তেহরান- ঐতিহাসিক ইরানের রাজধানী

ইরান, এটা প্রচুর সংস্কৃতি মণ্ডিত একটি দেশ। দেশটির রাজধানী তেহরান। এখানে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের লোকাচার, সংস্কৃতি, রেওয়াজ, লোকগান। ইরানিদের ভাষা ফার্সি। ফার্সি সাহিত্য খুবই সমৃদ্ধ ও অনেক প্রাচীন। মধ্য এশিয়া থেকে শুরু করে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত ফার্সি ভাষার প্রভাব রয়েছে। বাংলা ভাষাতে তো ফারসি শব্দের অভাব নেই। এখনো অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ফার্সি ভাষা যত্নসহকারে শিক্ষা দেওয়া হয়। আসুন ফার্সির দেশ ইরান ভ্রমণ করে আসি।

“শক্কর শিকন শওন্দ হমা তুতিয়ান-এ-হিন্দ।

যি কন্দ-এ-ফারসী কে বঙ্গালা মী রওদ॥
হাফিয যে শওক-এ-মজলিসে-এ-সুলতান গিয়াস্‌দীন।
গাফিল ম-শও কে কারে তু আয নালা মি রওদ॥”

“ফার্সির এই মিছরিখণ্ড (গজল) যা বাংলায় যাচ্ছে,
এটা নিয়ে ভারতের তোতারা (কবিরা) সবাই মিষ্টিমুখ হবে।।

হাফেজ! সুলতান গিয়াস উদ্দিনের মজলিসের উদ্দীপনা নিয়ে উদাসীন বসে থেকো না,
কারণ ক্রন্দন দিয়েই তোমার কার্য সিদ্ধ হবে।।”

এটা চৌদ্দ শতকের সুলতান গিয়াস উদ্দিন আজম শাহ এর উদ্দেশ্যে পারস্যের মহাকবি হাফেজ শিরাজের লেখা গজল। হাফেজ শিরাজকে ইরানিরা ‘বুলবুল-এ-শিরাজ’ উপাধি দিয়েছে। ইরানিদের কাছে এই হাফেজ শিরাজ খুবই সম্মানীয় একজন কবি। আর সেই কবি আমাদের বঙ্গভূমিকে নিয়ে কবিতা লিখেছে। এর থেকে প্রমাণ হয় ইরানের সাথে আমাদের সম্পর্ক অতি প্রাচীনকাল থেকে চলে আসছে।

ঢাকায় অবস্থিত ইরানি এম্বাসিতে গিয়ে টুরিস্ট বা জিয়ারত ভিসা আবেদন ফরম পূরণ করলে খুব সহজেই ইরানি ভিসা পেয়ে যাবেন। ইরানিরা বাংলাদেশিদের ভিসা নিয়ে অতটা জটিলতা সৃষ্টি করে না। হিজরি মহরম ও সফর মাসে অনেক বাংলাদেশি ইরান ভ্রমণ করে। এই সময় সারা বিশ্ব থেকে শিয়াগণ ইরানে আগমন করেন। কেননা শিয়া মাযহাবের প্রাণকেন্দ্র হচ্ছে ইরানের কোম শহর। এই সময়টাতে আপনি যদি চান তাহলে উৎসবমুখর একটি পরিবেশ দেখতে পাবেন। তবে হোটেল ভাড়া একটু বাড়তি লাগতে পারে।

ফ্লাইট

ইরান যাওয়ার সবচেয়ে সস্তা ফ্লাইট হচ্ছে Air Arabia. সাধারণত যাওয়া ও আসার ফ্লাইট ভাড়া সত্তুর থেকে আশি হাজার টাকা হয়ে থাকে। তবে আমিরাত এয়ারলাইন্সে ভাড়া অনেক বেশি। Air Arabia আরব আমিরাত হয়ে তারপর তেহরানের ইমাম খোমেনি এয়ারপোর্টে অবতরণ করবে।

টিপসঃ এয়ারপোর্টে গিয়েই আপনি ভ্রমণ ইন্সুরেন্স করে ফেলবেন। এয়ারপোর্টে ইন্সুরেন্স করার ব্যবস্থা রয়েছে। এই ইন্সুরেন্স করার ফলে আপনার অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা ঘটলে অর্থনৈতিক সাহায্য পাবেন। এটা খুবই জরুরী।

