রাজবাড়ী জেলা বাংলাদেশের মধ্য-অঞ্চলের ঢাকা বিভাগের অন্তর্গত একটি জেলা। আমাদের আলোচনা রাজবাড়ী জেলার দর্শনীয় স্থান সম্পর্কে। প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী এই রাজবাড়ী জেলায় পর্যটন প্রেমীদের জন্য রয়েছে দর্শনীয় স্থানের অপার সম্ভাবনা। রাজবাড়ী জেলার দর্শনীয় স্থান সমূহ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য নিয়েই আমাদের এই আলোচনা।
রাজবাড়ী জেলার দর্শনীয় স্থান
১৮৭০ সালে গড়াই সেতুর নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার পর ১৮৭১ সালে ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির আওতাধীন পূর্ববঙ্গ অংশে, রেলপথ কলকাতা হতে গোয়ালন্দ ঘাট পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়। ঢাকাসহ বর্তমান বাংলাদেশের পূর্ব অংশে সহজে যাতায়াতের জন্য এই স্থানটি অবধারিত হয়ে উঠেছিল। তাই অতি গুরুত্বপূর্ণ এই মধ্যবর্তী স্থানটিকে ‘The Gateway of Bengal’ বা বাংলার দ্বারপথ বলা হতো। পরবর্তী সময়ে বাংলার স্বাধীনতার পর ১৯৮৪ সালের ১লা মার্চ তৎকালীন ফরিদপুর জেলার গোয়ালন্দ মহকুমা ফরিদপুর থেকে পৃথক হয়ে রাজবাড়ী জেলা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
রাজবাড়ী জেলার উত্তরে পদ্মা নদী, পদ্মা নদীর ওপারে পাবনা জেলা; দক্ষিণে ফরিদপুর, মাগুরা ও ঝিনাইদহ জেলা; পূর্বে পদ্মা নদী, পদ্মা নদীর ওপারে মানিকগঞ্জ জেলা; এবং পশ্চিমে কুষ্টিয়া জেলা অবস্থিত।
পুর্বে এই অঞ্চলজুড়ে জমিদারি ও রাজকার্য পরিচালনা হতো। পাশাপাশি নীল চাষ, ধর্মীয় চর্চা ও অন্যান্য নানা কার্যক্রমও পরিচালনা হতো এখানে। প্রাচীন সেই কর্মকাণ্ডগুলোকে ঘিরে ঐতিহাসিকভাবে এখানে গড়ে উঠেছেছিল রাজবাড়ী, জমিদারবাড়ি, প্রাচীন মসজিদ, মন্দির, নীল কুঠির, দিঘি, মঠ সহ নানা প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা। তাছাড়া প্রাকৃতিকভাবেও রাজবাড়ী জেলা অত্যন্ত সুন্দর।
রাজবাড়ী জেলাতে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত স্থান ও অপ্রাকৃতিকভাবে মানুষের তৈরি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা গুলোর সমন্বয়ে আমাদের আজকের তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। রাজবাড়ী জেলার দর্শনীয় স্থান সমূহ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারবেন পরবর্তী ধাপগুলো থেকে।
জামাই পাগলের মাজার
