২০ শতকের শুরুর দিকে, পৃথিবীর সবচেয়ে বৃহৎ আধুনিক ও বিলাসবহুল যাত্রীবাহী জাহাজ ছিল টাইটানিক (Titanic)। বর্তমান সময়ে এসেও পৃথিবীর বৃহত্তম জাহাজের কথা ভাবলেই সর্বপ্রথম মনে পড়ে যায় টাইটানিকের কথা। তবে মহাসমুদ্রের কাছে এই বিশাল জাহাজটিও ছিল বালুকণার মতোই। তাইতো প্রথম যাত্রাতেই সমুদ্রে নিমজ্জিত হয়েছিল টাইটানিক। টাইটানিক জাহাজের ইতিহাস, নির্মান, নামকরণ, গঠন, ধারনক্ষমতা ও যাত্রীদের সুযোগ-সুবিধা, সমুদ্রে নিমজ্জিত হওয়ার বিস্তারিত তথ্য জানতে পারবেন এই লেখাতে।
টাইটানিক জাহাজের নামকরণ
বিশাল আকার টাইটানিক (Titanic) এর নামকরণ করা হয় “টাইটান” শব্দ থেকে। গ্রিক পুরানের শক্তিশালী একজন দেবতার নাম ছিল ‘টাইটান’। তার নামানুসারে এই জাহাজের নামকরণ করা হয়েছিল ‘টাইটানিক’। এই নামটি জাহাজটির সংক্ষিপ্ত নাম। এর পুরো নাম ছিল ‘রয়্যাল মেল শীপ টাইটানিক’ (RMS Titanic)।
টাইটানিক জাহাজ নির্মানের ইতিহাস
টাইটানিক জাহাজের ইতিহাস অনুযায়ী, ১৯০৭ সালে জাহাজটির নির্মাণ কাজ শুরু করা হয়। জন পিয়ারপন্ট মরগান নামক একজন মার্কিন ধনকুবের এবং ইন্টারন্যাশনাল মার্কেন্টাইল মেরিন কোং এর অর্থায়নে কাজ শুরু হয়। একটানা ৫ বছর কাজ করে ১৯১২ সালে জাহাজটির কাজ শেষ হয়।
ইংল্যান্ডের ‘হোয়াইট স্টার লাইন’ এই জাহাজটি নির্মাণ করেন। ৬০ হাজার টন ওজন এবং ২৭৫ মিটার দৈর্ঘ্য বিশিষ্ট জাহাজটি নির্মাণ করতে সে সময় খরচ হয়েছিল প্রায় ৭.৫ মিলিয়ন ডলার (৭৫ লাখ ডলার)। যা বর্তমান সময়ে ১৬৫ মিলিয়ন ডলার।
টাইটানিক জাহাজের আয়তন কত?
এই জাহাজের ডিজাইন করেছিলেন “থমাসএন্ডুর”। “থমাস এন্ডুর” এই জাহাজটিকে এমন ভাবে ডিজাইন করেছিলেন যে, এটি যেকোনো ধরণের ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের মধ্যে দিয়েও সমুদ্রে চলতে পারবে।
পানি থেকে জাহাজটির ডেকের উচ্চতা ছিল ৫৯ ফিট (১৮মিটার), এর দৈর্ঘ্য ছিল প্রায় ৮৮২ ফুট ২ ইঞ্চি (প্রায় ২৬৯.১ মিটার) এবং এর প্রস্থ ছিল প্রায় ৯২ ফুট (২৮ মিটার)। এ জাহাজটির ওজন ছিল প্রায় ৪৬৩২৮ লং টন। বহন ক্ষমতা ছিল ৫২,৩১০ টন।
টাইটানিক জাহাজের আভিজাত্যতা ও ধারন ক্ষমতা
টাইটানিক জাহাজের ইতিহাস অনুযায়ী, জাহাজটি সর্বোচ্চ ৩ হাজার ৫৪৭ জন যাত্রী এবং ক্রু বহন করতে পারত। ফার্স্ট ক্লাস যাত্রীদের জন্য ছিলো বিলাসবহুল ডাইনিংয়ের ব্যবস্থা। যেখানে এক সাথে প্রায় ৫৫০ জন খাবার খেতে বসতে পারতো।
এর অভ্যন্তরে ছিল সুদৃশ্য সুইমিং পুল, জিমনেসিয়াম, স্কোয়াস খেলার কোট, ব্যয়বহুল তুর্কিস বাথ, ব্যয়বহুল ক্যাফে এবং ফার্স্ট ক্লাস ও সেকেন্ড ক্লাস উভয় যাত্রীদের জন্য আলাদা বিশাল লাইব্রেরি। এছাড়াও একটি বিশাল ব্যয় বহুল প্রধান দরজা ছিলো এবং বৈদ্যুতিক ব্যবস্থাও ছিল অনেক উন্নত। এ জাহাজের ফার্স্ট ক্লাসের জন্য তিনটি এবং সেকেন্ড ক্লাসের জন্য একটি মোট চারটি লিফটের ব্যবস্থা ছিল।
