ইসলাম ৫টি স্তম্বের উপর প্রতিষ্ঠিত। যাকাত ইসলামে ৫ম স্তম্ব। নিসাব পরিমান মালের মালিক এমন ব্যক্তির উপর যাকাতের হিসাব নিকাশ করে যাকাত আদায় করা ফরজ। আমাদের আজকের আলোচনা যাকাত সংক্রান্ত বিষয়াবলি নিয়ে। আল্লাহ তৌফিক দান করুন।
যাকাত কাকে বলে, যাকাত আদায় সম্পর্কে পবিত্র কুরআন ও হাদীসের নির্দেশনা:
যাকাতের আদায় করা কোরআন হাদিসের অকাট্য দলীল দ্বারা প্রমাণিত। হিজরতের দ্বিতীয় বছরে যাকাতের বিধান ফরয করা হয়েছে। যাকাত আদায়ে অস্বীকার করা কুফরী এবং মৃত্যুদণ্ডের মতো শাস্তিযোগ্য অপরাধ। নিসাব পরিমাণ অর্থ থাকলে এবং পূর্ণ এক বছর অতিবাহিত হয়ে থাকলে সাথে সাথে যাতাক আদায় করা ফরয। যাকাত আদায়ে দেরি করলে গুনাহগার হতে হবে।
আল্লাহ তা’য়ালার বানী :
وَأَقِيمُوا الصَّلوةَ وأتُوا الزَّكَوةَ وَارْكَعُوا مَعَ الرَّكِمِينَ
তোমরা নামায কায়িম করো, যাকাত আদায় করো এবং রুকু কারীদের সাথে রুকু কর।
আল্লাহ তা’আলার বাণী :
خُذُ مِنْ أَمْوَالِهِمْ صَدَقَةٌ تُظهِرُهُمْ وَتُرَكّيْهِمْ بِهَا وَصَلَ عَلَيْهِمْ إِنَّ صَلَاتَكَ سَكَن لَّهُمْ وَاللَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ
“আপনি তাদের সম্পদ থেকে যাকাত গ্রহণ করুন। এর দ্বারা আপনি তাদেরকে পবিত্র ও পরিশোধিত করুন। আপনি তাদের জন্য দোয়া করুন। কেননা, আপনার দোয়া তাদের জন্য অন্তরের শান্তির কারণ হবে। আর আল্লাহ সর্বশ্রোতা এবং সর্বজ্ঞ।
আল্লাহ তা’আলার বাণী :
“আর যারা স্বর্ণ-রৌপ্য জমা করে এবং তা আল্লাহর পথে ব্যয় করে না (অর্থাৎ যাকাত দেয় না) তাদেরকে কষ্টদায়ক শাস্তির বার্তা প্রদান করুন।
নবী কারীম -এর বাণী:
فَقَالَ اعْبُدُوا رَبَّكُمْ وَصَلُّوا خَمْسَكُمْ وَصُوْمُوا شَهْرَكُمْ وَحُجُوا بَيْتَكُمْ وَأَذُوا زكَاتَكُمْ طَيْبَةً بِهَا أَنْفُسُكُمْ تَدْخُلُوا جَنَّةَ رَبِّكُمْ عَزَّ وَجَلَّ
“রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেছেন, তোমরা তোমাদের রবের ইবাদত করো, পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করো, রামাদ্বান মাসে রোযা রাখো, তোমাদের রবের ঘরের হজ্জ করো এবং সন্তুষ্টচিত্তে তোমাদের সম্পদের যাকাত আদায় করো। তা হলে তোমরা তোমাদের রবের জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে।
যাকাত শব্দের অর্থ কি
