তাজমহল (Taj Mahal) হচ্ছে পশ্চিম-উত্তর প্রদেশের আগ্রার এক রাজকীয় সমাধির নাম। এটি বিশ্বের সপ্তম আশ্চর্যের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। এটি আগ্রা শহরের পূর্ব দিকের যমুনা নদীর দক্ষিণ তীরে অবস্থিত। এই বিশ্ব ঐতিহ্যের সর্বজনীন শ্রেষ্ঠ কর্ম হিসেবে এটি বিবেচিত হয়। এই স্থাপনায় রয়েছে ইসলামিক, ফারসি ও ভারতীয় স্থাপত্বের এক অপূর্ব মিশ্রণ। ভালোবাসার অবিশ্বাস্য ও স্মরণীয় একটি ভাস্কর্য। প্রেমিক যুগলদের কাছে শান্তি ও সৌন্দর্যের প্রতীক আগ্রার তাজমহল টি ভালোবাসার নিদর্শন হিসেবে পরিচিত।
আগ্রার তাজমহল এর সবচেয়ে আকর্ষনিও বৈশিষ্ট হচ্ছে সমাধির ওপরে মার্বেল পাথরের গম্বুজ। গম্বুজের ওপরের দিকে একটি পদ্মফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে। পদ্ম ফুলের কারণে গম্বুজের উচ্চতাকে আরো দৃষ্টিনন্দন করেছে। এই মহলটি নির্মাণ করতে সে সময়ে আনুমানিক ৩২ মিলিয়ন রুপী খরচ হয়েছে বলে ধারণা করা হয়।তাই এখানে যুগ যুগ ধরে আকর্ষণীয় নিদর্শন এই মহলটি দেখতে ও এর ইতিহাস জানতে অসংখ্য পর্যটক প্রতিদিন এখানে এসে ভিড় জমায়।
তাজমহল সম্পর্কিত সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
মুঘল সম্রাট শাহজাহান এই অপূর্ব সমাধিসৌধটি নির্মাণ করেছিলেন তার দ্বিতীয় স্ত্রী আরজুমান্দ বানু বেগম (মমতাজ) কে উৎসর্গ করে। সম্রাট শাহজাহান তার স্ত্রী কে এতটাই ভালোবাসতেন যে, তার সম্রাজ্যের যে কোনো কাজেরই সঙ্গী বানাতেন তার স্ত্রীকে। এমনকি তার স্ত্রীকে সামরিক অভিযানের সময় ও বাদ রাখতেন না। ১৬৩০ সালে মমতাজ তার চতুর্দশ কন্যা জন্ম দেয়ার সময় মৃত্যুবরণ করেছিলেন। মমতাজের মৃত্যুর পর থেকেই সম্রাট শাহজাহান তিনি অনেক বেশি ভেঙে পড়েছিলেন। তারপর তিনি তার স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসার নিদর্শন স্বরূপ হিসেবে এই মহল নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত নেন।
১৬৩২ খ্রিস্টাব্দে আগ্রার তাজমহল এর নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছিল এবং ১৬৫৩ খ্রিস্টাব্দে শেষ হয়েছিল। এই মহলটি নির্মাণ করতে ২২ বছর সময় লেগেছিল। এই মহলটির নির্মাণ কারিগর নিয়ে অনেক ধরনের সমস্যা থাকলেও এটি মূলত ওস্তাদ আহমেদ লাহুরীর তত্ত্বাবধানে প্রায় ২০ হাজার জন শ্রমিক, অটোম্যান সাম্রাজ্য, ইউরোপের কারিগর পারস্য ও সুনিনিপুন নকশাকার ও মুঘল স্থাপত্য অনুসারে এই মহলটি নির্মাণ করেন। ১৯৮৩ সালে ইউনেস্কো কর্তৃক বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে তালিকাভুক্ত হয় মোগল স্থাপত্যের নিদর্শন এই মহলটি। সম্রাট শাহজাহান মমতাজের জন্য যে নিদর্শন তৈরী করেছেন তা আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে আর কেউ করতে পারেনি।