জামাই পাগলের মাজার (Murshid Jamai Pagol Majar Sharif) রাজবাড়ী সদর উপজেলার আলিপুর ইউনিয়নের ৩ নং ওয়ার্ড ভুক্ত আলাদিপুর গ্রামে অবস্থিত। সেখানকার স্থানীয়দের ধারণা মতে ১৯৬০ সালের দিকে নেংটি পরিহিত ব্যক্তি শেওড়া গাছের নিচে অবস্থান নেয়। বর্তমানে সে স্থানটি হল মাজারের পাশে।
এই লোকটির নামে বিভিন্ন অলৌকিক ঘটনা প্রচলিত রয়েছে। সেখানের লোকমুখে শোনা যায় ‘পাবনা জেলার’ এক ধনী ব্যক্তি তার বোবা মেয়েকে বিয়ে দেয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠে। কারণ তার মেয়ে বোবা বলে কেউ বিয়ে করতে চাইছিল না। তখন তিনি এই লোকটির সাথে বিয়ে দিয়ে দেন। বিয়ের রাত শেষ হবার পরেই বোবা মেয়ে কথা বলতে শুরু করে। আর এই কথা এলাকার মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে। আর সেই সাথে বিয়ের রাতের পর থেকেই পাগল জামাইকে ও আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না।
পরবর্তীতে তার সন্ধান পাওয়া যায় রাজবাড়ী জেলার আলিপুর ইউনিয়নের আলাদীপুর গ্রামে। অনেক খোঁজাখুঁজির পর যখন তাকে পাওয়া গেল তখন তিনি তার স্ত্রীকে জানিয়ে দিলেন তিনি আর ঘর-সংসার করবেন না। এই ঘটনার পর থেকে জামাই পাগলের নাম মানুষের মুখে আরো বেশি বেশি ছড়িয়ে পড়ে।
জানা যায় জামাই পাগল যখন আলাদিপুর গ্রামে আসেন তখন এই এলাকার অনেক মানুষ কলেরায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছিল। তখন তিনি আক্রান্ত ব্যক্তিদের সারিয়ে তোলেন। আর এভাবে তার পরিচিতি বাড়তে থাকে। ধীরে ধীরে সে এলাকার অনেক মানুষ বিভিন্ন মানত নিয়ে তার কাছে আসতেন। এমনকি তার উছিলায় অনেকেই রোগ মুক্ত হতো। তাকে কেউ প্রশ্ন করলে তিনি একই প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি করতেন। ১৯৮৮ সালে সমস্ত এলাকা পানিতে ডুবে গেলেও তার মাজার প্রাঙ্গন বন্যা মুক্ত থাকে।
শোনা যায় তার মৃত্যুর পর এলাকা বাসী তার দাফন সম্পন্ন করেননি। কোথা থেকে জোব্বা পরিহিত এক লোক এসে তার দাফন সম্পন্ন করে সেখান থেকে দ্রুত চলে যায়। জামাই পাগলের মৃত্যুর পর এখানে মাজার স্থাপন করা হয়। এরপর নূর বাকের শাহ নামে এক ভক্ত এই মাজারে অবস্থান নেয় ও দেখাশোনা করত। আর তার মৃত্যুর পর গৌরী পাগলি নামে একজন মাজারটি দেখাশোনা করত। এই তিনজনের কবর মাজারে সারিবদ্ধ ভাবে রয়েছে। মাজার প্রাঙ্গনে রয়েছে এক সুবিশাল মসজিদ। এই মাজারে প্রতিবছর ১৫ই ফাল্গুন ও ৩১শে ফাল্গুন দুইটি বড় উরুসসহ বছরে পাঁচটি উরুষ হয়।
রাজবাড়ী জেলা সদর থেকে জামাই পাগলের মাজারের দূরত্ব ৬ কিলোমিটার। সেখান থেকে রিক্সা অথবা ইজিবাইকে করে সহজেই মাজারে যাওয়া যায়।
কল্যান দিঘী (নবাবপুর)
