তওবা করার দোয়া: তাওবা মানে হলো ক্ষমা প্রার্থনা করা। ইস্তিগফার একটি স্বতন্ত্র ইবাদত; কোনো গুনাহ বা পাপ করার পর অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর দরবারে মাফ চাওয়ার জন্য এই ইবাদত করা হয় না। যেমন: আবশ্যকীয় ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নত ও নফল ইবাদত দ্বারা গুনাহ মাফ হয়; কিন্তু এসব ইবাদত করার জন্য গুনাহ বা পাপকরা শর্ত নয়।
তওবা ও ইস্তিগফার আল্লাহ তাআলার নিকট অতি পছন্দনীয় একটি ইবাদত। তাই আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) নিষ্পাপ (যার ৬৩ বছরের জিন্দেগীতে কোন গুনাহ নাই) হওয়া সত্ত্বে ও প্রতিদিন ৭০ থেকে ১০০ বার তওবা ও ইস্তিগফার করতেন। অনুরূপ আমাদের ইমান আনার পর নামাজ প্রধান ও সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত হওয়া সত্ত্বেও ফরজ নামাজ আদায়ের পর ৩ বার ইস্তিগফার পড়া সুন্নত। অর্থাৎ তাওবা ইস্তিগফার শুধু পাপকাজের পরে নয়, যে কোন ইবাদতের পরেও করা হয়।
যেমন হজ্বের পর ইস্তিগফার করা বিষয়ে কোরআন মজিদে উল্লেখ আছে, ‘(হজ শেষে) তারপর তোমরা বেরিয়ে পড়ো, যেভাবে মানুষ চলে যাচ্ছে এবং আল্লাহ তায়ালার নিকট ক্ষমা চাও। নিশ্চয়ই আল্লাহ তা’আলা ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ১৯৯)।
মানুষ মাত্রই ভুল। পৃথিবী সৃষ্টির আদিকাল থেকে আদম সন্তানের প্রায় সকলেই ভুল-ভীতি ও গুনাহের ঊর্ধ্বে নয়। তন্মধ্যে আল্লাহ তাআলা তওবাকারীকে ভালোবাসেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রতিদিন ৭০ বারের অধিক তওবা ও ইস্তিগফার করতেন। (বুখারি)। তাই নিয়ম মেনে তওবা করার দোয়া ও আমল সকল মুসলমানদের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ।
মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তওবার দোয়া খোলা থাকে। মৃত্যু কখন আসে তা বলা যায় না। তাই ইস্তিগফার সমূহ সর্বদাই পাঠ করা উচিত। এই পোস্টে বিভিন্ন তওবা করার দোয়া ও ইস্তিগফার সমূহ তুলে ধরা হলো-
আসতাগফিরুল্লাহ দোয়া আরবী বাংলা
মহান আল্লাহর কাছে তওবা করার সবচেয়ে ছোট ইস্তিগফারটি হলো:-
আরবি: أَسْتَغْفِرُاللهَ
বাংলা উচ্চারণ: “আস্তাগ-ফিরুল্লা-হ।”
বাংলা অর্থ: “আমি আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি।”
রাসুলুল্লাহ (সাঃ) প্রতি ওয়াক্ত ফরজ সালাতের সালাম ফেরানোর পর এই ইস্তিগফারটি ৩ বার পড়তেন। (মিশকাত)
আমরাও খুব সহজেই নবীজির আদর্শ অনুযায়ী এবং দিনের বিভিন্ন ছোট বড় কাজের পাশাপাশি এই তওবা করার দোয়া পাঠ করতে পারি।
তওবা করার দোয়া, আমল ও নিয়ম
তওবার বিভিন্ন দোয়া সমূহের মধ্যে নবীজির শেখানো অন্যতম একটি দোয়া হলো-
আরবি: أَسْتَغْفِرُ اللهَ وَأَتُوْبُ إِلَيْهِ
বাংলা উচ্চারণ: “আস্তাগ-ফিরুল্লাহা ওয়া আতূ’বু ইলাই’হি।”
বাংলা অর্থ: “আমি আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি ও তাঁর দিকেই ফিরে আসছি।”
তওবা করার দোয়া
তওবার বিভিন্ন দোয়া সমূহের মধ্যে অন্যতম একটি ইস্তিগফার হলো:-