তাজমহলে যা যা দেখার রয়েছে
এই মহলটি প্রায় ৪২ একর জায়গা জুড়ে অবস্থিত। প্রধানত এই মহলটি পাঁচটি ভাগে বিভক্ত – প্রধান প্রবেশদ্বার, মসজিদ, বাগান, অতিথিশালা ও চারটি মিনার সম্মিলিত সম্রাঞ্জি মমতাজের সমাধিসৌধ। এর মূল চত্বরটি দুর্গের মত তিন দিক থেকে প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। প্রাচীরের বাইরে শাহজাহানের অন্যান্য স্ত্রীদের সমাধি দেওয়া হয়েছে এবং মমতাজ এর প্রিয় পরিচারিকাদের ও সমাধি দেয়া হয়েছে।প্রাচীরের ভিতরের দেয়াল গুলো নকশা খচিত। এখানে সবগুলো প্রাচীর গম্বুজ আকৃতির একটি স্থাপত্য গড়ে তোলা হয়েছে, বর্তমানে এই স্থাপত্য টিকে জাদুঘর হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। মুঘল স্থাপত্য ও নকশা খচিত আগ্রার তাজমহলের প্রধান প্রবেশদ্বার মার্বেল পাথরের তৈরী। মূল চত্বরের দুটি পৃথক স্থাপনায় রয়েছে মুঘল অতিথিশালা জাওয়াব ও লাল রঙের মসজিদ।
মহলের সামনের চত্বরে রয়েছে একটি “চারবাগ”। উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা ১৬ টি আলাদা ফুলের বাগান,বিভিন্ন গাছ গাছালিতে ভরা রাস্তা ও কিছু সুন্দর ঝর্ণা রয়েছে। এই বাগানটি স্বর্গের বাগান হিসেবে পরিচিত। প্রধান গেটের মাঝামাঝি অংশ ও সমাধি অংশে একটি মার্বেল পাথরের চৌবাচ্চা রয়েছে এবং এর পানিতে মহলের প্রতিফলিত রূপ দেখা যায়। তাজ-মহলের ভিতরে পিট্রা দুরা কৌশল ব্যবহার করে মূল্যবান পাথরের জ্যামিতিক ও ফুলের নকশায় পবিত্র কুরআনের আয়াত সুন্দর ভাবে খোদাই করা হয়েছে।
সমাধির ভিতরের অন্দরমহলে অষ্টভুজাকৃতির খোদাই করা অর্ধ বৃত্তাকার মার্বেল পাথর দিয়ে সাজানো। এই জায়গায় সম্রাট শাহজাহান ও তার স্ত্রী মমতাজের সমাধিস্থল। যদিও এগুলো শুধু ডামি সমাধি যা সূক্ষ্ম তারের কারুকারযে মন্ডিত মার্বেলের এক ধরনের পর্দা দিয়ে আবৃত। ডামি সমাধি স্থলের ৮০ ফুট নিচে ভাস্কর্য শিল্পে অলংকৃত শিলালিপিতে সমন্বিত রয়েছে তাদের প্রকৃত সমাধি। পূর্ণিমার সময় যখন চাঁদের আলো প্রতিফলিত হয় তখন চারপাশে এক অপার্থিব পরিবেশের সৃষ্টি হয়।
প্রচলিত আছে যে,শেষ সময়ে সম্রাট শাহজাহান যমুনা নদীর তীরে আগ্রার তাজমহলের বিপরীতে আরেকটি তাজ-মহল নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন যা বর্তমানে “কালা তাজ-মহল” নামে পরিচিত। এখান থেকে সূর্যের ও চাঁদের আলোয় মহলের বিভিন্ন পরিবর্তিত অপরূপ সৌন্দর্য দেখা যায়। কালো মার্বেল দিয়ে তৈরি করা এই দুর্গ ব্রিজের মাধ্যমে মহলের সাথে সংযুক্ত।
আগ্রা ফোর্ট ভ্রমণ