রাজবাড়ি শহর থেকে ছয় মাইল পশ্চিমে ইসলামপুর ইউনিয়নে রাজধারপুর গ্রাম। আর রাজধারপুর গ্রামের পাশেই কল্যাণ দীঘি (Kollan Dhigi) রয়েছে। বিশাল আকারের এই দীঘি বর্তমানে সমতল বিরাট বিলে পরিনত হলেও দীঘির সীমানা নির্ধারন কষ্টকর হয় না। অনেকের মতে দীঘিটি ১৬ খাদা জমি নিয়ে অবস্থান। আর ১ পাখিতে হয় .২৫ শতাংশ, ১৬ পাখিতে হয় ১ খাদা। এত বড় দীঘি এ অঞ্চলে আর দ্বিতীয়টি নেই।
প্রথমে রাজা সীতা রাম খনন কাজ করেন । এক সময়ে এ অঞ্চলে রাজা সীতারামের করতলগত হয়। রাজা সীতারাম তার রাজধানী মুহম্মদপুরে (মাগুরা) অনেক দীঘি খনন করেন।যেমন – রাম সাগর, সুখ সাগর, কৃষ্ণ সাগর নামক দীঘি তার কীর্তি। কথিত আছে সীতা রামের একদল বেলদার সৈন্য ছিল সংখ্যায় ২০০ জন। তারা যুদ্ধের সময় ছাড়া অন্য সময় জলাশয় খনন করে লোকের পানির কষ্ট দূর করত। জনশ্রুতিতে জানা গেছে যে সীতারাম প্রতিদিন নব খননকৃত জলাশয়ের পানিতে গোসল করতেন। এছাড়াও বেলগাছিতে রাজা সীতারামের খননকৃত একটি পুকুর আছে।
মতান্তরে কল্যাণ দীঘি খান জাহান আলীর কীর্তি। ১৪৫৯ খ্রিস্টাব্দে খানজাহান আলী যশোর ও খুলনা জয় করে খলিফাতাবাদ রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। খানজাহান আলী ধর্মপ্রচার ও জনহিতকর কাজের জন্য বহু দীঘি খনন করেন। খানজাহান আলীর খননকৃত দীঘির মধ্যে অন্যতম হলো বাগেরহাটের দীঘি।
পরবর্তীতে খানজাহান আলী পীর হিসেবে ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে একদল ধর্ম প্রচারককে উত্তর পূর্বাঞ্চলে পাঠান। তার সময়ে এ দীঘি খননকৃত এ ধারনাও বিচিত্র নয়। রাজা সীতা রাম ও খান জাহান আলীর খনন কাজের মধ্যে কিছু পার্থক্য দেখা যায়। মুহ্ম্মদপুরে রাজা সীতারামের খননকৃত সকল দীঘি বাগেরহাটে খান জাহান আলীর খননকৃত সব দীঘির থেকে আকারে ও আয়তনে ছোট। কল্যাণ দীঘির আকার আয়তন অনেক বড় যা খানজাহান আলীর খননকৃত দীঘির মত।
দীঘি খননের সময়কাল ধরলে দেখা যায় খানজাহান আলীর খননকৃত হলে তা হবে প্রায় ৬০০ শত বৎসর পূর্বে। আর সীতারামের খননকৃত হলে তা হবে ৪০০ শত বছর পূর্বে। যে কোন দীঘি যত্নাভাবে বা অন্য কোন কারনে তা বসে যায় বা নষ্ট হয়ে যায়। রাজবাড়ী শহর থেকে ইজিবাইক বা নছিমনে করে কল্যান দীঘি ঘুরতে যেতে পারবেন।
নলিয়া জোড় বাংলা মন্দির (বালিয়াকান্দি)
নলিয়া জোড় বাংলা মন্দির রাজবাড়ী জেলার বালিয়াকান্দি উপজেলার জামালপুর ইউনিয়নের নলিয়া গ্রামে পাশাপাশি দুইটি মন্দির অবস্থিত। একটি মন্দিরের চূড়া থাকলেও অন্য মন্দিরের চূড়া অবশিষ্ট নেই। ১৬৫৫ সালে উড়িষ্যার গৌরীয় রীতিতে রাজা সীতারাম রায় এ জোড় বাংলা মন্দির ও বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে শ্রী কৃষ্ণ রাম চক্রবর্তী রাজা সীতারাম রায়ের অনুরোধে নলিয়া গ্রামে এসে দেব মন্দির এবং বিগ্রহ রক্ষনাবেক্ষনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
