তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ম জানা সকল মুমিনদের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। রাতের নামাজ তাহাজ্জুদের ঘোষণা করেছেন স্বয়ং আল্লাহ তা’আলা। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ তা’আলা রাসূলুল্লাহ (সাঃ) -এর উদ্দেশ্যে বলেন-
-وَمِنَ الَّيْلِ فَتَهَجَّدْ بِهِ نَافِلَةً لَّكَ عَسَى أَنْ يَبْعَثَكَ رَبُّكَ مَقَامًا مَّحْمُودًا
“আর রাতের কিছু অংশ তাহাজ্জুদ কায়েম করো, ইহা তোমার এক অতিরিক্ত কর্তব্য। আশা করা যায় তোমার প্রতিপালক তোমাকে প্রতিষ্ঠিত করবেন প্রশংসিত স্থানে; মাকামে মাহমুদে।” (সূরা ইসরা, আয়াত: ৭৯)
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন- “ফরজ নামাজের পর সর্বশ্রেষ্ঠ নামাজ হলো রাতের (তাহাজ্জুদ) নামাজ।” রাতের শেষাংশে মহান রব দুনিয়ার আকাশে নেমে মানুষকে নামাজের জন্য, তাঁকে ডাকার জন্য, ক্ষম প্রার্থনার জন্য আহ্বান করেন।
তাই তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ম, তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ত, দোয়া, তাহাজ্জুদ নামাজের ফজিলত, তাহাজ্জুদ নামাজের সময়, তাহাজ্জুদ নামাজ সুন্নত নাকি নফল, কতাহাজ্জুদ নামাজ কত রাকাত, মহিলাদের তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ম, তাহাজ্জুদ নামাজের সূরা এবং পবিত্র কোরআনে ও রাসূলুল্লাহ (সাঃ) -এর হাদিসে তাহাজ্জুদ সম্পর্কে উল্লেখিত তথ্যাবলীর বিস্তারিত জানতে পারবেন এই লেখা থেকে।
তাহাজ্জুদ নামাজ | তাহাজ্জুদ সালাত
তাহাজ্জুদ নামাজ মুসলিম নর-নারী ও ইমানদারদের জন্য একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ নফল ইবাদত। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) নিয়মিত তাহাজ্জুদ সালাত আদায় করতেন। মূলত তাহাজ্জুদ নামাজের অপর নাম সালাতুল লাইল। তাহাজ্জুদ (تهجد) – অর্থ ঘুম থেকে জাগা। গভীর রাতে মহান আল্লাহ তা’আলা কে খুশি করার উদ্দেশ্যে ঘুম থেকে জেগে এ নামাজ আদায় করা হয় বলে একে তাহাজ্জুদ নামাজ বলা হয়। এটি একটি নফল ইবাদত, ফরজ নামাজের পর অন্যান্য সুন্নাত ও সকল নফল নামাজের মধ্যে তাহাজ্জুদ নামাজের গুরুত্ব ও ফজিলত সবচেয়ে বেশী।
পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ হওয়ার পূর্বে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) -এর উপর তাহাজ্জুদ নামাজ বাধ্যতামূলক ছিল। তাই তিনি জীবনে কখনো তাহাজ্জুদ নামাজ পড়া থেকে বিরত থাকেননি। তবে মুসলিম জাতির জন্য এ নামাজ সুন্নতে গায়রে মুয়াক্কাদা। অর্থাৎ তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ম অনুসারে এই নামাজ পড়লে অনেক ফজিলত পাওয়া যায়। তবে না পড়লে গুনাহ হবে না।
তাহাজ্জুদ নামাজ সুন্নত নাকি নফল
আলেমদের মতে, তাহাজ্জুদ নামাজের বিধান সুন্নতে গায়রে মুআক্কাদা বা নফল। ফরজ ছাড়া যত ইবাদত রয়েছে, সবই নফল ইবাদতের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। তাই আল্লাহ পাঁচ ওয়াক্ত সালাত কে ফরজ বলে ঘোষণা করেছেন। এ ছাড়া যত সালাত আছে, সব নফল বা অতিরিক্ত। সুতরাং নফল সালাত হুকুমের মধ্যে আসেনি।
