স্যাটেলাইট কি? স্যাটেলাইটের গঠন, প্রকারভেদ ও বিস্তারিত তথ্য

মানব সভ্যতার আধুনিকায়নে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছে কৃত্রিম উপগ্রহ বা স্যাটেলাইট। টেলিভিশন চ্যানেল দেখা, আবহাওয়ার পূর্বাভাস জানা, মোবাইল ফোনে কথা বলা, দিকনির্দেশনা পাওয়া, অবস্থান জানা ইত্যাদি বহু কাজকর্মে আমরা নিজেদের অজান্তেই স্যাটেলাইটের সুবিধা ভোগ করছি। তাই বহুল ব্যবহৃত এই স্যাটেলাইট কি এবং স্যাটেলাইটের গঠন, প্রকারভেদ ও বিস্তারিত তথ্য জেনে নিতে পারেন এই লেখা থেকে।

স্যাটেলাইট কি?

স্যাটেলাইট বা কৃত্রিম উপগ্রহ হলো এমন একটি বস্তু, যা তার চেয়ে বড় কোন বস্তুকে কেন্দ্র করে প্রদক্ষিণ করে। চাঁদ পৃথিবীর একমাত্র প্রাকৃতিক উপগ্রহ। তবে মহাকাশে প্রাকৃতিক উপগ্রহের পাশাপাশি মানুষের তৈরি অসংখ্য কৃত্রিম উপগ্রহ রয়েছে। কৃত্রিম উপগ্রহগুলো মূলত বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় মানুষের উদ্ভাবন করা মহাকাশে উৎক্ষেপিত উপগ্রহ।

১৯৫৭ সালের ৪ অক্টোবর সোভিয়েত ইউনিয়ন বিশ্বের প্রথমবারের মতো কৃত্রিম উপগ্রহ ‘স্পুটনিক ১’ মহাকাশে স্থাপন করেছিলো। তারপর থেকেই এখনো পর্যন্ত প্রায় ১১ হাজারেরও বেশি স্যাটেলাইট উৎক্ষেপিত হয়েছে মহাকাশে। স্যাটেলাইটগুলো তথ্য সংগ্রহ ও পর্যবেক্ষণের কাজ করে থাকে। এগুলো টেলিকমিউনিকেশন, টেলিভিশন সিগন্যাল, জিপিএস সিস্টেম, ভিন্ন গ্রহ ও মহাকাশ পর্যবেক্ষণ, পৃথিবীর আবহাওয়ার পূর্বাভাস ইত্যাদি কাজের জন্য মহাকাশের নির্দিষ্ট কক্ষপথে স্থাপন করা হয়।

স্যাটেলাইট কাকে বলে?

পৃথিবী বা অন্য কোন বিশাল বস্তু/ গ্রহকে কেন্দ্র করে প্রদক্ষিণ করা বস্তুগুলোকে স্যাটেলাইট বলে। ভিন্নভাবে বলতে গেলে পৃথিবীর চারদিকে প্রদক্ষিণ করে এমন স্থানে স্থাপিত বিশেষ ধরনের তারবিহীন রিসিভার বা ট্রান্সমিটারকে স্যাটেলাইট বলে।

স্যাটেলাইট কি কি উপাদান নিয়ে গঠিত?

একটি স্যাটেলাইটে কি কি উপাদান ব্যবহৃত হবে, তা নির্ভর করে স্যাটেলাইট গঠনের উদ্দেশ্যের উপর। মৌলিক কাঠামো ছাড়াও ডেটা ট্রান্সমিশনের জন্য এর বাড়তি কিছু যন্ত্রাংশ প্রয়োজন হয়। আবার কক্ষপথে পৌঁছানোর জন্য স্যাটেলাইটকে সাধারণত হাল্কা, দ্রুতগতির এবং মজবুত হতে হয়। প্রতিটি স্যাটেলাইটের দুটি সাধারণ যন্ত্রাংশ হলো অ্যান্টেনা এবং পাওয়ার সোর্স। এছাড়াও প্রায় সকল স্যাটেলাইটে ব্যবহৃত হওয়া সাধারণ উপাদান গুলো হলো:

(১) স্যাটেলাইটের কাঠামো বা স্যাটেলাইট বাস

একটি স্যাটেলাইটের আকৃতি কেমন হবে, তার গঠন, বিন্যাস ইত্যাদি বিষয়ের উপর নির্ভর করে স্যাটেলাইটের কাঠামো নকশা করা হয়। স্যাটেলাইটের সম্পূর্ণ কাঠামোকে ‘স্যাটেলাইট বাস’ বলেও আখ্যায়িত করা হয়। সাধারণত যখন কোন দেশ একটি স্যাটেলাইট তৈরি করতে বিভিন্ন নির্মাতা ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের সাথে স্যাটেলাইট তৈরীর চুক্তি করলে একটি কাঠামো নকশা করা হয়। এটি কৃত্রিম উপগ্রহের প্রধান বহিরূপ।

(২) ট্রানসপন্ডার

ট্রান্সপন্ডার হলো ট্রান্সমিটার ও রেসপন্ডার এর সমন্বয়ে গঠিত একটি সংযোগ ব্যবস্থা। এটি বিভিন্ন উৎস থেকে সিগন্যাল গ্রহণ করে। তারপর নিজস্ব প্রসেসরের মাধ্যমে আপলিংক এবং ডাউনলিংকের মতো সংগ্রহীত সিগন্যালকে নিরীক্ষণের জন্য অ্যাম্পলিফাই বা বিবর্ধন করে। সর্বশেষ ফাইবার অপটিক যোগাযোগ নেটওয়ার্কে পুনরায় একটি প্রি-প্রোগ্রাম ফেরত পাঠায়, যাতে করে অসংখ্য গ্রাহক সেই সিগন্যালকে গ্রহণ করতে পারে।

(৩) সোলার সেল এবং ব্যাটারি

সোলার সেল মূলত একটি ইলেট্রনিক ডিভাইজ। স্যাটেলাইটের এই অংশটি সরাসরি সূর্যের শক্তিকে ইলেক্ট্রিসিটিতে রূপান্তরিত করে। এটি ফোটোভোলটাইক (Photovoltaic) সেল বা পিভি (PV) নামেও পরিচিত। 

(৪) হাই ক্লক স্পিড প্রসেসর

এই অংশটি খুবই দ্রুত গতিতে বিভিন্ন প্রোগ্রাম থেকে বহু নির্দেশাবলী দিয়ে থাকে। এটি কম্পিউটার প্রসেসরের মতোই একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। স্যাটেলাইটের বহু কার্যকলাপ জন্য ভূ-কেন্দ্র থেকে এর মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা হয়।

(৫) পাওয়ার অ্যামপ্লিফায়ার

অ্যামপ্লিফায়ার একটি ইলেকট্রনিক ডিভাইস। এটি কোন দুর্বল ইলেকট্রিক্যাল সিগন্যালের রূপকে পরিবর্তন না করে এর ভোল্টেজ বা শক্তি বিবর্ধিত করে। এটি দুর্বল সংকেত গুলোকে শক্তিশালী করে তোলে। এছাড়াও এটি এ/ডি রূপান্তরের জন্য কিংবা এনালগ প্রক্রিয়াকরণের জন্য উপযুক্ত ভোল্টেজের মাত্রা নির্ধারণ করে।

(৬) ডেটা ট্রান্সমিশন অ্যান্টেনা

মহাকাশের স্যাটেলাইট প্রেরণের অন্যতম প্রধান কারণ হলো- যোগাযোগ, তথ্যগ্রহন ও সম্প্রচারভিত্তিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা। একটি স্যাটেলাইটে উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন ডেটা ট্রান্সমিটিং অ্যান্টেনা ও রিসিভার অ্যান্টেনা ব্যবহার করা হয়। এই অ্যান্টেনা গুলোর মাধ্যমে স্যাটেলাইট ও পৃথিবীর মধ্যে সংকেত প্রেরন ও গ্রহণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