সতর্কতা

আপনি যদি ভ্লগার হন অথবা শখের বসে ভিডিও করে থাকেন তাহলে একটি বিষয়ে খুব সতর্ক থাকবেন। এয়ারপোর্টে কখনোই ভিডিও করবেন না। এছাড়া ইরানের রাস্তাঘাটে ডিএসএলআর অথবা ডিজিটাল ক্যামেরা দিয়ে ভিডিও করা যাবে না। মোবাইল দিয়ে যত খুশি ভিডিও করুন সমস্যা নেই।
ইরানি প্রশাসন দেশের নিরাপত্তা নিয়ে খুব সচেতন। কেননা বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশগুলো সর্বদা ইরানের ক্ষতি করার চেষ্টায় থাকে।
এই দিকগুলো বাদ দিলে ইরানিরা অনেক বন্ধুত্বপূর্ণ। ওরা মানুষকে খুব সহজেই আপন করে নেয়।

হোটেল

তেহরানে অনেক ভালো ভালো হোটেল রয়েছে। কোনটা রেখে কোনটা উঠবেন সেটা নিয়ে আপনি দ্বিধা দ্বন্দ্বে ভুগতে পারেন। তাই আপনাদেরকে একটি হোটেলের থাকার পরামর্শ দিচ্ছি।

হোটেলটির নাম Razzaz Boutique Hotel.
এটার ফোন নম্বর +982136833892

কেন এই হোটেলটার পরামর্শ দিচ্ছি? এই হোটেলটা তৈরি করা হয়েছে ইরানি রাজকীয় ঐতিহ্যকে সামনে রেখে। এটার ভেতর যদি আপনি প্রবেশ করেন তাহলে আপনার মনে হবে যেন মোগল দরবারে হাজির হয়েছেন। বিভিন্ন রঙের দারুন সব মোজাইক ব্যবহার করা হয়েছে দেওয়ালে। সেই সাথে আছে ক্যালিওগ্রাফিতে লিখা ফার্সি কবিতা। যেগুলোর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতেই মন চায়। জানালার শার্শিগুলো রঙিন কাঁচের তৈরি। সকালের সূর্যালোক যখন এই রঙিন কাঁচ ভেদ করে ঘরে প্রবেশ করে, তখন পুরো ঘর রংবেরঙের আলোয় ঝকঝক করতে থাকে।

এই হোটেলটা অত্যন্ত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। এমনিতেও ইরান খুবই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন একটি দেশ।
হোটেলে রয়েছে ব্যুফে। সেখানে রয়েছে বিভিন্ন পদের সুস্বাদু লোভনীয় সব খাবার।
এছাড়া এই হোটেলটা ইরানের গ্র্যান্ড বাজার, মেট্রো স্টেশন ও গুলিস্তান প্যালেসের নিকটে।

তেহরানের দর্শনীয় স্থান

তেহরানে এতসব দর্শনীয় স্থান রয়েছে যে সেগুলো এক সপ্তাহ ঘুরেও শেষ করতে পারবেন না। তবুও আপনাদের জন্য কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক দর্শনীয় স্থানের বর্ণনা দিচ্ছি।

আজাদি মিনার

ভারতের যেমন রয়েছে ইন্ডিয়া গেট। তেমনি ইরানের রয়েছে আজাদি মিনার। এটা সেই স্মৃতিস্তম্ভ যেখানে ইমাম খোমেনী ইসলামি বিপ্লবের ঐতিহাসিক সমাবেশ করেছেন। অবশ্য এটা নির্মাণ হয়েছিল ১৯৭১ সালে পেহেলভি রাজ বংশের আড়াই হাজার বছর পূর্তি উপলক্ষে। অবশেষে সেই রাজ বংশের পতন ঘটে ইমাম খোমিনির হাত ধরে ১৯৭৯ সালে।

এর নিচে রয়েছে অনেক সুন্দর জলের ফোয়ারা এবং ভূগর্ভস্থ জাদুঘর।
এই মিনারটি ১৪৮ ফুট উঁচু। এক ব্যক্তি কোনো প্রকার নিরাপত্তা সামগ্রী ছাড়াই এই মিনারটির চূড়ায় উঠতে চেষ্টা করেছিলো। কিন্তু মাত্র তিন মিটার অবশিষ্ট থাকতে ক্লান্ত হয়ে জমিনে পড়ে মারা যায়।

গ্র্যান্ড বাজার

এটাকে ইরানিরা বাযার-এ-বুযুর্গ বলে ডাকে। এই বাজারটি এত লম্বা যে আপনি তিন দিনের ঘুরেও শেষ করতে পারবেন না। কোনো জাতিকে যদি চিনতে হয় তবে বাজারে গিয়ে তাদের পর্যবেক্ষণ করতে হয়। ইরানিরা এমনিতে অনেক সৎ। ওদের দেশে সাধারণত বিদেশি পর্যটক কম আসে। তাই কোনো বিদেশি পেলে খুবই আন্তরিকতা দেখায়।

বাজারে কী কী কিনবেন?