স্থানীয়দের কাছে জানা যায়, প্রায় ৩০০ বছর আগে, আনুমানিক ১৬৫৫ সালে রাজা সীতারাম রায় রাজবাড়ীর বেল গাছি এলাকাতে তার ইচ্ছা অনুসারে একটি স্বর্ণের মূর্তি দিয়ে পূজা করতে চেয়েছিল। এই উদ্দেশ্যেই মন্দিরের মূর্তি তৈরি করার জন্য নলিয়া গ্রামের বিখ্যাত এক কর্মকার কে মূর্তি বানানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি।
মূর্তি তৈরির জন্য সেই কর্মকার রাজা সীতা রাম রায়ের কাছে স্বর্ণ চেয়েছিলেন। কিন্তু ওই কর্মকার স্বর্ণ চুরি করতে পারে এমনটি ভেবে রাজা তাঁকে তাঁর বাড়িতে গিয়ে মূর্তি বানাতে বলেন। রাজার এই কথায় কর্মকার মনে কষ্ট পেয়ে রাজার বাড়িতে গিয়ে সোনার মূর্তি পাশাপাশি আরেকটি পিতলের মূর্তি তৈরি করেছিলেন। পূজার আগের দিন পুকুরে মূর্তি ঘষামাজার সময় রাজার নির্দেশকৃত স্বর্ণের এবং পিতলের ওই দুটি মূর্তি পরিবর্তন করে ফেলেন। যখন পূজা আরম্ভ হবে তখন সেই কর্মকার রাজার অনুমতিক্রমে সত্যটা প্রকাশ করেন।
কিন্তু ধর্মীয় রীতিতে এক মন্দিরে দুই পূজা না করার বিধি থাকায় তখন রাজা ওই কর্মকারকে পিতলের মূর্তিটি তাঁর নিজ বাড়ি নলিয়া গ্রামে স্থাপন করে সেখানে পূজা করার নির্দেশ প্রদান করেন এবং মন্দিরটি রাজা নিজে স্থাপন করে দেন। সেই থেকেই সৃষ্টি হয় নলিয়া জোড় বাংলা মন্দির।
সংরক্ষণের অভাব আর দখলদারদের কারণে বিলুপ্তির পথে ঐতিহ্য বহনকারী জোড় বাংলা মন্দির। এক সময় জোড় বাংলা মন্দিরকে কেন্দ্র করে এখানে অপরূপ সাজে সেজেছিল একে একে ৫০ টির অধিক মন্দির। কিন্তু সময়ের আবর্তনে সেখান থেকে বেশিরভাগ মন্দির বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বাকি ৩টি মন্দির এখন সংরক্ষণের অভাবে হারাচ্ছে তার ঐতিহ্য। ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে যে তিনটি মন্দির রয়েছে সেগুলোতেও প্রশাসনের কোন নজরদারি নেই। মন্দিরগুলো এখন জরাজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে।
বালিয়াকান্দি থেকে মন্দিরের দূরত্ব ১৪ কিলোমিটার। বালিয়াকান্দি বাস স্ট্যান্ড থেকে ইজিবাইক, বাস অথবা নছিমনে করে মন্দিরে যেতে পারবেন।
মীর মোশারফ হোসেন স্মৃতি কেন্দ্র (বালিয়াকান্দি)
