পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের শহর ময়মনসিংহে অবস্থিত বিখ্যাত শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালা (Silpacarya-jaẏanula-abedina-sangrahasala)। এটি বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর কর্তৃক পরিচালিত একটি সংগ্রহশালা। এখানে বাংলাদেশের বিখ্যাত চিত্রশিল্পী শিল্পাচার্য জয়নাল আবেদীনের এর অনন্য সুন্দর চিত্রকর্মগুলো সংরক্ষণ করা আছে।
ইতিহাস
পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে, ময়মনসিংহ শহরের উত্তর পাশে একটি দ্বিতল ভবনকে পুঁজি করে ১৯৭৫ সালে এই সংগ্রহশালাটি প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ১৯৭৫ সালের ১৫ এপ্রিল অর্থাৎ ১৩৮২ বঙ্গাব্দের ১লা বৈশাখ সেই সময়ের বাংলাদেশ সরকারের উপ-রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এই সংগ্রহশালার উদ্বোধন করেন। সেই সময়ই দেশব্যাপী জয়নুল আবেদিনের বিভিন্ন শিল্পকর্মসমূহ সংরক্ষণের জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছিল।
তাই প্রাথমিক অবস্থায় মহান শিল্পীর নিজের এলাকা অর্থাৎ ময়মনসিংহেই এই সংগহশালাটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। উদ্বোধনের পর ৭ জুলাই সংগ্রহশালাটির অফিসিয়ালি কাজ শুরু হয়। ২০০৬ সালে সংগ্রহশালাটি নতুন আঙ্গিকে সজ্জিত করা হয়। ভবনের নিম্নকক্ষে ব্যবস্থাপনা কক্ষসমূহ এবং দুই তলায় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ছবির গ্যালারী স্থাপন করা হয়েছে। মূল ভবনটির পশ্চাৎভাগে ব্যবস্থাপকদের বাসস্থানের পাশাপাশি ৩ টি কুটির প্রতিস্থাপন করা হয়। যেটাকে শিল্পপ্রেমীদের সাময়িক আবাসনের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে।
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালা দুই তলা ভবনবিশিষ্ট এই সংগ্রহশালাটি যেই জমিনে অবস্থিত সেটার মোট আয়তন হচ্ছে ৩.৬৯ একর। পুরো চত্বরটি ঘন সবুজ বৃক্ষাদিতে বেষ্টিত। এই সংগ্রহশালার ভবনটিতে উপনিবেশ আমলে জনৈক ইংরেজ বার্ডেন সাহেবের বাড়ি ছিলো। সেই ব্রিটিশের কাছ থেকে বড়লাটের (ভাইসরয়) কাউন্সিল সদস্য নলিনীরঞ্জন সরকার এই বাড়িটি বিক্রয় করেন। অতঃপর ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর নলিনীরঞ্জন ভারতে চলে যায়।
এরপর পাকিস্তান সরকার বাড়িটি অধিগ্রহণ করে। পাকিস্তান আমল অর্থাৎ ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত এটি ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তাদের সরকারি বাসভবন হিসেবে ব্যবহৃত হতো। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পরও কয়েক বছর এটি এভাবেই ছিল। অতঃপর ১৯৭৫ সালে সরকারী আদেশবলে এটিকে সংগ্রহশালায় পরিণত করা হয়। জয়নুল আবেদিনেরও বাসনা ছিলো একটি সংগ্রহশালা হোক। অতঃপর সেই ধারণা বাস্তবায়ন হয়। ১৯৫০ এর দশকে তিনি বাংলাদেশের আনাচে কানাচে ছড়ানো ছিটানো অসংখ্য দুর্লভ ছবির সংগ্রহের কাজে নেতৃত্ব প্রদান করেছিলেন।
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালায় কী কী আছে
এই সংগ্রহশালাটিতে প্রাথমিক অবস্থায় যে ৭০ টি চিত্রকর্ম ঠাঁই পেয়েছিল তার বেশিরভাগই ছিল তৈলচিত্র। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য চিত্রগুলোর মধ্যে আছে – বিভিন্ন দেশ ভ্রমনের সময় শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন এর অঙ্কিত ছবিগুলো, গুণটানা, নদী পারাপারের অপেক্ষায় পিতা-পুত্র এবং দুর্ভিক্ষ।