(৭) ব্যান্ডপাস ফিল্টার 

ব্যান্ডপাস ফিল্টার হলো একধরনের ইলেকট্রনিক সার্কিট ডিভাইস। এটি একটি সংকেতকে সনাক্তকরণ করে এবং সংকেত টি স্যাটেলাইটে ব্যবহারের জন্য উপযুক্ত কিনা তা নির্ণয় করে। নির্দিষ্ট ফ্রিকোয়েন্সির মধ্যে থাকা সংকেত গুলোই এই ফিল্টার অতিক্রম করার সুযোগ পায় এবং স্যাটেলাইটে গ্রহীত হয়। 

(৮) ফ্রিকোয়েন্সি ব্যান্ড

সাধারণত ফ্রিকোয়েন্সি হলো প্রতি একক সময়ে একটি বস্তুর কম্পন সংখ্যা। স্যাটেলাইটের ফ্রিকোয়েন্সি ব্যান্ডগুলো আঞ্চলিক ফ্রিকোয়েন্সি এবং কোণীয় ফ্রিকোয়েন্সির পদ্ধতিতে কাজ করে। এটি টেলিযোগাযোগ ব্যবহারকারীদের ক্ষেত্রে রেডিও তরঙ্গের ফ্রিকোয়েন্সি এবং রেডিও সংকেত বহনকারী হিসেবে কাজ করে। 

(৯) হাই রেজুলেশন বিশিষ্ট ক্যামেরা

স্যাটেলাইটের সামগ্রিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য অত্যাবশ্যকীয় অংশ হচ্ছে বৈজ্ঞানিক সেন্সর এবং হাই রেজুলেশন বিশিষ্ট ক্যামেরা। স্যাটেলাইটে ব্যবহৃত উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন এসকল ডিভাইসগুলো পৃথিবীর ভূমি, সমুদ্র এবং বায়ুমণ্ডল থেকে ডেটা সংগ্রহ করে। এগুলো পৃথিবীর দিকে মুখ করে স্যাটেলাইটে সংযুক্ত থাকে। যেসকল স্যাটেলাইট মহাবিশ্ব সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে তাদের ক্যামেরা মহাকাশের দিকে সংযুক্ত থাকে।

এছাড়াও স্যাটেলাইটে আরো বহু ক্ষুদ্র ও বৃহৎ যন্ত্রাংশ এবং গুরুত্বপূর্ণ ডিভাইস রয়েছে। প্রতিটি সমন্বয় সাধনের মাধ্যমেই একটি স্যাটেলাইট তার কার্যক্রম পরিচালনা করে।

স্যাটেলাইটের প্রকারভেদ

স্যাটেলাইট কি
স্যাটেলাইট

স্যাটেলাইট বা উপগ্রহ প্রধানত দুই প্রকার। যথা: (১) প্রাকৃতিক উপগ্রহ; (২) কৃত্রিম উপগ্রহ। স্যাটেলাইট বলতে আমরা সাধারণত কৃত্রিম উপগ্রহকেই বুঝে থাকি। ব্যবহার এবং কক্ষপথের উপর ভিত্তি করে কৃত্রিম উপগ্রহ বিভিন্ন প্রকারের হয়ে থাকে। যথা:

(১) যোগাযোগ স্যাটেলাইট

কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট মূলত টেলিযোগাযোগের লক্ষ্যে মহাকাশে স্থাপন করা হয়। টেলিযোগাযোগে বেতার সংকেত প্রেরণের জন্য এ ধরনের স্যাটেলাইট অপরিহার্য। বর্তমানে আধুনিক কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট গুলো জিওসিঙ্ক্রোনাস, মোলনিয়া বা নিম্ন ভূ-কক্ষপথে স্থাপন করা হয়।

(২) পৃথিবী পর্যবেক্ষণ স্যাটেলাইট

পৃথিবী পর্যবেক্ষণ স্যাটেলাইট গুলো পৃথিবীর গতিবিধির উপর নজর রাখে। পরিবেশ-নিরীক্ষণ, পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি, আবহাওয়াবিজ্ঞান, মানচিত্র তৈরি ইত্যাদি সবকিছুই এই স্যাটেলাইট খুব ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে।