উনবিংশ শতাব্দীর সর্বশ্রেষ্ট মুসলিম সাহিত্যিক রুপে খ্যাত ‘বিষাদ সিন্ধুর’ অমর লেখক মীর মশাররফ হোসেন। ১৮৪৭ সালের ১৩ই নভেম্বর কুষ্টিয়া শহর থেকে তিন মাইল পূর্বে গড়াই ব্রীজের নিকটস্থ লাহিনীপাড়া গ্রামে মামার বাড়িতে ভূ-সম্পত্তির অধিকারী এক ধনাঢ্য পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ছিল মীর মোয়াজ্জ্বেম হোসেন এবং মাতার নাম ছিল দৌলতন নেছা।
জানা যায় মীর মোশারফ হোসেনের পূর্বপুরুষ সৈয়দ সাদুল্লাহ বাগদাদ থেকে প্রথমে দিল্লি এবং পরবর্তীতে ফরিদপুর জেলার স্যাকরা গ্রামে আগমন করেন। এক হিন্দু ব্রাক্ষণ কণ্যার পাণি গ্রহণ করে পদমদী গ্রামে স্থায়ীভাবে বসবাস আরম্ভ করেন। মীর মশাররফ হোসেনের পিতা মীর মোয়াজ্জম হোসেন কুষ্টিয়ার লাহিনীপাড়া গ্রামের ভূস্বামী ছিলেন।
তিনি কুষ্টিয়ার লাহিনীপাড়ায় জন্মগ্রহণ করলেও তার জীবনের প্রায় পুরো সময় অতিবাহিত হয়েছে পৈতৃক নিবাস রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি উপজেলার নবাবপুর ইউনিয়নের পদমদী গ্রামে। এখানেই তিনি তার জীবনের উল্লেখযোগ্য কাব্য, উপাখ্যান, উপন্যাস, নাটক, আত্মজীবনী, অনুবাদ ও প্রবন্ধ রচনা করেন। তার মোট গ্রন্থের সংখ্যা ৩৭টি। তৎকালীন সময়ে ‘জমিদার দর্পণ’ নাটকের জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ নাট্যকারের মর্যাদা লাভ করেন। তার সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ ‘বিষাদ সিন্ধু” বাংলা সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ।
মীর মশাররফ হোসেনের জীবন শুরু হয় নিজ গৃহ হতে কুষ্টিয়া, ফরিদপুর কৃষ্ণনগরের বিভিন্ন বিদ্যালয়ে। তিনি সম্ভবত অষ্টম শ্রেণীতে উঠে কলকাতায় পিতৃবন্ধু নাদির হোসেনের বাসায় থেকে কিছুকাল পড়াশুনা করেন। নাদির হোসেনের বাসায় অবস্থানকালে তাঁর প্রথম কন্যা অনেক সুন্দরী লতিফনের সংগে প্রথমে ভালবাসা এবং পরে বিবাহের ব্যবস্থা হয়। ১৮৬৫ সালের ১৯শে মে বিবাহের সময় নাদির হোসেন প্রথম কন্যার পরিবর্তে দ্বিতীয় অসুন্দর ও বুদ্ধিহীনা কন্যা আজিজন্নেসার সংগে তাঁর বিবাহ দেন। এই ঘটনার পরিণামে লতিফন্নেসা আত্মহত্যা করলে মীর ভীষণ আঘাত পান। তিনি তাঁর স্ত্রী আজিজন্নেসাকে ক্ষমা করতে পারেন নাই।
আরও পড়ুন: ঢাকার দর্শনীয় ঐতিহাসিক স্থানসমূহ
মীরের প্রথম বিবাহ সুখের না হওয়ায় বিবাহের আট বছর পর তিনি দ্বিতীয় বিবাহ করেন। সাঁওতা গ্রামের এক বিধবার কন্যা কালী ওরফে কুলসুম বিবিকে বিবাহ করেন। মীর মশাররফ হোসেনের পাঁচটি পুত্র ও ছয়টি কন্যা সবাই বিবি কুলসুমের গর্ভজাত। ১৯১১ সালের ১৯শে ডিসেম্বর পদমদী গ্রামে মীর মশাররফ হোসেন ইনতিকাল করলে বিবি কুলসুমের কবরের পাশেই তাঁকে সমাহিত করা হয়।