জাহাজের রেসিপ্রোকেটিং ইঞ্জিন তৎকালীন সময়ে নির্মিত সবচেয়ে বৃহত্তম ইঞ্জিন ছিল, যা ৪০ ফুট (১২ মি) উঁচু এবং জ্বালানি হিসেবে প্রতিদিন সিলিন্ডারে ৯ ফুট (২.৭ মি) ৬০০ লং টন (৬১০ টন) কয়লা ব্যবহৃত হতো। এছাড়াও এতে চারটি সিলিন্ডারের দুটি রিসিপ্রোকল ইঞ্জিন, ট্রিপল এক্সপ্যানশান স্টীম ইঞ্জিন এবং তিনটি প্রোপেলারকে চালানের জন্য একটি লো প্রেসার টারবাইন ছিল।
তাছাড়া এর ২৯টি বয়লার সক্রিয় রাখার জন্য ১৫৯ টি কয়লা পোড়ানো চুলো ছিলো। যা সর্বোচ্চ ২৩ নট (৪৩কি.মি./ঘণ্টা) গতিতে জাহাজটিকে চালাতে সাহায্য করতো। এ জাহাজের চারটি বিশাল চিমনির তিনটি ছিল সক্রিয় চতুর্থটি ব্যবহার করা হত বায়ু চলাচলের জন্য। প্রকৃত পক্ষে জাহাজটিতে এর চতুর্থ চিমনিটি লাগানো হয়েছিল এর সৌন্দর্য বাড়ানোর জন্য।
টাইটানিক জাহাজে কতজন যাত্রী ছিল?
টাইটানিকে মোট ২২২৩ জন যাত্রী নিয়ে ইংল্যান্ডের সাউদাম্পটন থেকে নিউইয়র্কের উদ্দেশ্যে প্রথমবারের মতো যাত্রা শুরু করেছিলো। এই জাহাজের প্রথমশ্রেণীর যাত্রী ছিলো ৩২৫ জন, দ্বিতীয় শ্রেণীর ছিলো ২৮৫ জন , তৃতীয় শ্রেণীর যাত্রী ছিলো ৭১০ জন এবং জাহাজের কর্মী ছিলো ৮৯৯ জন। এই সর্বমোট ২২২৩ জন যাত্রী নিয়ে রওনা হয়।
টাইটানিক জাহাজের ইতিহাস
১৯১২ সালের ১০ এপ্রিল, বুধবার, ইংল্যান্ডের সাউদাম্পটন থেকে নিউ ইয়র্কের উদ্দেশ্যে ২২২৩ জন যাত্রী নিয়ে টাইটানিক জাহাজটি যাত্রা শুরু করে। যাত্রার শুরুতেই এই জাহাজটি SS City of New York নামক একটি জাহাজের সাথে প্রায় ধাক্কা লেগে যাচ্ছিলো। তারপর ধীরে ধীরে জাহাজটি আটলান্টিক মহাসাগরের দিকে এগিয়ে যায়।
এভাবেই তিন দিন পর চতুর্থ দিন অর্থাৎ ১৯১২ সালের ১৪ এপ্রিল দুপুর ২:০০ দিকে “Amerika” নামের একটি জাহাজ থেকে রেডিও এর মাধ্যমে টাইটানিককে সংকেত দেয়া হয়েছিলো যে- তাদের যাত্রা পথের সামনেই রয়েছে একটি বিশাল আইসবার্গ।
তারপর ঐ একই সর্তকবানী পাঠায় রেডিও এর মাধ্যমে “Mesaba” নামের একটি জাহাজ। সে সময় জাহাজের রেডিও এর যোগাযোগ অপারেটরের দায়িত্বে ছিলো হ্যারন্ড ব্রীড ও জ্যাক পিলিপাস। তাদের কাছে দুই বার সর্তকবানীগুলো আসার পরও এটাকে তারা অপ্রয়োজনীয় মনে করে। তারা বিরক্ত হয়ে ইচ্ছা করে সর্তকবানীটি জাহাজ নিয়ন্ত্রণের মূলকেন্দ্রে পাঠায়নি।
আরও পড়ুন: হাকালুকি হাওর, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় হাওর
টাইটানিক জাহাজের ইতিহাস অনুযায়ী, জাহাজটি দুর্ঘটনায় পরার ৪০ মিনিট আগেও “Californian” শীপের রেডিও অপারেটর যোগাযোগ করে আইসবার্গ সম্পর্কে জানাতে চেয়েছিলো। কিন্তু টাইটানিক জাহাজের রেডিও অপারেটর জ্যাক পিলিপস রেগে গিয়ে বলল আমি কেইপ রেসের সাথে কাজ নিয়ে ব্যস্ত আছি। এটা বলেই লাইনটি কেটে দেয়। “Californian” শীপের রেডিও অপারেটরও তাদের সাড়া না পেয়ে তার ওয়ার্লেস সেটটি বন্ধ করে ঘুমিয়ে পরে।