আগ্রার তাজমহল থেকে এক মাইল দূরে যমুনা নদীর ডান দিকে আগ্রা ফোর্ট অবস্থিত। সেখানে যেতে সময় লাগে ১৫ থেকে ২০ মিনিট। এখানে প্রবেশ মূল্য ৮০ রুপি। তবে মূল গেট থেকে প্রবেশের সময় ৫০ রুপির একটি টিকিটের সাথে আরেকটি বুথ থেকে ৩০ রুপির সংযুক্ত টিকেট নিয়ে নিতে হবে তারপরে ভিতরে প্রবেশ করতে পারবেন। আপনারা চাইলে এই মহল ভ্রমণ করার পাশাপাশি আগ্রা ফোর্ট ও ভ্রমন করে আসতে পারেন। আগ্রা ফোর্ট ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃত। মুঘল আমলে এটি সেনাদের দূর্গ ছিল। পরবর্তীতে সম্রাট শাহজাহানের নেতৃত্বে রাজ পরিবারের বাসস্থানের সাথে সাথে রাজকীয় নানা কর্মকান্ডের সাথে সম্পর্কিত এই স্থানটি।
এখানেই স্ম্রাট শাহজাহান দীর্ঘ ৮ বছর বন্দি অবস্থায় ছিলেন তার সন্তান আওরঙ্গজেবের হাতে। এখানেই প্রিয়তমা মমতাজের কবরের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ আটটি বছর কাঁদতে কাঁদতে চিরনিদ্রা শায়িত হন সম্রাট শাহজাহান। এই দুর্গের ভেতরে রয়েছে খাসমহল, শিশমহল,মুহাম্মান বুর্জ,মোতি মসজিদ ও নাগিনা মসজিদ উল্লেখযোগ্য।
তাজমহল কিভাবে যাবেন
বিভিন্ন মাধ্যমে বিভিন্ন উপায়ে আগ্রার তাজমহল যাওয়া যাবে। বাংলাদেশ থেকে সড়ক পথে ভারতের এই মহলে যেতে চাইলে ঢাকার কল্যাণপুর থেকে বাসের টিকেট কেটে নিন। কলকাতা পৌঁছে সেখান থেকে সবচেয়ে দ্রুতগামী ট্রেন রাজধানী এক্সপ্রেস এর টিকেট কেটে নিন, এই ট্রেনের মাধ্যমে গেলে নিউ দিল্লি রেল স্টেশন নামিয়ে দিবে। এছাড়াও আরো অন্যান্য ট্রেনের টিকেট আপনি চাইলে কাটতে পারেন যেমন কালকা মেল যা আপনাকে নামিয়ে দিবে দিল্লির পুরাতন রেলস্টেশনে, ইউভা এক্সপ্রেস যা আপনাকে নিয়ে যাবে দিল্লি আনন্দবিহার রেলস্টেশন।
এছাড়াও আরো অনেক ট্রেন রয়েছে যেগুলো কলকাতা থেকে দিল্লি পর্যন্ত যাতায়াত করে। তারপর দিল্লির রেলস্টেশন থেকে ট্রেনে বা বাসে করে আপনি আগ্রা যেতে পারবেন। হযরত নিজামুদ্দিন রেলওয়ে স্টেশন ও দিল্লি রেলওয়ে স্টেশন থেকে ট্রেনে করে আগ্রা যেতে সময় লাগবে দেড় থেকে দুই ঘন্টা। আর বাসে করে আগ্রা যেতে সময় লাগবে ৩ থেকে সাড়ে তিন ঘন্টা। আর প্লেনে করে যেতে চাইলে বাগডোগরা থেকে দুই ঘন্টার জার্নি করে দিল্লি যেতে পারবেন সেখান থেকে বাসে বা ট্রেনে করে আগ্রা যেতে পারবেন।
আরও পড়ুন: আজকের ট্রেনের সময়সূচী
আগ্রার তাজমহল ভ্রমণ খরচ
বাংলাদেশ থেকে ট্রেনে করে দিল্লি যেতে ১৫০০ – ৩২০০ রুপি খরচ হবে। বিমানে করে যেতে চাইলে বিমানের খরচ পরবে ২৮০০ – ৪০০০ রুপি। যানবাহনের উপর নির্ভর করে দিল্লি থেকে আগ্রা যেতে খরচ পড়বে ৫০০ – ১২০০ রূপির মতো। এশিয়ার বাইরে থেকে আগত পর্যটকদের প্রবেশ টিকেট মূল্য ১০০০ রুপি। বাংলাদেশীদের জন্য তাজ-মহলের প্রবেশ টিকেট মূল্য জনপ্রতি ৫১০ রুপি। আর ভারতীয়দের জন্য প্রবেশ টিকেট মূল্য জনপ্রতি ৫০ রুপি।