অন্যদিকে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) পড়েছেন এই অর্থে তাহাজ্জুদ সালাত সুন্নত। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) -এর যেকোনো আমল আল্লাহর বান্দাগণ অনুসরণ করলে সেটা সুন্নাহ। সুন্নাহকে ওলামায়ে কেরামগণ হুকুমের (বিধানের) মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। রাসুল (সাঃ) -এর সুন্নাহ মূলত ২ প্রকার। একটি হলো, সেই সুন্নাহ যার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। অন্যটি হলো, অতিরিক্ত সুন্নাহ হিসেবে যে সুন্নাহ প্রমাণিত হয়েছে। তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ম অনুসারে এটি অতিরিক্ত সুন্নাহ পর্যায়ের সালাত।
তাই বলা যায়, যেহেতু ফরজ বা ওয়াজিব নয়, তাই এই সালাত নফল। বিপরীতে, যেহেতু রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আদায় করেছেন, সেহেতু এটি সুন্নাহ।
তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ত
যে কোন সালাতের নিয়ত মূলত মনের সাথে সম্পৃক্ত। সালাতে দাঁড়িয়ে মন থেকে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য বাংলাতেই তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ত করতে পারেন। তবে আমাদের দেশে এই সালাতের একটি প্রচলিত আরবি নিয়ত রয়েছে। যথা:
আরবী নিয়ত: “নাওয়াইতুয়ান উছাল্লিয়া লিল্লাহি তায়ালা, রাকআতা-ই ছালাতিল তাহাজ্জুদি সুন্নাতু রাসূলিল্লাহি তা’আলা মুতাওয়াজ্জিহান ইলা জিহাতিল; কাবাতিশ শারীফাতি আল্লাহু আকবর।
তাহাজ্জুদ নামাজের বাংলা নিয়ত
নিম্নোক্তভাবে বাংলাতে তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ত করতে পারেন:
বাংলা নিয়ত: আমি আল্লাহর ওয়াস্তে কিবলামুখী হয়ে তাহাজ্জুদের দুই রাকাত সুন্নত নামাজের নিয়ত করলাম। (অতঃপর ‘আল্লাহু আকবার’ বলে হাত বাঁধা)
তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ম
অন্যান্য সকল প্রকার নফল সালাতের মতোই তাহাজ্জুদ সালাতের নিয়ম ও অত্যন্ত সহজ এবং সাধারণ। অন্যান্য সালাতের মতই রুকু-সিজদাহ, সূরা-কেরাত পাঠ করে এই সালাত আদায় করতে হয়। পবিত্রতা অর্জনের করে নামাজের নামাজের আরকান-আহকাম মেনে তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করা অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ। নিচে তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ম সংক্ষিপ্ত আকার তুলে ধরা হলো:
- নামাজের নিয়ত করুন।
- তাকবিরে তাহরিমা “আল্লাহু আকবার” বলে হাত বাঁধুন।
- সানা পড়ুন।
- এবার সূরা ফাতেহা পাঠ করুন।
- সূরা ফাতেহার সাথে সূরা বা কেরাত পড়ুন। সম্ভব হলে তাহাজ্জুদ নামাজে বড় সূরা তিলাওয়াত করা উত্তম।
- অন্যান্য নামাজের ন্যায় রুকু ও সেজদা আদায় করুন। সম্ভব হলে দীর্ঘ রুকু, সিজদা করা উত্তম।
- রুকু-সিজদাহ এবং দুই সিজদার মাঝের বৈঠকে বেশি বেশি দোয়া করুন।
- ২য় রাকাত একই নিয়মে আদায় করুন।
- এবার, বৈঠকে বসে তাশাহহুদ, দরূদ ও দোয়া মাছুরা পাঠ করুন।
