সিলেট শাহী ঈদগাহ – Sylhet Shahi Eidgah

সিলেট শাহী ঈদগাহ (Sylhet Shahi Eidgah) সিলেটের সার্কিট হাউজ থেকে তিন কিলোমিটার উত্তর পূর্বে কাজীটোলা সড়কে অবস্থিত। এটি সিলেট শহরের উত্তর দিকে অবস্থিত। বাংলাদেশের ঐতিহাসিক স্থাপনা সমূহের মধ্যে এটি একটি। এই ঈদগাহটি ১৭০০ সালের প্রথম দিকে নির্মাণ করা হয়েছিল।

ঈদগাহটি দেখতে কেল্লার মত। পাহাড়ের টিলায় সবুজে আবৃত পরিবেশে এ ঈদগাহ কেবল ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাক্ষীই নয়, এ যেন নগরজীবনে প্রশান্তির কেন্দ্রবিন্দু। পাহাড়-টিলা আর হাজারো বৃক্ষরাজির মধ্যে এই মনোমুগ্ধকর অবস্থান যে কারোর নজর কাড়ে। এই ঈদগাহটি বিভিন্ন কারণে পর্যটকদের কাছে অনেক আকর্ষণীয়।

সিলেট শাহী ঈদগাহ এর ইতিহাস

বাংলাদেশের প্রথম ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের ক্ষেত্রে ৩ শতাধিক বছরের ঐতিহ্য হিসেবে পরিচিত সিলেটের শাহী ঈদগাহ। শত শত বছরের ঐতিহ্য, মনোমুগ্ধকর কারুকার্যময় এ ঈদগাহটি নির্মাণ করেন মোগল ফৌজদার ফরহাদ খাঁ। তখন মোঘল সম্রাট ছিলেন আওরঙ্গজেব।

১৭০০ সালের প্রথম দশকে মোগল স্থপতি ফৌজদার ফরহাদ খাঁ নিজের ব্যক্তিগত উদ্যোগে ও তত্ত্বাবধানে মুঘল স্থাপত্য শৈলীতে নির্মিত করেন এই ঈদগাহটি। সিলেটের প্রাচীনতম ঐতিহ্যের এক নিদর্শন এটি। ১৭৭২ সালে সৈয়দ হাদি ও মাদী কর্তৃক ইংরেজ বিরোধী, ভারত বাংলা জাতীয়তাবাদী এর প্রথম আন্দোলন এই মাঠেই শুরু হয়েছিল। অতীতে সিলেট শাহী ঈদগাহ স্থানটিতে বড় বড় সমাবেশ সংঘটিত হয়েছিল।

ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের নেতা মহাত্মা গান্ধী, মাওলানা মোহাম্মদ আলী, শেরে বাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হক, কায়েদে আযম, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো বড় বড় নেতাদের পদচিহ্ন পড়েছে এই ঈদগাহ স্থানটিতে। তারা ইংরেজ বিরোধী গণ আন্দোলনের আহ্বান জানিয়েছেন। সেজন্য এই স্থানটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনেক বেশি।

এই ঈদগাহতে প্রতিবছর ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার দুটি বিশাল জামাত অনুষ্ঠিত হয়। এখানে প্রায় দেড় থেকে দুই লক্ষ মুসল্লি একসঙ্গে নামাজ আদায় করতে পারে।

সিলেট শাহী ঈদগাহ এর বর্ণনা

একটি উচু টিলার উপর সিলেটের ঐতিহ্যবাহী এই শাহী ঈদগাহ অবস্থিত। মুল ভূ-খণ্ডে কারুকার্য খচিত ২২ টি বৃহৎ সিঁড়ি রয়েছে। সিঁড়ি মাড়িয়ে উপরে উঠলে ১৫ টি গম্বুজ সজ্জিত ঈদগাহ দেখা যায়। ঈদগাহের প্রাচীর সীমার চার দিক ঘিরে রয়েছে ছোট বড় ১০ টি গেট।

টিলার মূল সামনের দিকে আটটি গম্বুজ রয়েছে। গাছের ছায়ায় ঘেরা বিস্তৃত মাঠ এবং সীমানা প্রাচীরের চারদিকে রয়েছে ছোটবড় আরো ১০টি গেট। আর ঈদগাহের সামনের দিকে রয়েছে মূল তিনটি গেট। মুসল্লীদের অজুর জন্য ঈদগাহের সামনে বিশাল পুকুর রয়েছে ।