(৩) আবহাওয়া বা বায়ুমণ্ডলীয় স্যাটেলাইট

পৃথিবীর আবহাওয়া এবং জলবায়ু পর্যবেক্ষণ করতে এ ধরনের স্যাটেলাইট ব্যবহৃত হয়। এগুলোকে জিওষ্টেশনারী অপারেশনাল এনভায়রনমেন্ট স্যাটেলাইটও বলা হয়। এগুলো পোলার অরবিট থেকে পৃথিবীর নির্দিষ্ট স্থানের উপর থেকে ছবি তুলে ভূ-কেন্দ্রে আবহাওয়ার অবস্থাচিত্র প্রেরন করে।

(৪) ব্রডকাস্ট স্যাটেলাইট

ব্রডকাস্ট স্যাটেলাইটগুলো মূলত টেলিভিশন চ্যানেলের সিগন্যাল গুলো ট্রান্সমিট করতে ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশের ‘বঙ্গবন্ধু-১’ স্যাটেলাইটটিও একটি ব্রডকাস্ট স্যাটেলাইট।

(৫) GPS বা ন্যাভিগেশন স্যাটেলাইট

এ ধরনের স্যাটেলাইট রেডিও সংকেত ব্যবহার করে মোবাইল রিসিভারগুলোর দ্বারা কারো সঠিক অবস্থান নির্ধারণ করতে পারে। তবে এর মূল কাজ হলো সমুদ্রে জাহাজে চলার পথ নির্ধারণ করা এবং জিপিএস প্রযুক্তি কার্যকর করা।

(৬) এষ্ট্রোনােমি স্যাটেলাইট

এষ্ট্রোনােমি স্যাটেলাইট গুলো পৃথিবী থেকে দূরবর্তী স্থানে অবস্থিত গ্রহ, নক্ষত্র, ছায়াপথসহ সৌরজগতের বাইরের বিভিন্ন স্থান পর্যবেক্ষণের জন্য ব্যবহৃত হয়। 

(৭) নভোচারী স্যাটেলাইট

অধিকাংশ স্যাটেলাইট যাত্রীহীন হলেও নভোচারী স্যাটেলাইট যাচ্ছে বহন করতে ব্যবহৃত হয়। এদের মূল কাজ পৃথিবী থেকে নভোচারীদের নিয়ে আন্তর্জাতিক মহাকাশ কেন্দ্রে (International Space Station- ISS) -এ যাওয়া এবং সেখান থেকে ভূপৃষ্ঠে ফেরত আনা। মূলত মহাকাশ গবেষণা, পর্যবেক্ষণ ও চাঁদ ও মঙ্গলে অভিযানে এগুলোর ব্যবহার রয়েছে।

(৮) বৈজ্ঞানিক স্যাটেলাইট

বৈজ্ঞানিক নানান গবেষণামূলক কাজে এ ধরনের স্যাটেলাইট ব্যবহার করা হয়। এটি মহাবিশ্বের বিভিন্ন বস্তুর প্রতি নজরদারি এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য প্রেরণ করা হয়। যেমন: ‘হাবল স্পেস টেলিস্কোপ’ নামক স্যাটেলাইট মহাকাশে ‘গামা-রে’ এর গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে।

(৯) উদ্ধারকারী স্যাটেলাইট

এই স্যাটেলাইট গুলো রেডিও ডিস্ট্রেস সিগন্যাল ব্যবহার করে হারিয়ে যাওয়া বা বিপদে পড়া মানুষদের খুঁজে পেতে সহযোগিতা করে।

(১০) সামরিক স্যাটেলাইট

কিছু স্যাটেলাইট সামরিক বা গুপ্তচরবৃত্তিক প্রয়োগের জন্য নিযুক্ত থাকে। নিউক্লিয়ার মনিটরিং থেকে শুরু করে কমিউনিকেশন এনক্রিপশন ইত্যাদি জটিল কাজে সামরিক স্যাটেলাইট ব্যবহৃত হয়। এছাড়া এগুলো গুপ্তভাবে শত্রুদের গতিবিধির উপর নজর রাখে। কিছু সামরিক স্যাটেলাইট- কিলার স্যাটেলাইট হিসেবে শত্রুদের মহাকাশ সম্পদ ধ্বংস করতেও ব্যবহৃত হয়।

এছাড়াও যুগে যুগে আরো বহু ধরনের স্যাটেলাইট মহাকাশে স্থাপন করা হয়েছে।

স্যাটেলাইট কি কি কাজে লাগে?