- তারপর সালাম ফেরানোর মাধ্যমে নামাজ সম্পন্ন করুন।
এভাবে দুই রাকাত দুই রাকাত করে তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করুন।
মহিলাদের তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ম
নারী-পুরুষের জন্য তাহাজ্জুদ সালাত আদায় করার নিয়ম অনুরূপ। উপরোক্ত নিয়মানুসারে মহিলারাও একইভাবে তাহাজ্জুদ সালাত আদায় করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারে।
তাহাজ্জুদ নামাজের সূরা
নির্দিষ্ট সূরা পড়া বাধ্যতামূলক নয় তাহাজ্জুদ নামাজে । সূরা ফাতেহার সাথে যেকোন সূরা মিলিয়েই তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করা যায়। তবে এ নামাজে লম্বা কেরাত পড়া উত্তম। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যথাসম্ভব লম্বা কেরাত, লম্বা রুকু ও সেজদা সহকারে একান্ত আন্তরিক মনে তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করতেন। দীর্ঘ কেরাত তিলাওয়াত করার ফলে নবী করিম (সাঃ) -এর পা ফুলে যেত। তিনি কখনো কখনো এক রাকাতে সূরা বাকারা সম্পূর্ণ তিলাওয়াত করতেন।(সুবহান আল্লাহ)। কেরাত উঁচু বা নিচু উভয় আওয়াজেই পড়া জায়েজ আছে তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ম অনুসারে।
তাহাজ্জুদ নামাজের সময়
এশার সালাতের পর থেকে সুবহে সাদিক/ ফজরের ওয়াক্ত শুরু হওয়ার আগে পর্যন্ত তাহাজ্জুদ সালাত আদায় করা যায়। তবে এর জন্য সর্বোত্তম সময় হলো রাতের এক-তৃতীয়াংশের শেষাংশে। মহানবী (সাঃ) কখনো মধ্য রাতে, কখনো তার কিছু আগে অথবা পরে ঘুম থেকে উঠতেন এবং আসমানের দিকে তাকিয়ে সূরা আলে-ইমরানের শেষ রুকুর কয়েক আয়াত পাঠ করতেন। তারপর মেসওয়াক ও অযু করে নামায পড়তেন।
এশার নামাজের পর ঘুমিয়ে যাওয়া ও মধ্যরাতে বা তার আগে-পরে উঠে নামাজ আদায় করা রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সুন্নত অনুসারে উত্তম। এতে মানুষের জৈবিক ঘুমের চাহিদাও পূর্ন হয় এবং সালাতুল লাইলও আদায় করা যায়। বর্তমান সময়ে বছরের বিভিন্ন সময়ভেদে রাতের প্রায় ২-৩ টায় ঘুম থেকে উঠে এ নামাজ আদায় করা উপযুক্ত। তবে তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ম অনুসারে, কেউ চাইলে এশার সালাতের পরও আদায় করতে পারে।
তাহাজ্জুদ নামাজ কত রাকাত | তাহাজ্জুদ নামাজের রাকাত সংখ্যা
তাহাজ্জুদ একটি নফল বা ঐচ্ছিক ইবাদত। তাই এর কোন বাধ্যতামূলক রাকাত সংখ্যা নেই। সামর্থ্য অনুযায়ী ২ রাকাত থেকে ১২ রাকাত পর্যন্ত তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করা যায়। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) তাহাজ্জুদ নামাজ দুই রাকাত দুই রাকাত করে আদায় করতেন। তিনি কখনো ৪ রাকাত, কখনো ৮ রাকাত এবং কখনো ১২ রাকাত পড়তেন সময় অনুযায়ী। সর্বনিম্ন ২ রাকাত আদায় করলেও তাহাজ্জুদ আদায় হবে।
হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি এশার পর দুই বা ততোধিক রাকাত নামাজ পড়ে নেয়, সে হবে তাহাজ্জুদের ফজিলতের অধিকারী।”
তাহাজ্জুদ নামাজের শেষ সময়
