ওয়ান্ডার অব দ্য সিস – বিশ্বের সবচেয়ে বড় জাহাজ

বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বড় জাহাজ হলো রয়্যাল ক্যারিবিয়ান ইন্টারন্যাশনালের মালিকানাধীন একটি ফ্ল্যাগশিপ- ওয়ান্ডার অব দ্য সিস (Wonder Of The Sea’s)। ইতিহাসের পাতায় টাইটানিক ছিল সবচেয়ে বড় জাহাজ। তবে টাইটানিক থেকেও অনেকাংশে বড় এই জাহাজটি।

বিশাল সামুদ্রিক জাহাজ নির্মাণের প্রতিযোগিতায় এর থেকে এগিয়ে যাচ্ছে ‘আইকন অব দ্য সিস’। তবে সে জাহাজটি এখনো সমুদ্রপথে যাত্রা শুরু করেনি। তাই বর্তমান সময়ের সবচেয়ে বড় জাহাজ ‘ওয়ান্ডার অব দ্য সিস’। এটি রয়্যাল ক্যারিবিয়ান এর ওসিস শ্রেণীর ক্রুজ জাহাজের মধ্যে পঞ্চম। বিশাল এই জাহাজটি নির্মাণের ইতিহাস, নির্মাণ খরচ, সম্পূর্ণ স্পেসিফিকেশন, জাহাজে যাত্রীদের জন্য কি কি আছে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারবেন এই লেখাতে।

ওয়ান্ডার অব দ্য সিস নির্মাণ ও যাত্রা শুরুর ইতিহাস

২০২২ সালে ‘ওয়ান্ডার অব দ্য সিস’ উদ্বোধন করা হলেও এর গবেষণা শুরু হয়েছিল আরও প্রায় ৭ বছর পূর্বে। ২০১৬ সালের ২৫ মে, বিশ্বব্যাপী বিখ্যাত জাহাজ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান রয়্যাল ক্যারিবিয়ান গ্রুপ, ২০২১ সালে ডেলিভারির সময় নির্ধারণ করে, একটি পঞ্চম ওয়েসিস-শ্রেণির জাহাজের জন্য ফ্রান্সের ‘চ্যান্টিয়ের্স দে ল’আটলান্টিক’ এর সাথে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে।

জাহাজটি নিয়ে গবেষণার দীর্ঘদিন পর, ২০১৯ সালের এপ্রিল মাসে সেন্ট-নাজায়ার শিপইয়ার্ডে সর্বপ্রথম এই জাহাজটির জন্য ইস্পাত কাটা হয়েছিল। ২০১৯ সালের ৯ মে, জাহাজের কিল স্থাপন করা হয়েছিল। কার্যক্রম পরিচালিত হওয়ার মাঝে আরেক বাধা আসে করোনা মহামারীর। ২০২০ সালের আগস্ট মাসে, COVID-19 মহামারীর ফলে জাহাজের ডেলিভারি ২০২২ পর্যন্ত বিলম্বিত হতে পারে বলে ঘোষণা করেন রয়্যাল ক্যারিবিয়ান।

২০২১ সালের এপ্রিল মাসে, রয়্যাল ক্যারিবিয়ান সাংহাই ও হংকং এর বন্দরগুলো থেকে এশিয়ায় ওয়ান্ডার অব দ্য সিস এর প্রথম যাত্রার ঘোষণা করেছিল। তবে মহামারীর কারণে তার বিলম্ব হয়। বাণিজ্যিকভাবে এর বুকিং শুরু হয় ২০২২ সাল থেকে। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে, রয়্যাল ক্যারিবিয়ান পুনরায় ঘোষণা করে জাহাজটি পরিবর্তীতে পোর্ট এভারগ্লেডসে আত্মপ্রকাশ করবে। এতে সর্বপ্রথম ক্যারিবিয়ান ক্রুজ যাত্রা করবে। গ্রীষ্মকালীন সময়ে এটি ভূমধ্যসাগরে যাওয়ার আগে বার্সেলোনা ও রোম থেকে যাত্রা করবে।

ক্রিউ যাত্রী নিয়ে যাত্রা শুরুর আগে, রয়্যাল ক্যারিবিয়ানের এই জাহাজটির প্রযুক্তির কথা নিশ্চয়তা যাচাইয়ের ২৯ অক্টোবর ২০২১ তারিখে ‘চ্যান্টিয়ের্স দে ল’আটলান্টিক’ জাহাজটির নির্মাণ কার্যক্রম শেষ করে। পরের সপ্তাহে তারা নিজস্ব পরিচালনা ব্যবস্থায় ‘সেন্ট-নাজায়ার’ থেকে ‘মার্সেই-ফস পোর্ট’ পর্যন্ত চ্যান্টিয়ার নেভাল ডি মার্সেই ড্রাইডকে কাজ শেষ করার জন্য পাঠায়।