আরবি: رَبِّ اغْفِرْ لِيْ وَتُبْ عَلَيَّ إِنَّكَ أنْتَ التَّوَّابُ الرَّحِيْمُ
বাংলা উচ্চারণ: “রাব্বিগ ফির্-লী, ওয়া তুব আলাইয়্যা, ইন্নাকা আনতাত্ তাওয়া-বুর রাহীম।”
বাংলা অর্থ: “হে আমার রব! আপনি আমাকে ক্ষমা করুন এবং আমার তাওবাকে কবুল করুন। নিশ্চয় আপনি মহান তাওবা কবুলকারী, করুণাময়।”
রাসুলুল্লাহ (সাঃ) মসজিদে বসে এক বৈঠকেই এ দোয়া ১০০ বার পাঠ করেছেন। (তিরমিজি, মিশকাত, আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ)
সাইয়্যেদুল ইস্তিগফার
আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়ার জন্য সবচেয়ে বড় তওবা করার দোয়া ও ইস্তিগফার হলো সাইয়্যেদুল ইস্তিগফার। এই ইস্তিগফারটি অনেক বেশি ফজিলতপূর্ণ।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন- “যে ব্যক্তি দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে সকালে সাইয়্যেদুল ইস্তিগফার পাঠ করবে, সে ব্যক্তি ঐ দিন মৃত্যুবরণ করলে জান্নাতে প্রবেশ করবে। যে ব্যক্তি সন্ধ্যায় দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে সকালে সাইয়্যেদুল ইস্তিগফার পাঠ করবে, সে ব্যক্তি ঐ রাতে মৃত্যুবরণ করলে জান্নাতে প্রবেশ করবে।”
সাইয়্যেদুল ইস্তিগফারটি হলো:-
আরবি: اللَّهُمَّ أَنْتَ رَبِّي لَا إِلَهَ إِلَّا أَنْتَ خَلَقْتَنِي وَأَنَا عَبْدُكَ وَأَنَا عَلَى عَهْدِكَ وَوَعْدِكَ مَا اسْتَطَعْتُ أَعُوذُ بِكَ مِنْ شَرِّ مَا صَنَعْتُ أَبُوءُ لَكَ بِنِعْمَتِكَ عَلَيَّ وَأَبُوءُ لَكَ بِذَنْبِي فَاغْفِرْ لِي فَإِنَّهُ لَا يَغْفِرُ الذُّنُوبَ إِلَّا أَنْتَ
বাংলা উচ্চারন: “আল্লা-হুম্মা আনতা রাব্বি। লা-ইলাহা ইল্লা আনতা। খালাক্বতানি ওয়া আনা আব-দুকা। ওয়া আনা আলা আহ-দিকা। ওয়া ওয়া’দিকা মাস-তাত্বা’তু। আ’উযু বিকা মিন শাররি মা সানা’তু। আবুয়ু লাকা বিনি’মাতিকা আলাইয়্যা। ওয়া আবুয়ু লাকা বি জাম্বি। ফাগ-ফিরলী ফা ইন্নাহু লা ইয়াগফিরুজ জুনুবা ইল্লা আনতা।”
বাংলা অর্থ: “হে আল্লাহ! শুধুমাত্র আপনিই আমাদের প্রতিপালক। আপনি ব্যতীত আর কোনো ইলাহ্ নেই। আপনিই আমার সৃষ্টিকর্তা এবং আমি আপনারই দাস। আমি আপনার সঙ্গে কৃত ওয়াদা ও অঙ্গীকারের ওপর সাধ্যানুযায়ী অটল ও অবিচল রয়েছি।
আমি আমার কৃতকর্মের সব অনিষ্ট হতে আপানার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা চাইছি। আমার উপর আপনার দানকৃত সব নেয়ামতের স্বীকার করছি। আমি আমার সব গুনাহ স্বীকার করছি। অতএব, আপনি আমাকে মাফ করে দিন। কেননা, আপনি ছাড়া আর কেউ গুনাহ মাফ করতে পারবে না।”
আরও পড়ুন: দ্রুত বিবাহের দোয়া ও আমল। তাড়াতাড়ি বিয়ে হওয়ার আমল
তওবার দোয়া
রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর শেখানো অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ আরেকটি তওবা করার দোয়া রয়েছে। প্রতি রাতে ঘুমানোর পূর্বে তিনবার এই ইস্তিগফার পাঠ করলে ঐ ব্যক্তির সমস্ত গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়।
ইস্তিগফারটি হলো-
আরবি: أَسْتَغْفِرُ اللهَ (الْعَظِيْمَ) الَّذِيْ لَا إِلٰهَ إِلَّا هُوَ الحَيُّ الْقَيُّوْمُ وَأَتُوْبُ إِلَيْهِ