এখানকার অতি আকর্ষণীয় ১৭ টি ছবি ১৯৮২ সালে চুরি হয়ে যায়। তার মধ্যে ১০ টি ছবি ১৯৯৪ সালে আবার উদ্ধার করা হয়েছে। বর্তমানে এখানে মোট ৬৩ টি চিত্রকর্ম আছে। এগুলো ছাড়াও আছে শিল্পাচার্যের ব্যবহৃত জিনিসপত্র এবং তার কিছু স্থিরচিত্র। স্থিরচিত্রগুলো ভবনের দুই তলার বারান্দার দেওয়ালে রাখা হয়েছে।
সংগ্রহশালার ১নং গ্যালারিতে আছে
শম্ভুগঞ্জ ঘাট, শম্ভুগঞ্জ ব্রিজ, স্কেচ (বংশীবাদক), বাস্তুহারা, প্রতিকৃতি, প্রতিকৃতি, মহিষের বাচ্চা, কাজী নজরুল ইসলাম, কংকালসার, দুর্ভিক্ষের ছবি, রমনী-১, ১৯৫১, কাগজে টেম্পোরা, মা ও ছেলে- ১৯৫১, কলসী কাঁখে- ১৯৫১, স্নান শেষে ১৯৫১, মা ও শিশু- ১৯৫৩, তিন রক্ষী- ১৯৫৩, চিন্তা- ১৯৫৩, কাগজে টেম্পোরা, চিন্তা- ১৯৫৩
সংগ্রহশালার ২নং গ্যালারিতে আছে
• সংগ্রহশালার প্রথম পরিচালনা পরিষদের নাম সংবলিত ফলক।
শিল্পাচার্যের ব্যবহার্য নিদর্শনসমূহ যেমনঃ জুতা, কোট, রংতুলি, চিত্রপট, কলম, শার্ট, প্যান্ট, শিল্পাচার্যের স্থিরচিত্রসমূহ।
প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা
১৯৭৫ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসক সংগ্রহশালাটির পরিচালনার দায়িত্বে থাকতেন। বাংলাদেশের জাতীয় জাদুঘরের একটি শাখা হিসেবে ১৯৯৯ সালে এটাকে ঘোষণা করা হয়। তারপর থেকেই জাতীয় জাদুঘরের অধীনেই এটি পরিচালিত হচ্ছে।
টিকেট ও সময়সূচী
১২ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুদের ১০ টাকা প্রবেশ টিকেট মূল্য। প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য ২০ টাকা। সার্কভুক্ত দেশ সমূহের নাগরিকদের জন্য ৩০০ টাকা প্রবেশ টিকেট। এছাড়া অন্যান্য দেশের নাগরিকের জন্য ৫০০ টাকা।
শনিবার দিন থেকে বুধবার পর্যন্ত এটা খোলা থাকে। এপ্রিল মাস থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত সকাল দশটা থেকে বিকাল সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত খোলা। অক্টোবর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত সকাল ১০ টা থেকে বিকাল চারটা পর্যন্ত খোলা।
সপ্তাহের বৃহস্পতিবার শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালাটি বন্ধ থাকে। তবে শুক্রবার বিকাল তিনটা থেকে সন্ধ্যা আটটা পর্যন্ত এটা খোলা থাকে।
কীভাবে যাবেন
ঢাকা মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে প্রতিদিন অসংখ্য গাড়ি ময়মনসিংহ আসে। এদের মধ্যে এনা, সৌখিন এর সার্ভিস অনেক ভালো।
এছাড়া রেলে করেও আসতে পারেন। ঢাকা থেকে অনেক ট্রেন ময়মনসিংহ প্রতিদিন যাতায়াত করে।
ময়মনসিংহ শহরে এসে যেকোনো রিক্সাওয়ালাকে জিজ্ঞাসা করলেই শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের সংগ্রহশালায় নিয়ে যাবে।
আরও পড়ুন: আজকের ট্রেনের সময়সূচী
কোথায় থাকবেন
ময়মনসিংহ অনেক ভালো ভালো হোটেল রয়েছে। এদের মধ্যে হোটেল হেরা, সিলভার ক্যাসেল অন্যতম। এছাড়া রেস্তোরাঁদের মধ্যে আছে ধানসিঁড়ি, সারিন্দা। ময়মনসিংহ শহর পূর্বের চেয়ে এখন অনেক উন্নত তাই থাকা ও খাওয়া নিয়ে ভাবতে হবে না।
Faq’s
জয়নুল আবেদিনকে কেন শিল্পাচার্য বলা হয়?
আচার্য শব্দের আভিধানিক অর্থ — যিনি নিজে আচরণ করে অন্যকে শেখান। শব্দটি শিক্ষক অর্থেই মূলত ব্যবহৃত হয়। জয়নুল আবেদীন এদেশের শিল্পকলার পথিকৃৎ। দেশের শিল্পক্ষেত্রে তিনি অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন। তাই তিনি শিল্পাচার্য।