জাফরানের জন্মভূমিতে এসেছেন আর জাফরান কিনবেন না তা কি হয়! ইরানে পাবেন একদম খাঁটি জাফরান। আমাদের দেশে তো খাবারে ভেজাল মেশানো যেন একটি আবশ্যিক কাজ। কিন্তু ওদের ওখানে কোনো ভেজাল পাবেন না। জাফরানের দাম তুলনামূলকভাবে ওখানে একটু কম। এছাড়া রয়েছে ড্রাই ফ্রুটের আখড়া। এত এত ড্রাই ফ্রুট, যা দেখে আপনার মাথা চক্কর দিয়ে উঠবে। পেস্তা, কাজু, কাঠবাদাম, জয়তুন, অলিভ তো তাদের নিত্যদিনের খাবার। এছাড়া রয়েছে বিভিন্ন ফ্লেভারের চা।

তাদের ওখানে মিষ্টান্ন বলতে হালুয়া বোঝায়। বিভিন্ন ধরনের বাদাম দিয়ে সেই সকল হালুয়া তৈরি। স্বাদে যেন অমৃত। ওরা প্রতিটি মিষ্টান্নতে জাফরান ব্যবহার করে। এইজন্য খাবারগুলো এত রাজকীয়। খাবারের খুশবু আপনাকে মাতোয়ারা করে ফেলবে।

ইরানের কার্পেট জগৎ বিখ্যাত। সেখানে অনেক দামি দামি কার্পেট বিক্রি হয়। এছাড়া আছে পিতল বা কাঁসার বিভিন্ন তৈজসপত্র। যেগুলোর মনকারা নকশা অনন্য।

চমৎকার তথ্য

ইরানিরা আপনাকে দেখলে ‘সালাম’ শব্দটি উচ্চারণ করবে। আপনি হয়তো তখন ভাববেন, কী ব্যাপার এরা আমাকে ‘আস-সালামু আলাইকুম’ না বলে শুধু ‘সালাম’ বলছে কেন! আসলে ইরানের রেওয়াজ এমনই। ওরা সাধারণত সবাইকে সালাম বলে।

এছাড়া ওরা খুবই কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে। দেখবেন কথায় কথায় তারা শুকরান বা শুকরিয়া শব্দটি উচ্চারণ করে।

গুলিস্তান প্যালেস

১৬ শতকে কাজার সাম্রাজ্যের সময়কালে এই প্রাসাদ নির্মিত হয়েছে। ১৮ শতকে এটি সংস্কার করা হয়েছিল এবং সবশেষে ১৮৬৫ সালে পুনঃর্নির্মিত করা হয়। এটি তেহরানের সাবেক সরকারি রাজকীয় কাজার কমপ্লেক্স। বর্তমানে এটি একটি জাদুঘর
এর ভেতরে এত সুন্দর সুন্দর নিদর্শন আছে যা দেখে আপনি হতভম্ব হয়ে যাবেন। এর মধ্যে একটি হলো তখত-এ-মারমার অর্থাৎ মার্বেল পাথরের সিংহাসন। যেটা তৈরি করা হয়েছে মার্বেল পাথর খোদাই করে। যার আকৃতি বিশাল এবং সিংহাসন ধরে রেখেছে কতগুলো মানুষ্য মূর্তি। এত নিখুঁত শিল্পকর্ম যা আপনাকে ভাবিয়ে তুলবে।

ভেতরে রয়েছে ইয়া বড় বড় ঝাড়বাতি। কাঁচের চুমকি বসানো বিশাল বড় হল রুম। রয়েছে বিশাল আকৃতির গম্বুজ। যেগুলো বিভিন্ন নকশী মোজাইক দ্বারা আবৃত। এগুলো দেখলে আপনার মাথা ঘুরে যাবে।

সিপাহসালার মসজিদ

এটা ১৮৭৯ সালে নাসের আল দীন শাহের প্রধানমন্ত্রী মির্জা হোসেন সিপাহসালার এর আদেশে নির্মাণ হয়। যদিও ইসলামিক বিপ্লবের সময় এর নাম শহীদ মুতাহারা রাখা হয়। কিন্তু এখনো এটা সিপাহসালার মসজিদ নামেই পরিচিত। এর নজরকারা ক্যালিওগ্রাফি করা দেওয়াল, সুউচ্চ মিনার আপনার মন ভুলিয়ে দেবে। স্বর্গীয় এক শান্তি অনুভব করবেন। এখানে নারী-পুরুষ উভয়ই নামাজ পড়তে পারে।