বাংলা উচ্চারণ: “আস্তাগ-ফিরুল্লা-হাল (আযীমাল্) লাযী, লা ইলাহা ইল্লা হুআল হাইয়্যুল কাইয়্যুমু ওয়া আতূবু ইলাই-হি।”
বাংলা অর্থ: “আমি মহান আল্লাহ তায়ালার ক্ষমা প্রার্থনা করছি, যিনি ছাড়া কোনো মাবুদ নেই। তিনি চিরঞ্জীব ও সর্ব সংরক্ষক এবং তাঁর কাছে তাওবা করছি।”
ইস্তিগফার দোয়া বাংলা উচ্চারণ
হাদিস অনুযায়ী শিখানো আরেকটি তওবা করার দোয়া ও ইস্তিগফার হলো-
বাংলা উচ্চারণ: সুবহানাকা ওয়াবি হামদিকা আসতাগফিরুকা ওয়াআতুবু ইলাইক।’
বাংলা অর্থ: ‘পবিত্র মহান আল্লাহ এবং সব প্রশংসা তাঁরই প্রাপ্য, আমি তোমার কাছে সব পাপের জন্য ক্ষমা চাই ও তাওবা করি।’
ইস্তিগফার সম্বন্ধে কোরআন ও হাদিছে বানী
ক. সুরা নূহ এর ১০ নং আয়াতে আছে : ‘তোমরা তোমাদের সৃষ্টিকর্তারি কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো, নিশ্চয়ই তিনি মহাক্ষমাশীল।
খ. সুরা নাসর এর ০৩ নং আয়াতে বলা হয়েছে: অতঃপর তোমার রবের প্রশংসা সহ পবিত্রতা বর্ণনা করো এবং তাঁর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করো।
গ. সুরা আনফাল এর ৩৩ নং আয়াতে বলা হয়েছে : আর আল্লাহ তাআলা আজাব দেবেন না তাদের, আপনি তাদের মাঝে থাকা অবস্থায়; আর আল্লাহ তাদের আজাব দেবেন না, যখন তারা ইস্তিগফার করে।
ঘ. ইস্তিগফার সম্পর্কে সিয়ারে কাবির, তাবরানিতে আছে : রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে যত বেশি মুমিন বান্দার জন্য ইস্তিগফার করবে, সে তাদের সবার সমপরিমাণ নেকি লাভ করবে।
ইস্তিগফার এর ফজিলত
তওবা ও ইস্তিগফারের অনেক উপকারিতা রয়েছে। নিয়মিত ইস্তিগফার পাঠ করলে ব্যক্তির আখিরাতে সফলতা অর্জন হয়। দুনিয়াতেও আল্লাহর রহমত ও নেয়ামত বৃদ্ধি পায়। এসব উপকারিতার অন্যতম হলো-
- আল্লাহ তওবাকারীকে ভালবাসেন।
- ইস্তিগফারকারীকে আল্লাহ তায়ালা উত্তম সন্তান, সম্পদ ও জীবিকা দান করেন।
- আল্লাহ ও বান্দার মাঝে দূরত্ব কমে যায়।
- ইস্তিগফারকারীর কাছে আল্লাহর পক্ষ থেকে দুনিয়াকে খুব তুচ্ছজ্ঞান করে দেওয়া হয়।
- দ্বীন ও ঈমানের স্বাদ আস্বাদন করা যায়।
- অন্তরের নূর বৃদ্ধি পায় ও ইবাদতের স্বাদ বৃদ্ধি পায়।
- আখিরাতের স্মরন বাড়বে ও মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকা যায়।
- বিশ্বাস ও বিচক্ষণতা বৃদ্ধি পায়।
- দুশ্চিন্তা ও পেরেশান থাকলে তা দূর হয়।
- মৃত্যুর সময় ফেরেশতারা তার জন্য সুসংবাদ নিয়ে আসে।
- হাশরের মাঠে ইস্তিগফারকারী থাকবে আরশের ছায়াতলে।
- কিয়ামাতের দিন ইস্তিগফারকারী ডানপন্থী মুত্তাকিনদের দলে থাকবে।
- ডান হাতে আমলনামা পাবে।
- আরশ বহনকারী ফেরেশতারাও তওবাকারীর জন্য দোয়া করেন।
তাই আমাদের বেশি বেশি তওবা করার দোয়া ও আমল এবং ইস্তিগফার পাঠ করতে হবে।
শেষকথা
তওবাকারীকে মহান আল্লাহ তায়ালা ‘মুস্তাজাবুত দাওয়া’ বানিয়ে দেন। তিনি তওবাকারীর সকল দোয়া কবুল করেন ও নাজ-নেয়ামত বাড়িয়ে দেন। তাই আমরা নিয়মিত ফরজ,সুন্নত আমলের পাশাপাশি তওবা করার দোয়া পাঠ ও আমল করবো, ঈন-শা-আল্লাহ।