এতোগুলো সংকেত পাওয়ার পরও সেটাকে অবেহেলা করার ফলে ১৫১৩ জন যাত্রীর মৃত্যু হলো। রাত যখন ১১টা ৪৫ মিনিট তখন জাহাজটি উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরের দিকে এগুচ্ছিলো। সেসময় ক্যাপ্টেন তার সামনে বিশাল আইসবার্গটি দেখেন। তখন তিনি জাহাজের গতি সামান্য দক্ষিণ দিকে সরিয়ে নেন আর তখনই পথ পর্যবেক্ষণকারীরা একটি বিশাল আইসবার্গ দেখতে পায়। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে।
হঠাৎ করেই টাইটানিকের ফার্স্ট অফিসার মুর্ডক আকস্মিকভাবে বাম দিকে নেওয়ার অর্ডার দেন এবং জাহাজটি সর্ম্পূণ উল্টোদিকে চালাতে বা বন্ধ করে দিতে বলেন। কিন্তু জাহাজের ডানদিকটি আইসবার্গের সঙ্গে প্রচন্ড ঘর্ষণের ফলে প্রায় ৯০ মিটার অংশ জুড়ে চিড় দেখা দেয়।
এই আইসবার্গ হলো সমুদ্রের বুকে ভেসে থাকা বড় বড় বরফের খন্ড। তবে এই আইসবার্গগুলো সমুদ্রে মাত্র আট ভাগ হয়ে থাকে। তার মধ্যে সাত ভাগই থাকে পানির নিচে আর এক ভাগ ভেসে থাকে পানির উপরে। সেক্ষেত্রে এর বড় অংশটাই চোখে দেখা যায়না। জাহাজটি সর্বোচ্চ চারটি পানিপূর্ণ কম্পার্টমেন্ট নিয়ে ভেসে চলার শক্তি ছিলো কিন্তু সেদিন পাঁচটি কম্পার্টমেন্টই পানিপূর্ণ হয়ে গিয়েছিলো। এছাড়াও ১২টি পানি প্রতিরোধকারী দরজাও পানিপূর্ণ হয়ে যায়।
কম্পার্টমেন্টগুলোর ওজনের কারণে জাহাজটি আস্তে আস্তে সামনের দিকে তলাতে থাকে। এমন জায়গায় জাহাজটির ধাক্কা লাগে যে, সবগুলো গেটের পানি প্রতিরোধ বিকল হয়ে যায়। পানির ভারে আস্তে আস্তে সাগরে তলিয়ে যায় টাইটানিক। রাত ২ টা ২০ মিনিটের মধ্যে সম্পূর্ণ জাহাজটি সাগরে তলিয়ে যায়।
টাইটানিক জাহাজের ধ্বংসাবশেস ও বর্তমান অবস্থা
দীর্ঘ ৭৩ বছর পর ১৯৮৫ সালে রবার্ট বালার্ড নামক ফরাসি বিজ্ঞানী টাইটানিককে খুঁজে বের করেন। জাহাজের ধ্বংসবশেষগুলো দক্ষিণপূর্ব নিউফাউন্ডল্যান্ড উপকূলের প্রায় ৩৭০ মাইল (৬০০ কিমি) দূরে পাওয়া যায়। জাহাজটি আটলান্টিক সাগরের ১২ হাজার ৬০০ ফুট নিচে স্থির হয়ে আছে।
দ্বিখণ্ডিত জাহাজটির দুটো টুকরো ১৯৭০ ফুট দূরে অবস্থান করছে। জাহাজের সামনের অংশ সমুদ্রতলে ৬০ ফুট মাটির গভীরে রয়েছে। সর্বশেষ ২০ জুন ২০২৩ সালে ধ্বংসাবশেষ খুঁজতে যাওয়া ‘টাইটান’ সাবমেরিন হারিয়ে যায় ৫ জন যাত্রী নিয়ে এবং তারা নিহত হন।
শেষকথা
উপরোক্ত আলোচনা টাইটানিক জাহাজের ইতিহাস সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাবলী তুলে ধরা হয়েছে। বর্তমানে টাইটানিক থেকেও আরো বহুগুণ বড় জাহাজ তৈরি হচ্ছে। সেগুলো এতটাই আধুনিক যে, একটি জাহাজকে একটি আধুনিক শহরের সাথে তুলনা করা যায়।