ফজরের ওয়াক্ত শুরু হওয়ার আগে পর্যন্ত তাহাজ্জুদ সালাত আদায় করা যায়। অর্থাৎ, ফজরের ওয়াক্ত শুরুর সময়ই তাহাজ্জুদ নামাজের শেষ সময়। তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ম অনুসারে শেষে বিতর নামাজ আদায় করা উত্তম। কারন, বিতর নামাজ হচ্ছে দিনের সর্বশেষ নামাজ। তবে রাতে এশার নামাজের পর বিতর নামাজ আদায় করে থাকলে তাহাজ্জুদ নামাজের পড় আদায় করতে হয় না। তাহাজ্জুদের পর বিতর সালাত বাকি থাকলে এবং ফজরের ওয়াক্তের সময় হয়ে গেলে ১ রাকাত বিতর নামাজও আদায় করা যায়।
তাহাজ্জুদ নামাজের দোয়া
নামাজ বা সালাত মানেই দোয়া। তাহাজ্জুদ সালাতের প্রতিটি অংশই আল্লাহর কাছে আমাদের দোয়া-প্রার্থনার অন্তর্ভুক্ত। তবে তাহাজ্জুদ সালাতের বাইরে ও ভিতরে কিছু বিশেষ ফজিলতপূর্ণ দোয়া রয়েছে, যা রাসূলুল্লাহ (সাঃ) পাঠ করতেন। এসকল দোয়াগুলোর মধ্যে কয়েকটি হলো:
তাহাজ্জুদ নামাজে দাঁড়িয়ে দোয়া
হজরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) রাতে তাহাজ্জুদের উদ্দেশ্যে যখন দাঁড়াতেন, তখন এ দোয়া পড়তেন:
اللَّهُمَّ لَكَ الْحَمْدُ أَنْتَ قَيِّمُ السَّمَوَاتِ وَالأَرْضِ وَمَنْ فِيهِنَّ وَلَكَ الْحَمْدُ، لَكَ مُلْكُ السَّمَوَاتِ وَالأَرْضِ وَمَنْ فِيهِنَّ وَلَكَ الْحَمْدُ أَنْتَ نُورُ السَّمَوَاتِ وَالأَرْضِ، وَلَكَ الْحَمْدُ أَنْتَ الْحَقُّ، وَوَعْدُكَ الْحَقُّ، وَلِقَاؤُكَ حَقٌّ، وَقَوْلُكَ حَقٌّ، وَالْجَنَّةُ حَقٌّ، وَالنَّارُ حَقٌّ وَالنَّبِيُّونَ حَقٌّ، وَمُحَمَّدٌ صلى الله عليه وسلم حَقٌّ، وَالسَّاعَةُ حَقٌّ، اللَّهُمَّ لَكَ أَسْلَمْتُ، وَبِكَ آمَنْتُ وَعَلَيْكَ تَوَكَّلْتُ، وَإِلَيْكَ أَنَبْتُ، وَبِكَ خَاصَمْتُ، وَإِلَيْكَ حَاكَمْتُ، فَاغْفِرْ لِي مَا قَدَّمْتُ وَمَا أَخَّرْتُ، وَمَا أَسْرَرْتُ وَمَا أَعْلَنْتُ، أَنْتَ الْمُقَدِّمُ وَأَنْتَ الْمُؤَخِّرُ، لاَ إِلَهَ إِلاَّ أَنْتَ ـ أَوْ لاَ إِلَهَ غَيْكَ
বাংলা উচ্চারণ: “আল্লাহুম্মা লাকাল হামদু আংতা কায়্যিমুস সামাওয়অতি ওয়াল আরদি ওয়া মান ফিহিন্না ওয়া লাকালহামদু। লাকা মুলকুস সামাওয়অতি ওয়াল আরদি ওয়া মান ফিহিন্না। ওয়া লাকাল হামদু আংতা নুরুস সামাওয়াতি ওয়াল আরদ। ওয়া লাকাল হামদু আংতাল হাক্কু। ওয়া ওয়া’দুকাল হাক্কু। ওয়া লিক্বাউকা হাক্কু। ওয়াল ঝান্নাতু হাক্কু। ওয়ান নারু হাক্কু। ওয়ান নাবিয়্যুনা হাক্কু। ওয়া মুহাম্মাদুন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা হাক্কু। ওয়াস সাআতু হাক্কু। আল্লাহুম্মা লাকা আসলামতু। ওয়াবিকা আমাংতু ওয়া আলাইকা তাওয়াক্কালতু। ওয়া ইলাইকা আনাবতু। ওয়া বিকা খাসামতু। ওয়া ইলাইকা হাকামতু। ফাগফিরলি মা কাদ্দামতু ওয়া মা আখ্খারতু। ওয়া মা আসরারতু ওয়া মা আ’লাংতু। আংতাল মুকাদ্দিমু ওয়া আংতাল মুআখ্খিরু। লা ইলাহা ইল্লা আংতা। লা ইলাহা গাইরুকা।” (বুখারি)
