বাংলাদেশের রংপুর শহরের মাহীগঞ্জের তাজহাট জমিদার বাড়ি অবস্থিত। জমিদার বাড়িটি একটি ঐতিহাসিক জাদুঘর হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এই জমিদার বাড়িটি রংপুর শহরের জিরো পয়েন্ট থেকে ৬ কিলোমিটার দূরে দক্ষিণ পূর্ব দিকে অবস্থিত।
তাজহাট জমিদার বাড়ির ইতিহাস
অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে রত্ন ব্যবসায়ী মান্নালাল ব্যবসায়িক কারণে মাহিগঞ্জে এসে বসবাস করেন এবং পরবর্তীতে তিনি জমিদারি প্রতিষ্ঠা করেন। জমিদার মান্নালাল এর মৃত্যুর পর তার দত্তক পুত্র গোপাল রায় বাহাদুর জমিদারি পরিচালনা শুরু করেন। এই জমিদার বাড়িটি বিংশ শতাব্দীর শুরুতে প্রায় ২০০০ রাজমিস্ত্রির নিরলস পরিশ্রমের ফলে পূর্ণতা লাভ করে। ১৯১৭ সালে তৎকালীন সময়ে প্রায় দেড় কোটি টাকা খরচ হয় এই জমিদার বাড়িটি সম্পূর্ণ নির্মাণ করতে।তাজহাট জমিদার বাড়ি টি নির্মাণ করতে সময় লেগেছিল প্রায় দশ বছর। জমিদার গোপাল রায় পেশায় ছিলেন একজন স্বর্ণকার।
১৯৯৫ সালে বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ সংরক্ষিত স্থাপনা হিসেবে ঘোষণা করেন। বাংলাদেশ সরকার ঐতিহাসিক প্রাসাদের গুরুত্ব অনুধাবনের জন্য ২০০৫ সালে রংপুর যাদুঘর কে স্থানান্তরিত করে জমিদার বাড়ির দ্বিতীয় তলাতে নিয়ে আসেন। তাজহাট প্রাসাদ চত্বরে রয়েছে সারি সারি গাছ ও বিশাল মাঠ এবং প্রাসাদের দুই পাশে রয়েছে দুইটি পুকুর। জাদুঘরের প্রবেশের জন্য নির্দিষ্ট মূল্য পরিষদ করে ঢুকতে হবে।
জমিদার বাড়ির সিড়িগুলো মার্বেল দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। দ্বিতীয় তলাতে জাদুঘরে উঠলেই রয়েছে বেশ কয়েকটি প্রদর্শনী কক্ষ যাতে রয়েছে সংস্কৃত ও আরবি ভাষায় লেখা বেশ কিছু পান্ডুলিপি। এখানে রয়েছে দশম ও একাদশ শতাব্দীর টেরাকোটার শিল্পকর্ম। এর মধ্যে রয়েছে মোঘল সম্রাট আওরাঙ্গজেবের সময়ের কোরআন সহ মহাভারত ও রামায়ণ এবং পিছনের ঘরে রয়েছে বেশ কয়েকটা কালো পাথরের হিন্দু দেবতা বিষ্ণুর প্রতিকৃতি। জাদুঘরে এগুলো ছাড়াও আরো ৩০০ টি মূল্যবান প্রতিকৃতি রয়েছে। এই জাদুঘরের ভিতরে ছবি তোলার নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। জমিদার বাড়ির চত্বরে গাড়ি নিয়ে ঢুকতে হলে নির্দিষ্ট ফি দিয়ে ঢুকতে হবে।
তাজহাট জমিদার বাড়ি এর গঠনশৈলী
জমিদার বাড়িটি চারতলা সমান উঁচু এবং ২১০ ফুটের মতো প্রশস্ত। এই জমিদার বাড়িটির সিঁড়ি গুলো বাংলাদেশের অন্য সকল প্রাসাদ থেকে আলাদা। জমিদার বাড়িতে সর্বমোট ৩১ টি সিঁড়ি রয়েছে যার প্রত্যেকটি ইতালিয়ান ঘরানার মার্বেল পাথরের তৈরি। সিঁড়ি থেকে জাদুঘর পর্যন্ত মেঝের পুরোটাই একই পাথরের তৈরি। এ রাজ বাড়ির পশ্চাৎ ভাগে রয়েছে গুপ্ত সিঁড়ি। সেখানকার লোকমুখে শোনা যায় যে, এই সিঁড়ি গুলো কোন একটি সুরঙ্গের সাথে যুক্ত আছে যা কিনা সরাসরি ঘাঘট নদীর সাথে যুক্ত। নিরাপত্তা জনিত কারণে এই গুপ্ত সিঁড়ি টা বর্তমানে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