‘যাকাত’ Zakat শব্দটি আরবী। যাকাত শব্দের অর্থ বৃদ্ধি পাওয়া, পবিত্রতা অর্জন করা, বরকত লাভ করা। আল-কামূসুল-ফিক্হ গ্রন্থে যাকাতের শব্দটির ৫ টি অর্থ উল্লেখ করা হয়েছে । যথা :
- বরকত লাভ করা এবং বৃদ্ধি পাওয়া।
- কোনো বস্তুকে পরিষ্কার করা ।
- পবিত্রতা লাভ করা ।
- প্রশংসা করা।
- উপযুক্ত করা ।
যাকাতের মাধ্যমে সম্পদের মধ্যে বরকত লাভ হয়, সম্পদ বৃদ্ধি পায়, ত্রুটিমুক্ত হয় এবং পবিত্রও হয়। যাকাত আদায়কারী ব্যক্তি আল্লাহর নিকট প্রশংসিত হয় এবং অবশিষ্ট সম্পদ উত্তম সম্পদে পরিণত হয়।
পবিত্র কুরআন মাজীদে ৮২ বার যাকাত শব্দটি নামাযের আলোচনার সাথে উল্লেখ করা হয়েছে। ইসলামের সবচেয়ে বড় সেবামূলক পদক্ষেপ হলো দারিদ্র্য বিমোচন, সমাজে ভিক্ষাবৃত্তি কমিয়ে আনা, গ্রহণের চেয়ে দানের হাত তৈরি করা, অসচ্ছল, অনাথ, দুস্থ-নিঃস্ব, সর্বস্বান্ত, বুভুক্ষু, গরীব, মিসকীন, আঁতুর, দরিদ্রজনকে দানের মাধ্যমে সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করা। সকলের জানা আছে যে, অর্থই হলো সকল অনর্থের মূল। অর্থাভাব চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি, ছিনতাই এবং সন্ত্রাসকে জন্ম দেয়। এতে শান্তি নষ্ট হয়, গোটা সমাজ এবং রাষ্ট্র অশান্তির কবলে পড়ে। সমাজ এবং রাষ্ট্রে শান্তির প্রধান সোপান হলো দেশের প্রত্যেকটি মানুষের আর্থিকভাবে সচ্ছল হওয়া। আমাদের উচিত যাকাতের হিসাব নিকাশ করে যাকাত আদায় করা।
আরো পড়ুন: তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ম, নিয়ত, দোয়া, ফজিলত ও বিস্তারিত
নবী করিম (সা:) বলেছেন:- ধনীদের থেকে অর্থ আদায় করা হবে এবং গরিব ও অসহায়দের মধ্যে তা বন্টন করা হবে।
যাকাতের হিসাব
যাকাতের ‘নিসাব পরিমাণ সম্পদ’ বিভিন্ন দ্রব্যাদির ক্ষেত্রে বিভিন্ন হয়। নিচে এসংক্রান্ত বিস্তারিত দেয়া হলো-
বিষয় | নিসাব (সর্বনিম্ন পরিমাণ) | যাকাত প্রদানের হার |
স্বর্ণ, রৌপ্য কিংবা সোনা-রূপার অলংকার | সোনা ৭.৫০ তোলা এবং রূপা ৫২.৫০ তোলা | সম্পূর্ণ মূল্যের ২.৫% |
নগদ অর্থ, ব্যাংক জমা এবং ব্যবসায়িক পণ্য | ৫২.৫০ তোলা রূপার মূল্যমান | সম্পূর্ণ মূল্যের ২.৫% |
কৃষিজাত দ্রব্য | ইমাম আবু হানিফ (র.) এর মতে, যেকোনো পরিমাণ; অন্যান্যদের মতে, ৫ ওয়াসাক বা ২৬ মণ ১০ সের; ইসলামিক ইকোলজিক্যাল রিসার্চ ব্যুরো’র মতে, ১৫৬৮ কেজি |
বৃষ্টিতে উৎপাদিত দ্রব্যের ১০% |