বাংলা অর্থ: “হে আল্লাহ! সব প্রশংসা আপনারই, আপনিই আসমান-জমিন ও উভয়ের মাঝে বিদ্যমান সব কিছুর নিয়ামক এবং আপনারই জন্য সব প্রশংসা। আসমান-জমিন এবং এর মাঝে বিদ্যমান সব কিছুর কর্তৃত্ব আপনারই। আপনারই জন্য সব প্রশংসা। আপনি আসমান-জমিনের নুর। আপনারই জন্য সব প্রশংসা। আপনি আসমান-জমিনের মালিক, আপনারই জন্য সব প্রশংসা। আপনিই চির সত্য। আপনার ওয়াদা চির সত্য। (পরকালে) আপনার সাক্ষাৎ সত্য। আপনার বাণী সত্য। আপনার জান্নাত সত্য। আপনার জাহান্নাম সত্য। আপনার (প্রেরিত) নবিগণ সত্য। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম সত্য, কেয়ামত সত্য। হে আল্লাহ! আপনার কাছেই আমি আত্মসমর্পণ করলাম, আপনার ওপর ঈমান আনলাম, আপনার ওপরই ভরসা করলাম, আপনার দিকেই রুজু করলাম, আপনার (সন্তুষ্টির জন্যই) শত্রুতায় লিপ্ত হলাম, আপনাকেই বিচারক মেনে নিলাম। তাই আপনি আমার আগের-পরের প্রকাশ্য ও গোপন সব পাপ/অপরাধ ক্ষমা করুন। আপনিই শুরু এবং আপনিই শেষ মালিক। আপনি ব্যতিত সত্য কোনো প্রকৃত ইলাহ নেই অথবা আপনি ব্যতিত (ইবাদতের উপযুক্ত) অন্য কেউ নেই।”
তাহাজ্জুদ নামাজের মাঝে দোয়া | তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ম
তাহাজ্জুদ নামাজ নফল ইবাদত হওয়ায় নামাজের মাঝে সিজদা ও অন্যান্য স্থানেও আল্লাহর কাছে বেশি বেশি সাহায্য প্রার্থনা করা যায়। এর মধ্যে অন্যতম একটি হলো নামাজে দুই সিজদার মাঝে বসে দোয়া পাঠ। হাদিস শরীফে এই সময়ের জন্য একটি বিশেষ দোয়ার উল্লেখ রয়েছে। এটি হলো:
বাংলা উচ্চারণ: “আল্লাহুম মাগফিরুলি, ওয়ার হামনি, ওয়াহ দ্বীনি, ওয়া আফিনি, ওয়ার জুকনি।”
বাংলা অর্থ: “হে আল্লাহ! আমাকে ক্ষমা করুন, আমার উপর রহমত বর্ষিত করুন, আমাকে হেদায়েত দান করুন, আমাকে সুস্থতা দান করুন, আমার রিজিকের ব্যবস্থা করুন।”
এই একটি দোয়ার মাধ্যমেই আল্লাহর কাছে সকল প্রকার সাহায্য চাওয়া যায়।
তাহাজ্জুদ নামাজের পর আমল | তাহাজ্জুদ নামাজের পর তাসবিহ
মহান আল্লাহ তা’আলা প্রতি রাতের শেষ প্রহরে বান্দাদেরকে ক্ষমা করার এবং তাদের দোয়া কবুল করার জন্য ডাকতে থাকেন। এ সময় আল্লাহর কাছে যত বেশি চাওয়া যায়, যত বেশি ক্ষমা প্রার্থনা করা যায় ততই ভালো। তাই রাতের শেষ প্রহরে তাহাজ্জুদ সালাত আদায় করার পাশাপাশি বেশি বেশি তাসবিহ তাহলিল পাঠ করা উচিৎ। আল্লাহর শুকরিয়া বাচক তাসবিহ, দুরূদ ও বিভিন্ন দোয়া পাঠ করার পাশাপাশি পবিত্র কোরআনের ফজিলতপূর্ণ আয়াতগুলোর উপরও আমল করতে পারেন।
নামাজ শেষে মোনাজাতের মাধ্যমে আল্লাহর সামনে সকল চাওয়া তুলে ধরা এবং দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে দোয়া করাও মুমিনদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ আমল।
তাহাজ্জুদ নামাজের হাদিস
মহানবী (সাঃ) তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ম সম্পর্কে বহুবার আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন এবং এর অনেক গুরুত্ব বর্ণনা করেছেন। এ সম্পর্কিত কয়েকটি বিখ্যাত হাদিস রয়েছে। যথা:
(১) মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) বলেন- “আল্লাহর নিকট অতি প্রিয় সালাত হলো দাউদ (আঃ) -এর সালাত। তিনি অর্ধেক রাত ঘুমাতেন এবং রাতের তৃতীয় ভাগে সালাতে দাঁড়াতেন আর ৬ষ্ঠ ভাগে আবার ঘুমাতেন।” (বুখারী, মুসলিম, মেশকাত)