ঈদগাহের উত্তরে শাহী ঈদগাহ মসজিদ, পাশে সুউচ্চ টিলার ওপর বন কর্মকর্তার বাংলো, দক্ষিণে বাংলাদেশ টেলিভিশনের সিলেট কেন্দ্র, পূর্ব দিকে হযরত শাহজালালের সফরসঙ্গী শাহ মিরারজী (র:) এর মাজারের পাশের টিলার ওপর রয়েছে সিলেট আবহাওয়া অফিস। চারপাশে সবুজ আর সবুজ মাঝখানে ঈদগাহের এই মনোরম দৃশ্যটি সবাইকে মনোমুগ্ধকর করে।

পূর্বে সিলেট শাহী ঈদগাহ- তে প্রবেশের জন্যে কোন ফটক না থাকলেও নিরাপত্তাজনিত কারনে বর্তমানে ফটক নির্মাণ করা হয়েছে। বর্তমানে সরকার ধারন ক্ষমতাও ৩ গুন বাড়ানোর লক্ষ্য নিয়ে এই ঈদগাহটি আরো সম্প্রসারন করছে।

মুঘল আমলের স্থাপত্যের ছাপ স্পষ্ট মূল ৩ টি গেটে রয়েছে । ২০০১ সালে বড় পরিসরে এই তিনটি গেটের সংস্কার করে দেন স্থানীয় ব্যবসায়ী হাজারীবাগ নীরু মঞ্জিলের বাসিন্দা জহির উদ্দিন তারু মিয়া। ২০০৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর তৎকালীন অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান ঈদগাহের ভিতরের ফলক অনুযায়ী পুকুরের চারদিকে ঘাট নির্মাণের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। এর পাশাপাশি ২০১০ সালের ২৯ অক্টোবর ঈদগাহে বিদ্যুতায়ন, সংস্কার ও চারদিকে ফুটপাত নির্মাণ কাজেরও উদ্বোধন করেন তিনি।

সম্প্রতি সিলেট সিটি করপোরেশন ঈদগাহটির নিরাপত্তা প্রাচীর কারুকার্যময় করে নির্মাণ করেছে। ঐতিহ্যবাহী এই ঈদগাহটির চারপাশে পাকা সড়কপথ আর সীমানা প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। ঈদগাহ ঘিরে রয়েছে দেশি-বিদেশি কয়েকশ প্রজাতির গাছ।

তিনশ বছরের প্রাচীন শাহী ঈদগাহটি সিলেট নগরের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অংশ। এখানে শত শত দর্শনার্থীরা আসেন এই ঐতিহাসিক সিলেট শাহী ঈদগাহ টি দেখার জন্য। এখানের নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখার জন্য আপনারাও চাইলে আসতে পারেন এই ঐতিহাসিক স্থানটিতে।

কিভাবে সিলেট শাহী ঈদগাহ যাবেন

দেশের যে কোন স্থান থেকে সিলেট যাওয়া যায়, রাজধানী ঢাকার সায়দাবাদ ফকিরাপুল, গাবতলি ও মহাখালী বাসস্ট্যান্ড থেকে সিলেটের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন পরিবহণের বাস ছেড়ে যায়। তাদের মধ্যে গ্রিন লাইন, এনা ট্রান্সপোর্ট, সৌদিয়া পরিবহন, এস আলম, শ্যামলী, হানিফ এন্টারপ্রাইজ, ইউনিক বাস সার্ভিস ইত্যাদি এসি/নন-এসি বাস উল্লেখযোগ্য। এসব পরিবহণের প্রতিটি সিটের ভাড়া ৫৫০ থেকে ১৪০০ টাকা হয়ে থাকে।

এছাড়া কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে আন্তঃনগর পারাবত এক্সপ্রেস, জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস, কালনি এক্সপ্রেস ও উপবন এক্সপ্রেস ট্রেনের মাধ্যেমে সিলেট শহরে যাওয়া যায়। ট্রেনে চড়ে সিলেট যেতে ৭ থেকে ৮ ঘন্টার মত সময় লাগে।

চট্টগ্রাম থেকেও ট্রেনের মাধ্যমে সিলেট যেথে পারেন। পাহাড়িকা এক্সপ্রেস ও উদয়ন এক্সপ্রেস সিলেট- চট্টগ্রাম রোটে চলাচল করে।

আপনি চাইলে আকাশপথে বিমানের মাধ্যমে সিলেট আসতে পরেন।

সিলেট থেকে শাহী ঈদগাহ কিভাবে যাবেন

সিলেট শহরের কেন্দ্রবিন্দু হতে শাহী ঈদগাহর দুরত্ব প্রায় ২ কি.মি.। সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর হতে ৭ কি.মি. এবং সিলেট রেলওয়ে স্টেশন থেকে ৫ কি.মি. দুরত্বে শাহী ঈদগাহ’র অবস্থান। সেখান থেকে অটো রিক্সা বা সি.এন.জিতে চড়ে শাহী ঈদগাহ পৌছাতে পারেন।