নওরোজ

আপনি যদি মার্চ মাসের শেষ দিকে ভ্রমণ করেন, তাহলে আপনি ইরানিদের সাথে তাদের নববর্ষ উদযাপন করতে পারবেন। ইরানিরা ২১ মার্চ নওরোজ পালন করে। নওরোজ পারস্য বর্ষপঞ্জির নববর্ষ। পার্সি পুরাণ মতে এটা সম্রাট জামশেদ শুরু করে।
ওই দিন ইরানি শিশুরা সুন্দর সুন্দর পোশাক পরে। ঘর ফুল দিয়ে সাজায়। রাস্তা ও বাড়ির আঙিনায় আলোকসজ্জা করে। সেদিন তারা বিভিন্ন প্রকার হালুয়া বানায়। কোরমা পোলাও তো রয়েছেই।
বিভিন্ন প্রকার খাবার তারা ‘হাফতে সিন’
-এ সাজিয়ে রাখে।
‘হাফতে সিন’ হচ্ছে ‘সিন’ (س) দিয়ে শুরু হয় এমন সাত প্রকার খাবার টেবিলে সাজানো।
সেব (আপেল), সিরকা, সামানু (হালুয়া), সোমাক (সুগন্ধি মশলা), সির (রসুন), সেঞ্জেদ (বড়ই) ও
সবজি। এর সাথে অবশ্য আরও অনেক খাবার সাজায়।
ইসলাম পূর্ব যুগে নওরোজ ছিল ‘হাফতে শিন(ش)’ অর্থাৎ শিন হরফ আছে এমন সব খাবার টেবিলে স্থান পেত। এরমধ্যে শিন দিয়ে শারাব তথা মদও ঠাঁই পেত টেবিলে। কিন্তু ইসলাম আসার পর শিন থেকে নুকতা উঠে সিন হয়ে যায় এবং এর সাথে মদও টেবিল থেকে বিদায় নেয়।
এখন টেবিলে কুরআন জায়গা করে নিয়েছে।

ইরানি মুদ্রা

ইরানি মুদ্রার নাম ইরানি রিয়াল। যা বাংলাদেশি টাকার চেয়েও মূল্য অনেক কম। ওরা রিয়ালের চেয়ে ‘টোমান’ শব্দটি বেশি ব্যবহার করে। দশ ইরানি রিয়াল সমান এক টোমান।

আরও পড়ুন: ঢাকার দর্শনীয় ঐতিহাসিক স্থানসমূহ

শেষ কথা

ইরান খুবই সুন্দর একটি দেশ। কিন্তু এই দেশ সম্পর্কে আমরা খুব কম ধারণা রাখি। মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশ থেকে খুবই সস্তায় ইরান ভ্রমণ করা যায়। তেহরানে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য ঐতিহাসিক স্থাপত্য ও নিদর্শন। যেগুলোর সবগুলো এত ছোট লেখায় বর্ণনা করা সম্ভব নয়। তাই এখানেই সমাপ্ত। লেখা শেষ করতে চাই একটি ফার্সি গজল দিয়ে।

نمی دانم کہ آخر چوں دم دیدار می رقصم

“নামি দানাম কেহ্ আখির চুঁ দাম-এ-দিদার মি রাকসাম”
আমি জানি না, শেষ সাক্ষাতের সময় কেন আমি নৃত্য করছি।

من آں بسمل کہ زیر خنجر خونخوار می رقصم

“মান আম বিসমিল কেহ্ যের-এ-খঞ্জর-এ-খুনখার মি রাকসাম”
আমি ওই আত্মঘাতী, যে রক্তপিপাসু খঞ্জরের নিচে নৃত্য করছি।

زہے تقویٰ کہ من با جبہ و دستار می رقصم

“যাহে তউকভে কেহ্ মান বা জুব্বা-ও-দস্তর মি রাকসাম”
কী সুন্দর ধর্মানুরাগ! আমি জুব্বা ও পাগড়ি পড়ে নৃত্য করছি।

منم آں قطر شبنم بنوک خار می رقصم

“মানাম আঁ কাতরা-এ-শবনম বা-নক-এ-খার মি রাকসাম”
আমি ওই শিশির বিন্দু, যে কাঁটার অগ্রভাগে নৃত্য করছি।

কালামঃ খাজা উসমান হারুনী
অনুবাদঃ হৃদয় মৃধা।