(২) রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন- “মহান আল্লাহ তা’আলা প্রতি রাতে দুনিয়ার আসমানে নেমে আসেন যখন রাত্রের এক তৃতীয়াংশ বাকী থাকে। অতঃপর তিনি বলেন, তোমাদের কে আমাকে ডাকবে? আমি তার ডাকে সাড়া দেব! কে আমার কাছে কিছু চাইবে? আমি তাকে তা দেব! কে আমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবে? আমি তাকে ক্ষমা করে দেব!! (মুসলিম, মেশকাত)।
আরও পড়ুন: নামাযের গুরুত্বপূর্ণ মাসলা – মাসাইল ও প্রয়োজনীয় দো’আ
তাহাজ্জুদ নামাজের ফজিলত
তাহাজ্জুদ নামাজের ফজিলত অনেক বেশি। পবিত্র কোরআনেও সঠিকভাবে তাহাজ্জুদ সালাত আদায়ের তাগিদ করা হয়েছে। ফরজ সালাতের পর অন্যান্য সকল সুন্নাত ও নফল নামাযের মধ্যে তাহাজ্জুদ নামাজের ফজিলত সবচেয়ে বেশী। মহান আল্লাহ তা’আলা পবিত্র কুরআনে তাহাজ্জুদ নামাজ আদায়কারীদের মর্যাদা তুলে ধরেছেন। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু আয়াত হলো:
(১) “আল্লাহর প্রিয় বান্দা তারা, যারা তাদের রবের দরবারে সিজদা করে এবং দাঁড়িয়ে থেকেই রাত কাটিয়ে দেয়।”(সূরা আল ফুরকান, আয়াত: ৬৪)
(২) “তারা ছিল কঠিন পরীক্ষায় পরম ধৈর্যশীল, অটল-অবিচল, সত্যের অনুসারী, পরম অনুগত। আল্লাহর পথে ধন-সম্পদ উৎসর্গকারী এবং রাতের শেষ প্রহরে আল্লাহর কাছে ভুলত্রুটির ক্ষমাপ্রার্থী।” (সূরা আল ইমরান, আয়াত: ১৭)
তাহাজ্জুদ নামাজের গুরুত্ব বলে শেষ করা যায় না। তাহাজ্জুদ নামাজ আদায়কারী মুমিনদের ‘ইবাদুর রহমান’ বা রহমানের বান্দা বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। তাহাজ্জুদ আদায়কারী ব্যক্তি তাকওয়ার শক্তিতে বলীয়ান হয়। কিয়ামতের দিন তারা প্রশংসিত স্থানে অধিষ্ঠিত হবেন। এই নামাজ আদায়কারীদের আল্লাহ তা’আলা অনুগত বান্দা হিসেবে কোরআনে উল্লেখ করেছেন। এই নামাজ শরীর থেকে রোগ-ব্যাধি দূর করে। বিশেষ করে অলসতা আর অক্ষমতা হতে মুক্তি লাভ করা যায়।
তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ম অনুযায়ী আদায় করলে তা দুনিয়া ও আখিরাতের সার্বিক সফলতায় বড় অবদান রাখতে পারে।
৪০ দিন তাহাজ্জুদ নামাজের ফজিলত
তাহাজ্জুদ সালাত নিয়মিত আদায় করলে আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়া সম্ভব। টানা ৪০ দিন এই সালাত আদায় করলে আল্লাহ সেই বান্দার দোয়া কবুল করবেন, ঈন-শা-আল্লাহ। এই বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন- “কেউ যদি তার কোনো ইচ্ছা আল্লাহর কাছে পেশ করতে চায়, মহান আল্লাহর থেকে কিছু পেতে চায়, সে যেন টানা ৪০ দিন তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে তার ইচ্ছা চেয়ে নেয়। অবশ্যই অবশ্যই তার যেকোনো হালাল ইচ্ছা আল্লাহ তা’আলা কবুল করে নেবেন।” (সহিহ বুখারী)
তাই সঠিকভাবে তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ম মেনে নিয়মিত এই সালাত আদায়ের চেষ্টা করতে হবে।
সতর্কতা