কোথায় থাকবেন
আগ্রাতে কম খরচের মধ্যে রয়েছে সাই প্যালেস, টুরিস্ট রেস্ট হাউস, হোটেল সাফারি, দা আগ্রা গ্রান্টে,রে অফ মায়া, থমাস হোমস্টে, মাক্স গেস্ট হাউস, সেভেন হিলস টাওয়ারের মত হোটেল ও রেস্ট হাউস গুলোতে দুই জনের থাকার রুম ৬০০ থেকে ১৫০০ টাকার মধ্যে পাওয়া যায়। আপনারা চাইলে এই হোটেল গুলোতে অল্প খরচের মাধ্যমে থাকতে পারবেন।
ভ্রমন টিপস
★ মহলে প্রবেশের সময় আপনার পাসপোর্ট সাথে রাখুন।
★ গ্রীষ্মকালীন সময়ে খুব গরমে আগ্রাতে না যাওয়াই ভালো, নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত আগ্রাতে যাওয়ার জন্য ভালো সময়।
★ তাজ-মহলে প্রবেশের সময় এক বোতল পানি দেয়া হয়, এই পানি ছাড়া আগ্রার তাজমহলের ভিতরে অন্য কোন খাবার নিয়ে প্রবেশ করা যায় না।
★ শুক্রবার তাজ-মহলে জুম্মার নামাজ পড়ানো হয় তাই সেদিন এখানে প্রবেশ নিষেধ।
★ একদিন পুরো সময় নিয়ে আগ্রাতে রাতে থেকে মহল ঘুরে আসবেন তাহলে ভালোভাবে সবকিছু দেখতে পারবেন।
★ বসন্ত ও পূর্ণিমার রাতে মহলের অলৌকিক সৌন্দর্য দেখার সুযোগ হলে তা কখনোই মিস করবেন না তাহলে পরবর্তীতে আফসোস করতে হবে।
★ তাজ-মহলের এন্ট্রি টিকেট দেখিয়ে আগ্রা ফোর্টে ঢুকলে ৩০ রুপি খরচ হবে নয়তো আলাদাভাবে ৫০০ রুপির টিকেট কেটে ঢুকতে হবে।
★ ঘুরতে গিয়ে সেখানকার পরিবেশ নষ্ট করবেন না, পানির বোতল,চিপসের প্যাকেট ও অপচনশীল দ্রব্য নির্ধারিত স্থানে ফেলুন।
আগ্রার তাজমহল সম্পর্কে সচারচর জিজ্ঞাসিত প্রশ্নোত্তর (FAQ’s)
তাজমহল দর্শন করতে যেতে কত টাকা লাগে?
তাজমহল দর্শন করতে যেতে চাইলে যাতায়াত খরচ, তাজমহল প্রবেশ মূল্য, থাকার খরচ, খাবার খরচ ও আনুষাঙ্গিক অন্যান্য খরচ মিলিয়ে ১০,০০০-১৫,০০০ টাকা লাগতে পারে।
তাজমহল কেন নির্মান করা হয়েছিলো?
সম্রাট শাহজাহান তার দ্বিতীয় স্ত্রী আরজুমান্দ বানু বেগম (মমতাজ) কে অনেক ভালোবাসতেন। ১৬৩০ সালে মমতাজ তার চতুর্দশ কন্যা জন্ম দেয়ার সময় মৃত্যুবরণ করেছিলেন। তারপর সম্রাট শাহজাহান তার স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসার নিদর্শন স্বরূপ হিসেবে এই মহলটি নির্মাণ করেছিলেন।
তাজমহল কোথায় অবস্থিত?
ভারতের উত্তর প্রদেশে আগ্রায় অবস্থিত?
আগ্রার তাজমহল কে নির্মাণ করেন?
শম্রাট শাহজাহান।
বাংলাদেশের তাজমহল কোথায় অবস্থিত?
রাজধানী ঢাকা থেকে ১০ মাইল পূর্বে পেরাব, সোনারগাঁওয়ে অবস্থিত।
শেষ কথা
আগ্রার তাজমহল শম্রাট শাহজাহান তার ভালবাসার নিদর্শন স্বরুপ নির্মাণ করেন। নির্মাণের পর থেকে সারা পৃথিবী থেকে প্রতিদিন হাজার হাজার দর্শনার্থী এই তাজমহল দেখতে আসেন।