২০২১ সালের নভেম্বর মাসে জাহাজের লিভারিটিকে ওডিসি অফ দ্য সিস-এর অনুরূপ পরিবর্তন করা হয়েছিল। এর নাম প্রথমের লেখা স্থান থেকে সরিয়ে পিছনে স্থাপন করা হয়েছিল এবং পুনরায় বৃহত্তর অক্ষরে প্রিন্ট/ রঙ করা হয়েছিল।

২০২২ সালের ২৭ জানুয়ারী, জাহাজটি রয়্যাল ক্যারিবিয়ানের কাছে হস্তান্তর করা হয়। রয়্যাল ক্যারিবিয়ান এই বিশাল জাহাজটি নিয়ে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে উত্তর আমেরিকায় পৌঁছায়। তারপর পোর্ট এভারগ্লেডস থেকে ৪ মার্চ ২০২২ সালে প্রথম সমুদ্রযাত্রা শুরু করেন।

ওয়ান্ডার অব দ্য সিস নির্মাণকাজে জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলো

  • Chantiers de l’Atlantique: জাহাজ নির্মাণকারী প্রধান প্রতিষ্ঠান।
  • ROBOS Contract Furniture: এটি জাহাজের জন্য একটি কাস্টম-মেড আসবাবপত্র সরবরাহকারী, অভ্যন্তরীণ এবং বহিরঙ্গন গৃহসজ্জার জন্য প্রধান সরবরাহকারী ছিল।
  • Vestnes Ocean: এই প্রতিষ্ঠানটি জাহাজের আসবাবপত্র সরবরাহকারী, হুইলহাউস, ক্রু জিম, ইঞ্জিন কন্ট্রোল রুম এবং নিরাপত্তা নিয়ন্ত্রণ কক্ষ সহ জাহাজের অভ্যন্তরীণ কিছু অংশে আসবাবপত্র স্থাপন করেছে।
  • EVO: জাহাজের জন্য লফ্ট-টাইপ স্যুট সরবরাহ করার জন্য অভ্যন্তরীণ ডিজাইন কোম্পানি EVO ডিজাইন চুক্তিবদ্ধ করেছিল চ্যান্টিয়ার্স ডি এল’আটলান্টিক।

ওয়ান্ডার অব দ্য সিস এর নির্মাণ খরচ

নির্মাণের শুরুতে জাহাজটির মোট খরচ নির্ধারণ করা হয়েছিল ১ বিলিয়ন বা ১০০ কোটি ইউরো। তবে মহামারী কালীন সময়ে এর নির্মাণ কাজ স্থগিত ছিল। এছাড়াও অন্যান্য পারিপার্শ্বিক কারণে খরচ বৃদ্ধি। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, এই জাহাজটি নির্মাণে মোট ১২০ কোটি ইউরো বা প্রায় ১৩৫ কোটি মার্কিন ডলার খরচ হয়েছিল।

ওয়ান্ডার অব দ্য সিস এর স্পেসিফিকেশন

<yoastmark class=

ওয়ান্ডার অব দ্য সিস এর দৈর্ঘ্য ১,১৮৮ ফুট বা ৩৬২ মিটার লম্বা। এটি ২১১ ফিট বা প্রায় ৬৫ মিটার চওড়া। এর একটি খসড়া প্রায় ৩০ ফুট। জাহাজে থাকা সর্বমোট ১৮টি ডেক জুড়ে এর মোট টনেজ প্রায় ২,৩৬,৮৫৭ টন গ্রোস টনেজ।

এই জাহাজে ৫,৭৩৪ জন যাত্রীর ডাবল অকুপেন্সি বা সর্বোচ্চ ৬,৯৮৮ জন যাত্রী থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। এটি ২,৮৬৭টি কেবিন সহ সর্বমোট ৭,০৮৪ জন যাত্রীকে ধারণ করতে সক্ষম। এই ক্রুজ জাহাজটি ২,৩০০ জন ক্রু সদস্য দ্বারা পরিচালনা করা হয়। অতিথি যাত্রীদের ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত রয়েছে ১৬টি ডেক ও ২০টি রেস্তোরা।

সমুদ্রের বিস্ময় নামক এই জাহাজটি মূলত ৬টি সামুদ্রিক ডিজেল সেট দ্বারা চালিত হয়। এর মধ্যে ২টি ১৬-সিলিন্ডার Wartsila 16V46D এর সাধারণ রেল ইঞ্জিন এবং ৪টি ১২-সিলিন্ডার Wartsila 12V46D ইঞ্জিন।