খাবার 

সিলেটে আছে রাজকীয় খাবার ব্যবস্থা। সেখানে আপনি কখনো খাবার নিয়ে কোন অভিযোগ করতে পারবেন না। দেশের সেরা সেরা খাবার হোটেল  আছে এখানে। এখানে খুব অল্প টাকায় উন্নতমানের খাবার খেতে পারবেন। পাঁচ ভাই রেস্টুরেন্ট, পানশি রেস্টুরেন্ট, উঠান রেস্টুরেন্ট, পালকি রেস্টুরেন্ট এ আপনি খেতে পারেন। তাছাড়া সিলেট শহরে রয়েছে অসংখ্য চাইনিজ রেস্টুরেন্ট। এসব রেস্টুরেন্টে দেশী বিদেশী অনেক রকমের খাবার ও বিভিন্ন প্রকারের ভর্তা পাওয়া যায়। সিলেটের সাতকরার স্বাদও নিতে পারেন।

সিলেট জেলার দেখার মত দর্শনীয় স্থান

সিলেট জেলার আকর্ষনীয় দর্শনীয় স্থানের মধ্যে আছে হযরত শাহজালাল (র.) এর মাজার, হযরত শাহপরান (র.) এর মাজার, ব্রিটিশ আমলের নির্মিত ক্বীন ব্রীজ, উপমহাদেশের প্রাচীন চা বাগান মালনীছড়া চা বাগান, জাফলং, বিছনাকান্দি, রাতারগুল জলাবন, লোভাছড়া, লালাখাল, সংগ্রামপুঞ্জি ঝর্ণা, পান্থুমাই ঝর্ণা, হাকালুকি হাওর, ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর, সিলেট ড্রিমল্যান্ড পার্ক, উসমানী শিশু পার্ক এবং জাকারিয়া সিটি।

ভ্রমন সর্তকতা

  • ভ্রমনের সময় আপনার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিতে ভুলবেন না।
  • গাড়ীতে উঠতে বা নামতে সাবধানতা অবলম্বন করুন, ছোট বাচ্চা সাথে থাকলে সাবধানে রাখবেন।
  • আপনার সাথে থাকা মূল্যবান জিসিন যেমন – টাকা, মোবাইল, স্বর্নের ব্যবহার্য প্রসাধনী সাবধানে রাখুন।

প্রয়োজনীয় কিছু প্রশ্নের উত্তর

ঈদগাহ শব্দের অর্থ কি?

ঈদগাহ (عید گاہ‎‎‎) দক্ষিণ এশীয় ইসলামী সংস্কৃতিতে ব্যবহৃত একটি শব্দ যা দ্বারা খোলা আকাশের নিচে ঈদুল ফিতর এবং ঈদুল আযহার নামাজ আদায়ের জন্য সাধারণত শহরের বাইরে বা শহরতলীতে বড় ময়দানকে বোঝানো হয়।

বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ঈদগাহ মাঠ কোনটি?

এশিয়া উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় ঈদগাহ মাঠ দিনাজপুরে পবিত্র ঈদুল ফিতরের নামাজ অনুষ্ঠিত হয়েছে। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় এই ঈদ জামাতে একসঙ্গে ৬ লক্ষাধিক মুসল্লি অংশ নেন বলে দাবি আয়োজকদের। এখানেই এশিয়া উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় ঈদগাহ মিনার রয়েছে। সবুজ ঘাসে মোড়ানো মাঠের আয়তন ২২ একর।

শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠের আয়তন কত?

কিশোরগঞ্জ শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠের আয়তন ৭ একর।

আরও পড়ুন: 

কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত

শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালা

লালদীঘি নয় গম্বুজ মসজিদ, রংপুর

ঠিকানা রিসোর্ট

পৃথিমপাশা নবাব বাড়ি পর্যটকের আকর্ষণ

শেষকথা

বাংলাদেশ তথা সিলেটের দর্শনীয় স্থান সমূহের মধ্যে সিলেট শাহী ঈদগাহ একটি। সিলেট ভ্রমনে আসা পর্যটকেরা এই  শাহী ঈদগাহ ভ্রমনে করতে ভুল করেন না। আপনিও আসতে পারেন আধুনিক এই মুসলিম স্থাপত্য দেখার জন্য।