খনিজ দ্রব্য | যেকোনো পরিমাণ | দ্রব্যের ২০% |
ভেড়া-ছাগল | ৪০-১২০টি ১২১-২০০টি ২০১-৪০০টি ৪০০-৪৯৯টি ৫০০ বা ততোধিক |
১টি ভেড়া বা ছাগল ২টি ভেড়া বা ছাগল ৩টি ভেড়া বা ছাগল ৪টি ভেড়া বা ছাগল ৫টি ভেড়া বা প্রতি শ’তে ১টি |
গরু-মহিষ | ৩০-৩৯টি ৪০-৪৯টি ৫০-৫৯টি ৬০-৬৯টি ৭০-৭৯টি ৮০-৮৯টি ৯০-৯৯টি ১০০-১১৯টি |
১টি এক বছরের বাছুর ১টি দুই বছরের বাছুর ২টি দুই বছরের বাছুর ১টি তিন বছরের এবং ১টি দুই বছরের বাছুর ২টি তিন বছরের বাছুর ৩টি দুই বছরের বাছুর ১টি তিন বছরের এবং ২টি দুই বছরের বাছুর দুই বছরের বাছুর -এভাবে ঊর্ধ্বে হিসাব হবে |
উট | ৫-৯টি ১০-১৪টি ১৫-১৯টি ২০-২৪টি ২৫-৩৫টি ৩৬-৪৫টি ৪৬-৬০টি ৬১-৭৫টি ৭৯-৯০টি ৯১-১২০টি ১২১-১২৯টি ১৩০-১৩৪টি ১৩৫-১৩৯টি ১৪০-১৪৪টি ১৪৫-১৪৯টি ১৫০ এবং তদুর্ধ্ব |
১টি তিন বছরের খাশি অথবা ১টি এক বছরের বকরি ২টি এক বছরের বকরি ৩টি এক বছরের বকরি ৪টি এক বছরের বকরি ৪টি এক বছরের মাদী উট ২টি তিন বছরের মাদী উট ২টি চার বছরের মাদী উট ১টি পাঁচ বছরের মাদী উট ২টি তিন বছরের মাদী উট ২টি চার বছরের মাদী উট ২টি চার বছরের মাদী উট এবং ১টি ছাগল ২টি চার বছরের মাদী উট এবং ২টি ছাগল ২টি চার বছরের মাদী উট এবং ৩টি ছাগল ২টি চার বছরের মাদী উট এবং ৪টি ছাগল ২টি চার বছরের মাদী উট এবং ১টি দুই বছরের উট ৩টি ৪ বছরের মাদী উট এবং প্রতি ৫টিতে ১টি ছাগল |
ঘোড়া | (এক্ষেত্রে তিনটি মত পাওয়া যায়) | যাকাত নেই কিংবা সম্পূর্ণ মূল্যের ২.৫% কিংবা প্রতিটি ঘোড়ার জন্য ১ দিনার পরিমাণ অর্থ |
শেয়ার, ব্যাংক নোট, স্টক | ৫২.৫ তোলা রূপার মূল্যমান | সম্পূর্ণ মূল্যের ২.৫%, তবে কোম্পানী যাকাত দিলে ব্যক্তিগতভাবে যাকাত দিতে হবে না |
অংশীদারী কারবার ও মুদারাবা | ৫২.৫ তোলা রূপার মূল্যমান | প্রথমে সম্পত্তির যাকাত দিতে হবে, মূলধনের নয়; এরপর লাভ বন্টিত হবে। যাকাত ব্যক্তিগতভাবে লাভের উপর হবে, একভাগ (২.৫%) দিবে মূলধন সরবরাহকারী এবং একভাগ (২.৫%) দিবে শ্রমদানকারী। |
যাকাতমুক্ত সম্পদ
যাকাতমুক্ত সম্পদ সম্পর্কে রাসুল (সা:) বলেছেন, বাসস্থানের জন্য নির্মিত ঘরসমূহ, ঘরে ব্যবহার্য দ্রব্যাদি, আরোহণের জন্য পশু, চাষাবাদ ও অন্যান্য আবশ্যকীয় কাজে ব্যবহৃত পশু ও দাস-দাসী, কাঁচা তরি-তরকারিসমূহ এবং মৌসুমী ফলসমূহ যা বেশিদিন সংরক্ষণ করা যায় না, অল্পদিনে নষ্ট হয়ে যায়, এমন ফসলে যাকাত দিতে হয় না।