একটি কৃত্রিম উপগ্রহ অসংখ্য কাজ করে থাকে। যেমন:

  • বৈজ্ঞানিক গবেষণায় সহায়তা করে।
  • আবহাওয়ার পূর্বাভাস জানা যায়।
  • এর মাধ্যমে শস্য পর্যবেক্ষণ করা যায়।
  • এটি ইন্টারনেট, টেলি যোগাযোগ, রেডিও নেটওয়ার্ক স্থাপন করে।
  • দিক নির্ণয় ও অবস্থান নির্ণয়ে সহায়তা করে।
  • টেলিভিশন চ্যানেল সম্প্রচার করে।
  • এগুলো সূর্যের আলোকে বৈদ্যুতিক শক্তিতে রূপান্তর করে সোলার সেল ব্যাটারি তৈরিতে সহায়তা করে।
  • সামরিক সংস্থা এবং প্রতিরক্ষার অস্ত্র সিস্টেম এবং বিমানের জন্য সঠিক নির্দেশনা দেয়।
  • ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করে।
  • কম্পিউটার এবং মেমোরি সিস্টেম ব্যবহার করে ডেটা প্রক্রিয়া করে।
  • মহাকাশ এবং পৃথিবী কেন্দ্রিক ডেটা সংগ্রহ করে তা পৃথিবীতে ভূ-কেন্দ্রে পাঠায় ইত্যাদি।

এছাড়াও কৃত্রিম উপগ্রহের গঠন, ধরন ও কক্ষপথের ওপর ভিত্তি করে এগুলো আরো বহু কাজ করে থাকে।

স্যাটেলাইট কিভাবে কাজ করে

স্যাটেলাইটের কার্যপদ্ধতি সহজ সাবলীলভাবে পরিচালিত হয়। সাধারণত পৃথিবী থেকে রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি বা বেতার তরঙ্গের মাধ্যমে স্যাটেলাইটে তথ্য পাঠানো হয়। স্যাটেলাইট গুলো সেই তথ্য অ্যান্টেনার সাহায্যে গ্রহন করে এমপ্লিফাই করে পুনরায় পৃথিবীতে প্রেরন করে। একটি স্যাটেলাইট তথ্য গ্রহণ এবং প্রেরনের জন্য দুটি ভিন্ন কম্পাঙ্ক তরঙ্গ ব্যবহার করে।

আরও পড়ুন: প্রযুক্তি কি? বিভিন্ন প্রকার প্রযুক্তির সংজ্ঞা ও  ব্যাখ্যা

স্যাটেলাইট থেকে পৃথিবীতে পাঠানো সিগন্যাল অনেক দূর্বল এবং কম ক্ষমতাসম্পন্ন হয়ে থাকে। তাই ডিস এন্টেনা ব্যবহার করে সিগন্যালকে কেন্দ্রীভূত করে রিসিভার দিয়ে তথ্য গ্রহণ করে। সেই সিগন্যালকে পৃথিবীব্যাপী বিভিন্ন স্থানে দ্রুত প্রেরণ করা এবং ব্যবহার করা সম্ভব হয়।

স্যাটেলাইটের কক্ষপথ

স্যাটেলাইটের প্রধান ৪ টি কক্ষপথ হলো:

  • লো আর্থ অরবিট (LEO): এটি ১৮০ কিলোমিটার থেকে ২,০০০ কিলোমিটার উচ্চতায় অবস্থিত ভূ-কেন্দ্রিক কক্ষপথ।
  • মিডিয়াম আর্থ অরবিট (MEO): এটি ২,০০০ কিলোমিটার থেকে ৩৫,৭৮৬ কিলোমিটার উচ্চতায় অবস্থিত ভূ-কেন্দ্রিক কক্ষপথ।
  • জিওস্টেশনারি অরবিট (GO): এটি ৩৫,৭৮৬ কিলোমিটার উচ্চতায় অবস্থিত ভূস্থির কক্ষপথ। এই কক্ষপথের পর্যায়কাল পৃথিবীর আবর্তনকালের সাথে মিলে যায়। এই কক্ষপথের বেগ প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ৩ হাজার মিটার।
  • অধিক উচ্চতার কক্ষপথ (High Altitude Orbit- HAO): এটি ৩৫,৭৮৬ কিলোমিটার উচ্চতার ভূস্থির কক্ষপথ গুলোর তুলনায় অধিক উচ্চতায় অবস্থিত ভূ-কেন্দ্রিক কক্ষপথ।

স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ ও স্থাপন প্রক্রিয়া

সাধারণত পৃথিবীর তার ভূপৃষ্ঠে থাকা সকল বস্তুগুলোকেই অভিকর্ষ বা মাধ্যাকর্ষণ বল দ্বারা নিজের দিকে টানতে থাকে। মহাকাশ-কেন্দ্রিক যে কোন যান উৎক্ষেপণের প্রধান বাঁধা হলো পৃথিবীর অভিকর্ষ বল। একটি স্যাটেলাইট কে পৃথিবীর গণ্ডি পেরিয়ে মহাকাশে পৌঁছাতে এই অভিকর্ষ বলের বিপরীতে ব্যাপক শক্তি প্রয়োগ করতে হয়। কারন, সেই অভিকর্ষ বল যে কোন উৎক্ষেপণ করা বস্তুকে সর্বদায় পৃথিবীর দিকে টানতে থাকে।

এই কৃত্রিম উপগ্রহ গুলো পৃথিবী-কেন্দ্রিক হওয়ায়, এটিকে রকেট বা স্পেস শাটল এর Cargo Bay এর মাধ্যমে মহাকাশের কক্ষপথে পাঠানো হয়। যখন একটি রকেট স্যাটেলাইট নিয়ে পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তি পার হতে, তখন তা ঘণ্টায় ২৫ হাজার ৩৯ মাইল বেগে ছুটতে হয়। রকেটের গতির সামঞ্জস্যতা ঠিক রাখতে ব্যর্থ হলে, পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তিকে অতিক্রম করা যাবেনা এবং কক্ষপথে স্যাটেলাইট স্থাপনের মিশন সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হবে।

যেই রকেট এর মাধ্যমে মহাকাশে স্যাটেলাইট পাঠানো হয়, সেই রকেটকে ইনার্শিয়াল গাইডেন্স সিস্টেম মেকানিজম এর মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। রকেট টি যখন পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ বল পেরিয়ে নির্দিষ্ট কক্ষপথে পৌঁছে যায়, তখন রকেট থেকে স্যাটেলাইট টিকে ছেড়ে দেওয়া হয় এবং কক্ষপথে স্থাপন করা হয়। 

স্যাটেলাইট ভূ-পৃষ্ঠে পড়ে যায় না কেন? 

পৃথিবী সকল বস্তুকেই তার নিজের দিকে অভিকর্ষ বল দ্বারা টানতে থাকে। তাহলে স্যাটেলাইট কিভাবে ভূ-পৃষ্ঠের সেই অভিকর্ষ বল থেকে মুক্ত হয়ে কক্ষপথে ঘুরতে থাকে, তা নিয়ে আমাদের অনেকেরই প্রশ্ন থাকতে পারে।