২০০১ সালে মীর মোশারফ হোসেনের স্মৃতি রক্ষার্থে স্মৃতি কেন্দ্রের বৃত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। আড়াই কোটি টাকা ব্যয়ে প্রায় দুই একর জায়গায় জুড়ে নির্মাণ করা হয়েছে। ২০০৫ সালে মীর মোশারফ হোসেন স্মৃতি কেন্দ্র দর্শনার্থীদের জন্য খুলে দেয়া হয়। এই স্মৃতি কেন্দ্রে রয়েছে সংগ্রহশালা, দফতর, ১০০ আসন বিশিষ্ট সেমিনার কক্ষ, গ্রন্থাগার, অভর্থনা কক্ষ, অতিথি কক্ষ, ডাইনিং, প্রসাধন কক্ষ এবং কিচেন। বর্তমানে এই স্মৃতি কেন্দ্রটিতে প্রতিদিন অসংখ্য দর্শনার্থী ঘুরতে আসেন। শুক্রবার ও শনিবার সহ সকল ধরনের সরকারি ছুটির দিনে এই স্মৃতি কেন্দ্রটি বন্ধ থাকে।
রাজবাড়ী জেলা থেকে অটোরিকশা রিজার্ভ করে সরাসরি মীর মোশারফ হোসেন স্মৃতি কেন্দ্রে যেতে পারবেন।
নীলকুঠি (বালিয়াকান্দি)
১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহের পর নীলকরদের অত্যাচার আরো বৃদ্ধি পায়। এবং প্রজা সাধারণ অতিষ্ট হয়ে সংঘবদ্ধভাবে নীলকরদের বিরূদ্ধে রুখে দাড়ায়। শুরু হয় নীলবিদ্রোহ। রাজবাড়ীতে নীলবিদ্রোহ সংঘটিত হয়। এ সময় বালিয়াকান্দি থানার সোনাপুরের হাশেম আলীর নেতৃত্বে শত শত চাষী নীলকর ও জমিদারদের বিরূদ্ধে নীল বিদ্রোহে অংশ নেয়।
বহু স্থানে নীলকুঠি আক্রমণ করে ও কাচারী জ্বালিয়ে দেয়। এ অঞ্চলের বসন্তপুর, বহরপুর, সোনাপুর, বালিয়াকান্দি, নাড়ুয়া, মৃগী, মদাপুর, সংগ্রামপুর, পাংশার নীলচাষীরা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। ফলে ১৮৬০ সালে বৃটিশ সরকার নীল কমিশন বসান এবং নীল চাষ স্বেচ্ছাধীন ঘোষণা করেন। ধীরে ধীরে কৃত্রিম নীল উদ্ভাবিত হয় এবং প্রাকৃতিক নীল চাষ বন্ধ হয়ে যায়।
শাহ পালোয়ানের মাজার (বালিয়াকান্দি)
বিশ্বে দুইটি পূর্ব পশ্চিম মাজার শরীফ রয়েছে। আর এই দুটি মাঝারই আমাদের বাংলাদেশে অবস্থিত। হযরত শাহজালাল (রহ:) এর সঙ্গী ৩৬০ আউলিয়ার অন্যতম সিপাহসালার হযরত সৈয়দ নাসির উদ্দিন (রহ:) মুরারবন্দ আউলিয়ার দরবার শরীফ চুনারুঘাট মুন্সিগঞ্জ। হযরত শাহ পালোয়ান (রহ:) এর মাজার বালিয়াকান্দি রাজবাড়ি। রাজবাড়ী অঞ্চলে ষোড়শ শতকে ধর্ম প্রচারের জন্য আগমন করেন শাহ পাহলোয়ান এর মত আউলিয়ারা।
১৪৮০ হতে ১৫১০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে শাহ পালোয়ান বাগদাদ শরীফ পরিত্যাগ করে ফরিদপুর অঞ্চলে এসে চন্দনা নদীর তীরে বাসস্থান নির্মাণ করে উপাসনা করছিলেন। কামাল শাহ নামক এই আউলিয়া সর্বপ্রথম এ অঞ্চলে ইসলাম ধর্ম প্রচার করা শুরু করেন। কথিত আছে যে শাহ পালোয়ান মৃত্যুর সময় শিষ্যদের তার কবর পূর্ব-পশ্চিম লম্বা-লম্বি দিতে বলেছিলেন। কিন্তু তার শিষ্যবর্গ প্রচলিত ইসলামের বিধানমতে যথা নিয়মে তাকে কবরস্থ করেন। কিন্তু সকালে দেখা গেল তার কবর অলৌকিকভাবে ঘুরে পূর্ব-পশ্চিম লম্বা-লম্বি হয়ে গিয়েছে। সেই থেকে এলাকার মানুষ খুব যত্ন সহকারে এই মাজারটিকে দেখাশোনা করছেন। শাহ পালোয়ানই রাজবাড়ী অঞ্চলে ইসলাম প্রচারের ভিত রচনা করে গেছেন।