যাদের ওপরে যাকাত ফরয
একজন মুসলমান, সুস্থ, সাবালক, স্বাধীন, জ্ঞানবান, ঋণ-কর্জযুক্ত নিসাব পরিমাণ মালের মালিকের প্রয়োজনের অতিরিক্ত বর্ধনশীল ধন-সম্পদ এক বৎসর পূর্ণ হলে যাকাত ফরয হবে। নিম্নে কাদের উপর যাকাত ফরয তার ১০টি বিষয় উল্লেখ করা হলো:
১. মুসলমান হওয়া : কোন মুশরিক অমুসলিমের ওপর যাকাত নেই।
২. সাবালক হওয়া : কোন নাবালকের সম্পদে যাকাত নেই ।
৩. সুস্থ হওয়া : কোন পাগলের ওপরে যাকাত নেই ।
৪. ঋণমুক্ত হওয়া:কোন ঋণগ্রস্থ ব্যক্তি, যার ঋণের তাগাদাকারী আছে এমন ঋণী ব্যক্তির উপরে যাকাত নেই ।
৫. মালের নিসাব পূর্ণ হতে হবে : সাড়ে সাত ভরি স্বর্ণ অথবা ৫২.৫০ ভরি রৌপ্যের মালিক হতে হবে বা সমপরিমাণ মাল পূর্ণ এক বছর আয়ত্তে থাকতে হবে।
৬. অর্থ-সম্পদে পূর্ণ মালিকানা থাকতে হবে : মালের ওপরে মালিকানা- স্বত্ব বা দখল না থাকলে যাকাত ফরয হবে না ।
৭. যাকাতযোগ্য অর্থ-সম্পদ প্রয়োজনের অতিরিক্ত হতে হবে: জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় গৃহ-আসবাবপত্র, পরিধানের কাপড়, গৃহস্থালী আসবাবপত্র, নিজস্ব ব্যবহারের যানবাহন এবং স্বর্ণ-রৌপ্য ব্যতীত পারিবারিক সাজসজ্জার উপকরণ, হীরা বা মূল্যবান পাথর যা ব্যবহারের জন্য ব্যবসার জন্যে নয়, এমন সব সামগ্রীর ওপরে যাকাত ফরয হবে না।
৮. মাল বর্ধনশীল হতে হবে : প্রত্যক্ষভাবে বর্ধনশীল হোক যেমন ব্যবসার মাল বা পরোক্ষভাবে হোক যেমন স্বর্ণ-রৌপ্য দ্বারা প্রস্তুত অলঙ্কার, এর ওপরে যাকাত ফরয হবে।
৯. এক চান্দ্রবর্ষ পূর্তি হতে হবে : ধন-সম্পদ পূর্ণ এক বৎসর নিজস্ব মালিকানায় থাকতে হবে। বছরের মাঝখানে মাল-সম্পদ কমে গেলেও বছর শেষ হওয়ার সাথে সাথে যা আছে তার ওপরে যাকাত ফরয হবে। বছরের মাঝখানে কোনো নতুন সম্পদের মালিক হলে একসাথে সেগুলোসহ পুরো মালের যাকাত আদায় করতে হবে।
১০. স্বাধীন হতে হবে : কোন ক্রীতদাসের ওপরে যাকাত ফরয নয় ।
বর্তমানে কত টাকা থাকলে যাকাত ফরজ হয়
বর্তমানে কত টাকা থাকলে যাকাত ফরজ হয়? কারো কাছে ৫২.৫০ (সাড়ে বাহান্ন) তোলা রূপা অথবা ৭.৫ (সাড়ে সাত) তোলা স্বর্ণ বা এর বর্তমান বাজারমূল্য সমপরিমাণ টাকা বা ব্যবসায়িক পণ্য থাকলে তার উপর যাকাত ফরয হবে। বর্তমান সময়ে কারো কাছে মৌলিক প্রয়োজনের অতিরিক্ত এই পরিমাণ টাকা থাকলে এবং এই টাকায় পূর্ণ এক বছর অতিবাহিত হলে যাকাত ফরজ হবে।
যাকাতের খাত