তাহাজ্জুদ নামায শুরু করলে তা তরক করা অনুচিত; বরং যে ব্যক্তি যত রাক’আত তাহাজ্জুদ পড়া শুরু করবে তার জন্য ঐ রাক’আতের উপর আমল জারী রাখা উচিত। নামাযের রাক’আত সংখ্যা বৃদ্ধি করতে মানা নেই বরং উত্তম। কিন্তু কমের দিকে আসা বা ইচ্ছাপূর্বক তরক করা অবনতির লক্ষণ। যদি কোন রাতে তাহাজ্জুদ নামায ছুটে হয়ে যায় তা হলে পরের রাতে তা কাযা আদায় করে নেবে। বিশেষ কারণবশত তাহাজ্জুদ নামায আদায় করতে না পারলে কিবলামুখী হয়ে যিকির-আযকার, দুরূদ শরীফ পাঠ করলে তাকে তাহাজ্জুদ আদায়কারীদের অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য করা হবে।
তাহাজ্জুদ নামাযের জন্য রাতে উঠার কৌশল
শেষ রাতে তাহাজ্জুদের জন্য উঠার ব্যবস্থা হলো : (১) রাতে কম খাওয়া, (২) দিনের বেলায় অতিরিক্ত পরিশ্রম না করা, (৩) শেষ রাতে জাগরণের উদ্দেশ্যে দিনের বেলায় কিছু সময় ঘুমিয়ে নেয়া, এবং (৪) সর্বদা গুনাহের কাজ থেকে দূরে থাকা।
গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রশ্নের উত্তর FAQ’s
তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ত কিভাবে করতে হয়?
যে কোন সালাতের নিয়ত মূলত মনের সাথে সম্পৃক্ত। সালাতে দাঁড়িয়ে মন থেকে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য বাংলাতেই তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ত করতে পারেন।
তাহাজ্জুদ নামাজের জন্য কি ঘুম শর্ত?
রাতের শেষ তৃতীয়াংশে তাহাজ্জুদ নামায পড়া উত্তম। তাহাজ্জুদের মূল সময় মূলত রাত ৩.০০ টা থেকে শুরু হয়ে ফজরের আযানের আগ পর্যন্ত থাকে।
তাহাজ্জুদ নামাজ কি নফল না সুন্নত?
হযরত মা আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন। নবী করিম (সা:) বলেছেন, ৩ টি ইবাদত আমার উপর ফরয; কিন্তু তোমাদের (উম্মতের) উপর সুন্নাত। যথা : বিতর নামায পড়া, মিসওয়াক করা এবং তাহাজ্জুদের নামায পড়া। আর নফল নামায পড়া তো মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য। বিশেষ করে এই নফল ইবাদতের কারণে উম্মতে মুহাম্মদী -এর গুনাহসমূহ মাফ হয়ে যায় এবং ফরয ইবাদতসমূহের ত্রুটিসমূহের পরিপূরক হয়। যেমনটা হযরত কাতাদা (র.) ও মুজাহিদ (র.) বলেছেন, উম্মতের ন্যয় নবী কারীম এর উপরে এই তাহাজ্জুদের ইবাদতটিও মানসূখ (বাতিল) করে দেয়া হয়। বর্তমানে তাহাজ্জুদ নামাযটি নফলের পর্যায়ভুক্ত একটি আমল। এ কারণে আল্লাহ তা’আলা বলেছেন, এ আমলটি তোমাদের জন্য ‘নাফিলা’ অর্থাৎ অতিরিক্ত।”
তাহাজ্জুদ নামাজের জন্য কি ঘুম শর্ত?
রাতের শেষ তৃতীয়াংশে তাহাজ্জুদ নামায পড়া উত্তম। তাহাজ্জুদের মূল সময় মূলত রাত ৩.০০ টা থেকে শুরু হয়ে ফজরের আযানের আগ পর্যন্ত থাকে।
পড়ে নিন: রমজান মাসের প্রয়োজনীয় মাসলা মাসায়েল ও দোয়া সমুহ
শেষকথা
উপরোক্ত তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ম মেনে আদায় করে আমরা এই সালাতের ফজিলত পেতে পারি। মহান আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে সঠিক পথে চলার এবং সালাত ও অন্যান্য ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহ সন্তুষ্টি অর্জনের তৌফিক দান করুক, আমিন।