বর্তমানে এই মাজারটিতে হিন্দু-মুসলিম সব ধর্মের মানুষই আসে। তারা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের আশায় ও রোগ মুক্তির কামনায় মানত করে। মাজার কমিটির সেক্রেটারি এস এম হেলাল খন্দকার জানান, এখানে বিভিন্ন জেলার ও দূরদূরান্ত থেকে ভক্তরা আসেন। একজন মহান ব্যক্তির মাজারটি আমাদের এলাকায় হওয়ায় আমরা গর্ববোধ করি। তিনি এই মাজারটি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি কামনা করেন।
প্রতিবছর দুই ফাল্গুন শাহ পালোয়ান মাজারে উরশ অনুষ্ঠিত হয়। সেই সাথে পীরের আত্মার শান্তি কামনা করে দোয়া মাহফিল ও কাঙালিভোজের আয়োজন করা হয়। রাজবাড়ী জেলা শহর থেকে রেললাইন ধরে এক কিলোমিটার পূর্ব দিকে অটোরিকশা করে গেলেই ইসলামপুর ইউনিয়নের শেকরা গ্রামে দ্বাদশী খোদাই দরগাহ মাজার দেখা যাবে।
সমাধিনগর মঠ (বালিয়াকান্দি)
বালিয়াকান্দি উপজেলার জঙ্গল ইউনিয়নে ১৯৪০ সালে স্বামী সমাধী প্রকাশরণ্য এ মঠটি নির্মাণ করেন। এই মঠটির উচ্চতা ৭০ ফুট (গম্বুজসহ)। এর দৈর্ঘ্য প্রায় ৮০ ফুট এবং প্রস্থ ৫০ ফুট। এটি অনাদি আশ্রম বলে পরিচিত। স্বামী সমাধী প্রকাশরণ্য এ আশ্রমের মাধ্যমে ঐ এলাকার মানুষকে বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দিয়ে তার চিহ্নিত ধর্মীয় পথে অগ্রায়ণ করে গেছেন।
বর্তমানে বলিয়াকান্দি এলাকার অন্যতম দর্শনীয় প্রাচীন স্থাপত্যশৈলীর মধ্যে এটি অন্যতম। বাংলাদেশের যেকোন প্রান্ত থেকে রাজবাড়ী জেলার বালিয়াকান্দি এলাকায় গিয়ে এই স্থানটি পরিদর্শন করে আসতে পারেন।
শেষকথা
বিশ শতকের শুরুর দিকে ও মধ্য সময়কালে গড়ে ওঠা রাজবাড়ী জেলার স্থাপনা গুলোই বাংলাদেশের মানুষের কাছে ঐতিহাসিক স্থান হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছে। স্থানীয়রা মনে করেন, সরকার যদি প্রত্নতাত্ত্বিক এই স্থাপনা গুলো সংস্কার করে পর্যটন ক্ষেত্র হিসেবে গড়ে তোলেন, তাহলে দেশ-বিদেশের বহু পর্যটক এখানে পরিদর্শন করতে আসবে। এতে করে রাজবাড়ী জেলা ভ্রমণপিপাসু মানুষদের কাছে আকর্ষণীয় স্থান হয়ে উঠবে এবং দেশে প্রচুর রাজস্ব আয় হবে। কিন্তু পর্যটন বিকাশে কোন উদ্যোগ না থাকায় দীর্ঘদিন স্থাপনাগুলো পড়ে এভাবে থাকলে একসময় তা বিলিন হয়ে যাবে।