পবিত্র কোরআন মাজিদে যাকাত আদায়ের ৮ টি খাতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে সেই খাত সমূহে যাকাতের হিসাব করে যাকাত প্রদান করতে হবে – যথা
যাকাত কেবল নিঃস্ব, অভাবগ্রস্ত, তহশীলদার (যাকাত আদায়কারী কর্মচারী), যাদের চিত্ত আকর্ষণ করা হয় তাদের জন্য, দাস মুক্তির জন্য, ঋণগ্রস্থদের জন্য, আল্লাহর পথে জিহাদকারী ও মুসাফিরের জন্য। এটা আল্লাহর নির্ধারিত বিধান। আর আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।
যাকাতের খাতসমূহ
১। ফকির-অভাবগ্রস্ত, দরিদ্র
অভাবগ্রস্ত বা দরিদ্র তাকেই বলে যে ব্যক্তি নিসাব পরিমাণ অর্থ-সম্পদের মালিক নয়। তার নিকট যে পরিমাণ অর্থ আছে তার চেয়ে তার অভাব আরও বড়, আরো বেশি। এমন ব্যক্তিকে অভাবী-দরিদ্র বলা হবে। তবে তার যতটুকু সম্পদ আছে তা নিজের প্রয়োজনে। যেমন : থাকার ঘর, পরিধানের বস্ত্র, দ্বীনি কিতাব আছে তবে দরকারের বেশি কিছু নেই।
২। মিসকীন – সর্বহারা
মিসকীন বা সর্বহার এমন ব্যক্তি যার কিছুই নাই। ভিক্ষুক হয়ে মানুষের কাছে হাত পেতে বেড়ায়। কাপড়-ছোপড় ও খাবারের জন্য মানুষের মুখাপেক্ষী হয়।
৩। যাকাত আদায়কারী
যাকাত বা ওশর আদায় করার জন্য যাকে নিযুক্ত করা হয় এমন ব্যক্তি বা তার সহযোগীদেরকে যাকাতের অর্থ থেকে পারিশ্রমিক বা বেতন দেওয়া যাবে। তবে মনে রাখতে হবে উসুলকৃত যাকাতের অর্ধেকের বেশি তাদের পারিশ্রমিক না হয়। আদায়কারী হাশেমী বংশের হলে যাকাত বা ওশর কোন কিছুই দেওয়া যাবে না।
৪। মনোযোজনা বা নওমুসলিমদের যাকাত প্রদান
নবী করিম (সা:) এর জামানায় মনোযোজনা এবং ইসলামগ্রহনের চিত্ত আকর্ষনের জন্য অমুসলিমদের যাকাতের অর্থ দেওয়া হতো। পরবর্তীতে সাহাবায়ে কিরামের সময় ঐকমতের ভিত্তিতে এ খাতটি স্থগিত হয়ে যায়।
৫। ক্রীতদাস আযাদ করা
স্বাধীন হওয়ার জন্য অর্থ পরিশোধের চুক্তিতে আবদ্ধ গোলাম। এমন গোলামকে মুক্তির জন্য যাকাতের অর্থ দিয়ে মুক্ত করা জায়েয।
৬। ঋণগ্রস্থ
এমন ব্যক্তি তার উপর এত ঋণ আছে যে, নিজের কাছে যা কিছু আছে তা দিয়ে ঋণ পরিশোধ করলে নিসাব পরিমাণ সম্পদ বাকি থাকে না। এমন ব্যক্তিকে ঋণ মুক্ত করার জন্য যাকাত দেয়া জায়েয। ফকিরদের চেয়ে ঋণগ্রন্থদের যাকাত দেয়া উত্তম।
৭। আল্লাহর রাস্তায় জিহাদকারী
যারা অভাবের কারণে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করতে পারছে না বা জিহাদে শরিক হতে পারছে না, তাদের জিহাদে শরীক হওয়ার জন্য যাকাতের অর্থ প্রদান করা জায়েয।