বিশাল এই জাহাজটিতে ৩টি ‘বৈদ্যুতিক থ্রাস্টার’ ও ডকিংয়ের জন্য ব্যবহৃত চারটি ৪টি ‘বো থ্রাস্টার’ দ্বারা চালানো হয়। এর প্রতিটি ২০ ফুট চওড়া ঘূর্ণনযোগ্য প্রপেলার চালায়। ৩টি বৈদ্যুতিক থ্রাস্টারের প্রতিটি ২০,০০০ কিলোওয়াট অ্যাজিপড প্রধান ইঞ্জিন ব্যবহার করে। এই ইঞ্জিনগুলো জাহাজের শক্ত অংশের নিচে মাউন্ট করা হয়। এছাড়াও ক্রুজিং গতির জন্য জাহাজটিতে ৪টি বো থ্রাস্টারের প্রতিটি ৫,৫০০ কিলোওয়াট শক্তি বা ৭,৩৮০ হর্সপাওয়ার শক্তি সরবরাহ করে।

ওয়ান্ডার অব দ্য সিস এর যাত্রীদের সুযোগ-সুবিধা

এই জাহাজটি একটি যাত্রীবাহী জাহাজ হওয়ায় যাত্রীদের সর্বোচ্চ সেবা, সুযোগ-সুবিধা ও বিনোদন নিশ্চিত করা ছিল এই জাহাজ নির্মাণের অন্যতম উদ্দেশ্য। জাহাজটিতে মূলত আটটি অংশ রয়েছে। যথা:

  • সেন্ট্রাল পার্ক,
  • বোর্ডওয়াক,
  • পুল এবং স্পোর্টস জোন,
  • এন্টারটেইনমেন্ট প্লেস,
  • রয়্যাল প্রমনেড,
  • ভাইটালিটি স্পা এবং ফিটনেস সেন্টার,
  • ইয়ুথ জোন,
  • স্যুট নেবারহুড।

আরও পড়ুন: হাকালুকি হাওর, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় হাওর

ওয়ান্ডার অব দ্য সিস- এর এই আটটি অংশে যাত্রীদের সুবিধার জন্য রয়েছে ব্যাপক ব্যবস্থাপনা। যেমন:

  • শিশুদের জন্য একটি ওয়াটার পার্ক,
  • শিশুদের একটি খেলার মাঠ,
  • সুইমিং পুল এবং ঘূর্ণি পুল,
  • রয়েছে পারফেক্ট স্টর্ম রেসিং ওয়াটারস্লাইড এবং ওয়ান্ডার প্লেস্কেপ আন্ডারওয়াটার থিমযুক্ত বাচ্চাদের জন্য আউটডোর প্লে এরিয়া,
  • ছোট বড় সকলের জন্য একটি পূর্ণ আকারের বাস্কেটবল কোর্ট, একটি ভলিবল কোর্ট এবং একটি মিনি-গলফ কোর্ট রয়েছে,
  • একটি বড় আইস-স্কেটিং রিঙ্ক,
  • একটি সার্ফ সিমুলেটর,
  • একটি জিপ লাইন, যা ১০ ডেক পর্যন্ত উঁচু,
  • ১,৪০০ আসনের একটি থিয়েটার,
  • একটি আউটডোর অ্যাকুয়াটিক থিয়েটার, যার প্ল্যাটফর্মটি ৩০ ফুট উঁচু।
  • ২টি ৪৩ ফুট উঁচু রক-ক্লাইম্বিং দেয়াল।
  • উন্নত বিশেষ রেস্তোরাঁ এবং উচ্চমানের বুটিক।
  • ক্রুজ জাহাজের কেন্দ্রস্থলে রয়েছে রয়্যাল প্রমনেড। সেখানে কেনাকাটা এবং বিনোদনের জায়গা রয়েছে।
  • রয়েছে একটি সম্মেলন কেন্দ্র, একটি চিকিৎসা কেন্দ্র এবং একটি ফার্মেসি।

অন্যান্য যাত্রীবাহী বিশাল সামুদ্রিক জাহাজের মতো এই জাহাজটিতেও রয়েছে একটি সেন্ট্রাল পার্ক। জাহাজকে পরিবেশ বান্ধব করতে, অক্সিজেন সরবরাহ উন্নতদের করতে ও সৌন্দর্য্য বৃদ্ধির জন্য এই পার্ক নির্মাণ করা হয়েছিল। এটি সমুদ্রের মাঝে একটি জীবন্ত উদ্যান। এখানে প্রায় ১০,০০০ টিরও বেশি গাছপালা এবং ফুল গাছ রয়েছে।

যাত্রীরা এখানে দিনের বেলায় খোলা বাতাসে মরুদ্যান উপভোগ করতে পারে এবং সন্ধ্যায় তারার নীচে মনমুগ্ধকর সময় কাটাতে পারে।

শেষকথা

বিশাল বিশাল জাহাজ নির্মাণের প্রতিযোগিতা চলছে বিশ্বজুড়ে। এসকল জাহাজের গঠন দেখলে মনে হয় যেন সমুদ্রের মাঝে ভিন্ন একটি শহর। ভবিষ্যতে ওয়ান্ডার অব দ্য সিস- এর থেকেও আরো বড় বড় এবং অধিক সুবিধা যুক্ত জাহাজ নির্মাণ হবে বলে আশা করা যায়।