এই তাজহাট জমিদার বাড়ি টির গঠনশৈলী দেখে মনে হয় যে, প্রাচীন মোঘল স্থাপত্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তৈরি করা। যার কারণ হলো মধ্যভাগে বিশাল একটি গম্বুজ ও দুই পাশে ছড়িয়ে যাওয়া বিশাল দালান গুলোর একটি মসজিদের অবয়ব থেকে । কালের বিবর্তনের ফলে প্রাসাদের অনেক কিছুই বদলে গেছে। প্রাসাদের সেই সুন্দর ফোয়ারাটি শ্বেতশুভ্র মার্বেল পাথর ও তার সবুজের নকশা অনেকটাই নষ্ট হয়ে গিয়েছে। তবে এখনো প্রাসাদের জৌলুস বোঝা যায়। কথিত আছে যে, এই প্রাসাদ টিকে রাণীর জন্য নির্মাণ করা হয়েছিল।
তাজহাট জমিদার বাড়ির অবকাঠামো
জমিদার বাড়িটি পূর্ব দিকে মুখ করে এর অবস্থান, প্রাসাদের সম্মুখ ভাগ দুই তলা বিশিষ্ট প্রায় ৭৬ মিটার। জমিদার বাড়ির মাঝখানে রয়েছে একটি আকর্ষণীয় প্রশস্ত সিঁড়ি। ইতালি থেকে আমদানি করা সাদা মার্বেল পাথর দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল এই সিঁড়ি গুলো। বারান্দা থেকে সরাসরি সিঁড়িটি উপরের তলায় নিয়ে যায়।
এই প্রাসাদ টিতে দুটি তলায় মিলে সর্বমোট প্রায় ২২ টির মতো কামড়া রয়েছে। খোলা প্রান্ত হতে পশ্চিম প্রান্ত পর্যন্ত প্রাসাদটি “u” আকৃতির নকশা তৈরি করে। প্রাসাদের মধ্যে খুব বড় একটি হল রয়েছে প্রাসাদের প্রবেশ পথের বাইরের নিচ তলায়। হলের পরিমাপ হলো ১৮×১৩ মিটারের ও বেশি। ভিতরের অংশে একটি ৩ মিটারের চওড়া গলি রয়েছে। আর উপরের তলায় ওঠার জন্য দুটি প্রশস্ত কাঠের সিঁড়ি রয়েছে।
প্রাসাদটির ছাদের মাঝখানে রয়েছে একটি অষ্ট ভুজাকার গম্বুজ। আধা সরু স্তম্ভ গুলোর একটি সাড়ি রয়েছে যেগুলো প্রাসাদটিকে দৃঢ়তা প্রদান করে। তাজহাট জমিদার বাড়ি এর প্রাসাদ টির সামনের দিকে প্রতিটি প্রান্তে দুটি করে অষ্টভুজাকার এবং কেন্দ্রীয় একটি সাজানো বারান্দা রয়েছে।
জমিদার বাড়িটি দেখতে ঢাকা আহসান মঞ্জিলের মতো। জমিদার বাড়ির চত্বরে রয়েছে বিশাল মাঠ, সারি সারি গাছ ও প্রাসাদের দুই পাশে দুইটি পুকুর। এখানে রয়েছে বিভিন্ন রকম ফুল ও ফলের বাগান। জমিদার বাড়িটি লাল ইট, শ্বেত ও চুনা পাথর, মার্বেল পাথর দ্বারা নির্মিত তৃতীয় ও চতুর্থ তলায় জমিদার গোপাল রায়ের ব্যবহৃত অনেক কিছু রাখা রয়েছে। এছাড়া এখানে রয়েছে থাকার কক্ষ, অতিথিদের জন্য কক্ষ ও গোসলখানা।
তাজহাট জমিদার বাড়ি ও জাদুঘর পরিদর্শনের সময় সূচি
জমিদার বাড়ি ও জাদুঘর সপ্তাহের প্রতি রবিবার দিন বন্ধ থাকে এবং সোমবার দিন অর্ধেক দিনের জন্য বন্ধ থাকে। সরকারি ছুটির দিন গুলোতে জাদুঘরের পরিদর্শন করা বন্ধ থাকে। গ্রীষ্মকালীন ও শীতকালীন সময়ে পরিদর্শনের সময়সূচি পরিবর্তন হয় ।
গ্রীষ্মকালীন সময়ে অর্থাৎ এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত এই জমিদার বাড়ি তথা রংপুর জাদুঘর সকাল ১০ টা থেকে সন্ধ্যা ৬ টা পর্যন্ত পরিদর্শনের জন্য খোলা থাকে। আর শীতকালীন সময়ে অর্থাৎ অক্টোবর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত সকাল ৯ টা থেকে সন্ধ্যা ৫ টা পর্যন্ত পরিদর্শনের জন্য খোলা থাকে। রংপুর জাদুঘর খোলার দিন গুলোতে দুপুর ১ টা থেকে ১:৩০ মিনিট পর্যন্ত খাবারের বিরতির বন্ধ থাকে।