৮। মুসাফির
সফর অবস্থায় কোনো মুসাফির তার সাথে থাকা অর্থ সম্পদ হারিয়ে অসহায় হলে গেলে তাকে যাকাত দেয়া জায়েয হবে। কিন্ত ঐ যাকাতের অর্থ খরচ করার পূর্বে তার হারানো সম্পদ ফিরে পেয়ে যায় তাহলে যাকাতের অর্থ নিজে আর ব্যবহার করা উচিত হেবে না। সাদকা করে দেয়াই উত্তম।
যাকাত দেওয়ার নিয়ম
যাদের ওপর যাকাত ফরয হয়েছে তার জন্য আরবি মাস হিসাব করে মাহে রমযান মাসকে যাকাত আদায়ের মাস হিসেবে ধার্য করা যাকাতের হিসাব করে যাকাত আদায় করা খুবই উত্তম। কেননা, যাকাত মূলত চান্দ্রবর্ষের হিসেবেই আদায় করতে হয়। তাতে যথাযথ হিসাব-নিকাশ করা যায়। এ ক্ষেত্রে মনে রাখা প্রয়োজন যে, ৮ টি খাতের কোনো একটি খাতের যাকাত গ্রহণকারী ব্যক্তিকে নিসাবের কম হয় এমন পরিমাণ যাকাত দেয়া জায়িয আছে। তবে কাউকে এক নিসাবের বেশি পরিমাণ অর্থ দেয়া মাকরূহ। যদি যাকাত গ্রহীতা ব্যক্তি ঋণী হয় তাহলে তার ঋণ পরিশোধ হয় এ পরিমাণ যাকাতের অর্থ দেয়ার পরে তার হাতে নিসাব পরিমাণ অর্থের বেশি অবশিষ্ট নেই। এমন হলে তাকে ঋণের পরিমাণসহ নিসাব পরিমাণ অর্থ দেয়া জায়িয। কোনো ব্যক্তিকে এমন পরিমাণ যাকাত দেয়া হলো যা সে তার সন্তানাদির মধ্যে বণ্টন করলে নিসাব পরিমাণ অর্থ হাতে থাকে না তাহলে এমন লোককে সে পরিমাণ যাকাতের অর্থ দেয়া জায়িয আছে। তবে একজনকে এতটুকু যাকাত দেয়া উচিত যাতে সেই দিন তার অন্যের নিকট হাত পাততে না হয়। (তথ্য সূত্র: পবিত্র মাহে রামাযান ও সিয়াম সাধনা)
যাকাত অনাদায়কারীদের শাস্তি ও পরিণাম
১. আল্লাহ তা’আলার বাণী :
وَالَّذِينَ يَكْنِزُونَ الذَّهَبَ وَالْفِضَّةَ وَلَا يُنْفِقُونَهَا فِي سَبِيْلِ اللهِ فَبَشِّرْهُمْ بِعَذَابٍ أَلِيمٍ. يَوْمَ يُحْلى عَلَيْهَا فِي نَارِ جَهَنَّمَ فَتُكُوى بِهَا جِبَاهُهُمْ وَجُنُوبُهُمْ وَظُهُورُهُمْ هُذَا مَا كَنَزْتُمْ لِأَنْفُسِكُمْ فَذُوقُوا مَا كُنتُمْ تَكْنِزُونَ
“আর যারা স্বর্ণ-রৌপ্য জমা করে এবং সেগুলোকে আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করে না তাদেরকে কষ্টদায়ক শাস্তির সংবাদ দিন। সেদিন এই সম্পদের ওপরেই জাহান্নামের আগুনে তাদেরকে তপ্ত করা হবে এগুলো দিয়ে তাদের লালাটে, পাঁজরে এবং পিঠে সেঁক দিয়ে বলা হবে, এগুলো তোমাদের জমাকৃত সম্পদ; যা কিছু জমা করেছে তার স্বাদ গ্রহণ করা ।