এক্ষেত্রে পৃথিবীর উপগ্রহ চাঁদের উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। চাঁদ পৃথিবীর একমাত্র প্রাকৃতিক উপগ্রহ হিসেবে পৃথিবীকে কেন্দ্র করে চারপাশে ঘুরতে থাকে। প্রতিটি প্রাকৃতিক উপগ্রহের একটি বহির্মুখী গতিশক্তি রয়েছে। চাঁদেরও পৃথিবীর অভিকর্ষ বলের বিপরীতে বহির্মুখী গতিশক্তি আছে। বিপরীতমুখী এই গতিশক্তির ফলে চাঁদ পৃথিবী থেকে মহাকাশের দিকে ছুটতে চায়। অপরদিকে, পৃথিবীর অভিকর্ষ বল চাঁদকে পৃথিবীর দিকে আকর্ষণ করতে থাকে। আশ্চর্যজনক ভাবে, চাঁদের বহির্মুখী গতিশক্তি এবং পৃথিবীর অভিকর্ষ বল সমান। তাই একটি শক্তি অপর শক্তিকে হারাতে পারে না। দুটি বিপরীতমুখী বলের টানাপোড়েনে চাঁদ একটি নির্দিষ্ট স্থানে স্থির হয়ে গেছে এবং গতিশীলভাবে পৃথিবীর চারপাশে ঘুরতে থাকে। 

কিন্তু, একটি চাঁদ প্রাকৃতিকভাবে বহির্মুখী গতিশক্তি পেলেও, স্যাটেলাইটের সেই গতিশক্তি নিজে নিজে তৈরি করতে পারে না। তাই রকেটের মাধ্যমে একটি স্যাটেলাইটকে অভিকর্ষ বলের বিপরীতে সমান গতিশক্তি দেওয়া হয়। গতিশক্তি সামঞ্জস্যপূর্ণ থাকলে, স্যাটেলাইট পরিপূর্ণভাবে উপগ্রহের মত স্থিতিশীল থাকে। 

স্যাটেলাইট বিহীন পৃথিবী কেমন হবে?

১৯৫৭ সালের পর থেকে বিভিন্ন প্রয়োজনে বিভিন্ন প্রকারের স্যাটেলাইট পৃথিবী থেকে উৎক্ষেপণ করা হয়েছে। ইউনাইটেড নেশনস অফিস ফর আউটার স্পেস অ্যাফেয়ার্স (UNOOSA) -এর পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০২৪ সালের জুনের শেষ পর্যন্ত প্রায় ১১,৩৩০ টি স্যাটেলাইট পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করছে। প্রতিবছর এর সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। 

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি কি? এর ব্যবহার, সুবিধা ও অসুবিধা

স্যাটেলাইট আমাদের জীবনকে অনেকটাই সহজ করে দিয়েছে। তাই সমগ্র পৃথিবী স্যাটেলাইট বিহীন হলে যোগাযোগ, বৈশ্বিক অর্থনীতি, অনলাইন ব্যাংকিং, এটিএম ব্যাংকিং, ইন্টারনেট, টেলিভিশন, রেডিও, জিপিএস ইত্যাদি সকল অচল হয়ে পড়বে। মানবসভ্যতাও পিছিয়ে যাবে ১৮ শতক বা তারও আগের অবস্থায়। তাই আধুনিক বিশ্বের জন্য স্যাটেলাইটের গুরুত্ব অপরিসীম।

প্রশ্ন/ FAQ’S

স্যাটেলাইট কি কাজে ব্যবহার হয়?

স্যাটেলাইট সাবসিস্টেমগুলি বিদ্যুৎ উৎপাদন, তাপ নিয়ন্ত্রণ, টেলিমেট্রি, ভঙ্গি নিয়ন্ত্রণ, বৈজ্ঞানিক উপকরণ, যোগাযোগ ইত্যাদি অনেক কাজ সম্পন্ন করে থাকে।

শেষকথা 

স্যাটেলাইট কি: বর্তমানে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে স্যাটেলাইটের ব্যবহার প্রায় বাধ্যতামূলক হয়ে পড়েছে। এটি একটি দেশের এমনকি সমগ্র পৃথিবীর সামগ্রিক উন্নয়নে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। ভবিষ্যতে মহাকাশের স্যাটেলাইট গুলো আরো বেশি আধুনিক এবং সুদূরপ্রসারী হবে বলে আশা করা হয়।