষিত আছে, এসব দর্শনার্থীদের জন্য দেখার ব্যবস্থা রয়েছে।
মহিলাদের ইবাদত খানা
হযরত শাহ জালাল (র:) এর মাজারে প্রতিদিন হাজার হাজার মহিলা দর্শনার্থীরা উপস্থিত হন। মহিলাদের জন্য রয়েছে মাজারে প্রবেশ পথের পাশে একটি মহিলা ইবাদত খানা। যেখানে মহিলারা নামায ও অন্যান্য ইবাদত বন্দেগী করতে পারেন।
দরগাহ মসজিদ
১৪০০ খ্রিস্টাব্দে দরগাহ চত্বরে একটি মসজিদ নির্মাণ করা হয়। মাজারে আগত মুসল্লিরা মসজিদে নামায আদায় করে থাকেন। বর্তমানে এই মসজিদটি সিলেট শহরের অন্যতম মসজিদ।
কোথায় খাওয়া-দাওয়া করবেন
হযরত শাহ জালার (র.) এর মাজার ভ্রমনে গেলে আপনাকে খাবার খেতে হবে, খাওয়ার জন্য সিলেটের জিন্দাবাজারে বেশ ভালো কয়েকটি খাওয়ার হোটেল আছে। হোটেল গুলো হচ্ছে পাঁচ ভাই, পানশি, উঠান রেস্টুরেন্ট, স্পাইসি, ভোজনবাড়ী ও পালকি। এছাড়া রয়েছে-
উনদাল রেস্টুরেন্ট, পূর্ব জিন্দাবাজার, সিলেট, ফোন: ০৮২১-২৮৩২১৯৭.
এক্সোটিকা রেস্টুরেন্ট, হোটেল সুপ্রীম, জাফলং রোড, মিরাবাজার, মোবাইল-০১৭১১১৯৭০১২,
আলপাইন রেস্টুরেন্ট, চৌহাট্টা, সিলেট।
কিভাবে মাজারে যাবেন
দেশের যে কোন স্থান হতে প্রথমে আপনাকে সিলেট শহরে আসতে হবে। তারপর সিলেট রেলওয়ে স্টেশন অথবা সিলেট কদমতলী নিউ বাস স্ট্যান্ড হতে সিএনজি, অটোরিকশা বা রিকশা দিয়ে সহজেই মাজারে যাওয়া যায়। রিকশায় গেলে সাধারণত ভাড়া লাগে ২০-২৫ টাকা আর সিএনজিতে গেলে ৮০-১০০ টাকা ভাড়া লাগবে। পূর্বে গাড়ী ভাড়া দরদাম করে নেওয়া ভালো।
কোথায় থাকবেন
সিলেট শহরে থাকার জন্য রয়েছে অনেক উন্নত ব্যবস্থা রয়েছে যার মধ্যে আবাসিক হোটেলগুলো হলো:
ক. হোটেল নির্ভানা ইন, সিলেট: +৮৮০৮২১২৮৩৩৪০৪,
খ. হোটেল মেট্রো ইন্টারন্যাশনাল (বন্দর, শিশুপার্কের কাছে): ০১৭৩১-৫৩৩৭৩৩,
গ. হোটেল অনুরাগ: ৭১৫৭১৭-৭১৪৪৮৯
ঘ. হোটেল স্টার প্যাসিফিক, দরগাহ গেইট: ০১৭১৩-৬৭৪০০৯
ঙ. সুরমা ভ্যালি গেস্ট হাউস: ০১৭১৬-০৯৫৮৩৬
চ. হোটেল উর্মি: হযরত শাহজালাল (র: ) মাজার শরীফ পূর্ব দরগা গেইট, সিলেট, ফোন: ০৮২১-৭১৪৫৬৩, ০১৭৩৩-১৫৩৮০৫
অন্যান্য দর্শনীয় স্থান
৩৬০ আউলিয়ার দেশ সিলেট শহরে আপনি চাইলে হযরত শাহ জালাল (র:) এর মাজারের পাশাপাশি আরও বেশ কিছু দর্শনীয় স্থান ভ্রমণ করতে পারেন। যেমন- জাফলং, বিছনা কান্দি, লালাখাল, ভোলাগঞ্জের সাদা পাথর, তামাবিল, জৈন্তাপুর, সংগ্রামপুঞ্জি ঝর্ণা বা মায়াবী ঝরনা, রাতারগুল, হযরত শাহ পরানের মাজার, ঘড়িঘর, ক্রীন ব্রিজ, ডিমলেন্ড, হযরত শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ইত্যাদি দর্শনীয় স্থান।
খেয়াল রাখবেন:
- মাজারের পবিত্রতা রক্ষা করবেন।
- আপনার সাথে থাকা মোবাইল ফোন ও প্রয়োজনীয় জিনিস স্বজত্নে রাখবেন।
- অপরিচিত কেউ কোন খাবার দিলে তা খাওয়া থেকে বিরত থাকবেন।
- কারো সাথে আর্থিক লেনদেন করার সময় সতর্ক থাকবেন।
- বিভিন্ন প্রকার ভন্ড পীরদের থেকে সাবধান থাকবেন।
- যে কোন জরুরী প্রয়োজনে আইনের সহায়তা নিন।
Faq’s
হযরত শাহ জালাল (র:) মাজার কোথায় অবস্থিত?
শাহ জালাল (র:) মাজার সিলেটের দরগা মহল্লায় অবস্থিত।
হযরত শাহ জালাল (র:) কত খ্রিস্টাব্দে সিলেট আগমন করেন?
১৩০৩ খ্রিস্টাব্দে হযরত শাহজালাল (র:) সিলেট আগমন করেন।
শেষকথা:
হযরত শাহ জালাল (র:) মাজার প্রতিদিন ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে হাজার হাজার মানুষ উপস্থিত হন। আপনি সিলেট শহর ভ্রমন বা প্রয়োজনে আসলে হযরত শাহজালাল (র:) এর মাজার দর্শন করতে পারেন।