২. আল্লাহ তা’আলার বাণী :
وَلَا يَحْسَبَنَّ الَّذِينَ يَبْخَلُونَ بِمَا أَتَاهُمُ اللهُ مِنْ فَضْلِهِ هُوَ خَيْرًا لَّهُمْ بَلْ هُوَشَرٌّ لَّهُمْ سَيْطَوَقُوْنَ مَا بَخِلُوا بِه يَوْمَ الْقِيَامَةِ
‘আল্লাহ দয়া করে যাদেরকে ধন-সম্পদ দান করেছেন তারা যখন কৃপণতা করে তারা যেন মনে না করে যে, এ কৃপণতা তাদের জন্য মঙ্গলজনক বা কল্যাণকর; বরং তা তাদের জন্য অমঙ্গলজনক। ওই সম্পদ যাতে তারা কৃপণতা করেছিল কিয়ামতের দিন তা দিয়ে বেড়ি বানিয়ে তাদের গলায় পরিয়ে দেয়া হবে ।
৩. নবী কারীম -এর বাণী
عَن أَبي هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : مَن أتَاهُ اللهُ مالا فَلَمْ يُؤَدِّ زَكَاتَهُ مُثْلَ لَهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ شُجَاعُ أَقْرَعُ لَهُ زَبِيْبَتَانِ يُطَوَقُهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ ثُمَّ يَأْخُذُ بِلِهْزِمَتِهِ يَعْنِي شِدْقَيْهِ يَقُولُ أَنَا مَالُكَ أَنَا كَنْزُكَ. ثُمَّ تَلَا هَذِهِ الْآيَةَ لَا يَحْسَبَنَّ الَّذِينَ يَبْخَلُونَ بِمَا أَتَاهُمُ اللهُ مِنْ فَضْلِهِ هُوَ خَيْرًا لَّهُمْ إِلَى آخِرِ الْآيَةِ. رَوَاهُ الْبُخَارِيُّ فِي الصَّحِيحِ
“হযরত আবূ হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত। নবী কারীম (সা:) বলেছেন, যাকে আল্লাহ সম্পদ দান করলেন অথচ সে তার যাকাত আদায় করল না, কিয়ামতে তার এই অনাদায়কৃত যাকাতমিশ্রিত সম্পদকে নেড়ে সাপে পরিণত করা হবে, যার দু’চোখের উপরি অংশে দু’টি হলুদ বর্ণের দাগ থাকবে। ওই সাপ কিয়ামত দিবসে মালের মালিকের গলদেশ ও দু’চোয়ালে কামড় দিয়ে বলবে আমি তোমার সম্পদ ও তোমার গুপ্ত মালসম্ভার (যার তুমি যাকাত দাও নি)।
শেষকথা
ইসলামের দৃষ্টিতে যাকাত কোন অনুদান নয় বরং যাকাত হচ্ছে গরিবের অধিকার। যাকাত একদিকে দাতার সম্পদকে পরিচ্ছন্ন ও পবিত্র করে দেয়, অন্যদিকে দরিদ্রবিমোচনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে এবং সম্পদে ক্রমবৃদ্ধি বয়ে আনে। তাই যাকাত একটি সামাজিক নিরাপত্তার গ্যারান্টি, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধির অনন্য হাতিয়ার। তাই নিসাব পরিমাণ মালের মালিকদের উচিত প্রতি বৎসর মোট সম্পদকে যাকাতের হিসাব করে যাকাত আদায় করা ওয়াজিব।