তাজহাট জমিদার বাড়ি ও রংপুর জাদুঘর প্রবেশ টিকেট মূল্য
বাংলাদেশি প্রাপ্তবয়স্ক সকল নাগরিকের জন্য তাজহাট জমিদার বাড়ি ও রংপুর জাদুঘর প্রবেশ টিকেট মূল্য ২০ টাকা। ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য ডিসকাউন্টে জমিদার বাড়িতে প্রবেশ করার টিকিট মূল্য ৫ টাকা। আর পাঁচ বছরের কম বয়সের বাচ্চাদের জন্য কোন টিকেট কাটতে হয় না। সার্ক ভুক্ত দেশের দর্শনার্থীদের জন্য টিকেট মূল্য ১০০ টাকা এবং বিদেশি পর্যটকদের জন্য টিকেট মূল্য ২০০ টাকা।
কিভাবে যাবেন
রাজধানী ঢাকার গাবতলী, কল্যানপুর, মোহাম্মদপুর এবং মহাখালী থেকে আল হামরা ট্রাভেলস, মিম, গ্রীন লাইন, এস আর বাস রংপুরের পথে চলাচল করে। এসব বাসে করে রংপুর যেতে জন প্রতি ভাড়া লাগে ৬০০ থেকে ১০০০ টাকা। জমিদার বাড়িতে যেতে রংপুর বাস স্ট্যান্ড থেকে মাত্র ২০ টাকা রিক্সা ভাড়া লাগে। আর ঢাকা থেকে কুড়িগ্রাম গামী বাসে গেলে সরাসরি জমিদার বাড়ির সামনে নামা যায়।
কোথায় থাকবেন
তাজহাট জমিদার বাড়ি দর্শন করতে গেলে রংপুর শহরে থাকার জন্য বিভিন্ন মানের আবাসিক হোটেল রয়েছে। এ হোটেল গুলোতে এসি এবং নন এসি রুম রয়েছে। একটু খোঁজাখুঁজি করে আপনার পছন্দমত হোটেলের রুম ভাড়া করে আপনি রাত্রি যাপন করতে পারবেন। আবাসিক হোটেল গুলোর মধ্যে কিছু উল্লেখযোগ্য হোটেল গুলো হলো-
হোটেলের নাম | ফোন নাম্বার |
দি পার্ক হোটেল | 0521- 65920 |
হোটেল নর্থ ভিউ | 0521- 55406 |
হোটেল পর্যটন মোটেল | 0521- 62111 |
হোটেল কাশপিয়া | 0521- 61111 |
হোটেল তিলোত্তমা | 0521- 63402 |
হোটেল গোল্ডেন টাওয়ার | 0521- 65920 |
কোথায় খাবেন
রংপুরের এই জমিদার বাড়ি দর্শন করতে গেলে রংপুর শহরে বিভিন্ন মানের খাবারের হোটেল ও রেস্টুরেন্ট রয়েছে। আপনি চাইলে সেখান থেকে খাবার খেয়ে নিতে পারেন। অথবা যে আবাসিক হোটেলে উঠবেন সেখানে ও খাবারের ব্যবস্থা থাকে চাইলে সেখান থেকেও খেতে পারবেন। রংপুরে আমের সিজনে গেলে রংপুরের বিখ্যাত হাড়িভাঙ্গা আম খেতে ভুলে যাবেন না অবশ্যই খেয়ে দেখবেন।
আরও পড়ুন: গুঠিয়া মসজিদ-বরিশাল, এখন পর্যটকের প্রধান আকর্ষন।
জমিদার বাড়ি সম্পর্কিত সচরাচর জিজ্ঞাসিত প্রশ্নোত্তর (FAQ’s)
তাজহাট জমিদার বাড়ি কোথায় অবস্থিত?
রংপুর শহরের মাহীগঞ্জে জমিদার বাড়িটি অবস্থিত।
রংপুরের তাজহাট জমিদার বাড়ি কত সালে নির্মাণ করা হয়?
১৯১৭ সালে প্রায় ২০০০ রাজমিস্ত্রির পরিশ্রমে এবং প্রায় দেড় কোটি টাকা খরচ করে তাজা জমিদার বাড়ি নির্মাণ করা হয়।
পরিশেষে
ইতিহাস ঐতিহ্য প্রেমিরা প্রতিনিয়ত এসকল দর্শনীয় স্থান সমূহ ভ্রমন করে থাকেন। আপনিও চাইলে রংপুর তাজহাট জমিদার বাড়ি ভ্রমন করতে পারেন। উপরের দেওয়া সকল তথ্য সঠিক ও নিভূলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, তারপরও জমিদারবাড়ি ভ্রমনের পূর্বে বর্তমান সময়ের গাড়িভাড়া ও খাবারের মূল্য জেনে নিবেন, যেহেতু এগুলো সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তন হতে পারে।